৭০ ঘণ্টা কাজের দাবি সত্যিই ন্যায্য? কতক্ষণ কাজ করেন এলন মাস্ক, সুন্দর পিচাইরা?
70 Hours Work : মাস্ক কিছুকাল আগেই জানান, টুইটার কিনে নেওয়ার পর তিনি এখন সপ্তাহে ১২০ ঘণ্টা কাজ করেন।
ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি সম্প্রতি বলেছেন, দেশের যুব সম্প্রদায়ের উচিত সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করা। দিনে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুম কতখানি দরকার, সেই ঘুম না হলে শরীরে কী কী ক্ষতি হয় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, তর্কও হয়েছে। কিন্তু সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাজ পর্যাপ্ত তা নিয়ে তেমন কোনও মাপকাঠি তো ছিল না। এককালে দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। এখনও তা নিয়ে চর্চা হয় বটে কিন্তু যারা চর্চা করেন বা করেন না সকলেই ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন, কাজ করতে বাধ্য হন। সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টার হিসেবটা একটু কষে দেখা যাক। সপ্তাহে একটি ছুটি না পেলে মানুষ সপরিবার নানাভাবেই মারা যেতে পারে। তাই ধরা যাক একটি দিন বাদ। হাতে রইল ৬ দিন। এই ৬ দিন যদি ১২ ঘণ্টা করে কাজ করা যায় তাহলে হচ্ছে ৭২ ঘণ্টা। আর সপ্তাহে ২ দিন ছুটি চাইলে, অর্থাৎ ৫ দিন কাজ করে দু'দিন বিশ্রাম চাইলে ওই ৫ দিন কাজ করতে হবে ১৪ ঘণ্টা করে। ৭০ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ভারতের সাধারণ জনতা কত টাকা করে উপার্জন করেন? সেই হিসেব নিজেদের চারদিকে তাকালেই মিলবে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া মাসিক মাইনে ৩০ হাজার করতেও দম বেরিয়ে যায় যুবক যুবতীদের। নারায়ণ মূর্তি নিজে কতক্ষণ কাজ করতেন? এলন মাস্কই বা কতক্ষণ করেন, সুন্দর পিচাই?
ইনফোসিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন এবং লেখক সুধা মূর্তি জানিয়েছেন তাঁর স্বামী যে অন্যদের ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করতে বলেছেন তা নয়। তিনি নিজেই সপ্তাহে ৮০-৯০ ঘণ্টা কাজ করেছেন। নারায়ণ মূর্তি সত্যিকারের কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাস করেন। যিনি নিজে এই পরিমাণ কাজ করেছেন তিনি এর চেয়ে কম কাজ কী তা জানেনই না।
আরও পড়ুন- ১২,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই, আর পিচাইয়ের বেতনে ব্যাপক বৃদ্ধি! কী চলছে গুগলের অন্দরে?
নারায়ণ মূর্তি ভারতীয় যুব সম্প্রদায়ের উত্পাদনশীলতা নিয়ে একটি পডকাস্টে বলেছিলেন, ভারতের উৎপাদনশীলতা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। তাই প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ না করলে দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি বাধা পাবে। নারায়ণ মূর্তি আরও বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে চিনের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য জাপান এবং জার্মানির মতো দেশের যুবসম্প্রদায় বহুক্ষণ করে কাজ করতেন।
১৯৮১ সালে আগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে, স্ত্রী সুধা মূর্তির কাছ থেকে ১০,০০০ টাকা ধার নিয়ে নারায়ণ মূর্তি ইনফোসিস শুরু করেন। চার বছরের মধ্যে কোম্পানিটি টেক জায়ান্ট হয়ে ওঠে। ২ লক্ষেরও বেশি কর্মী নিয়োগ করে। বেঙ্গালুরুকে ভারতের আইটি হাব করে তুলেছে ইনফোসিসই। নিজের কোম্পানিকে দাঁড় করাতে সপ্তাহে ৮০-৯০ ঘণ্টা দেওয়া স্বাভাবিকই। নিজের বিনিয়োগে তৈরি করা সংস্থাকে সফল করতে অমানবিক পরিশ্রম এবং অন্যের সংস্থায় চাকরি করে সংসার চালানোর পরিশ্রমের মধ্যে ফারাক কতখানি?
২০১১ সালে নারায়ণ মূর্তি ৩০ বছর চাকরি করার পর ইনফোসিসের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন। ২০১৩ সালে ফের কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে ফিরে আসেন, ২০১৪ সালে অবসর নেন। এই পরিসরে ১৭,০৮৪ কোটি টাকার সম্পত্তি গড়েছেন নারায়ণ মূর্তি। শুরুর দিকের পরিশ্রমই তাঁকে এই পর্যায়ে এনেছে অনস্বীকার্য। কিন্তু অন্যের অধীনে চাকরি করা সমস্ত যুব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই কি ৭০ ঘণ্টার কাজ মানেই উন্নতি?
টেসলার সিইও এলন মাস্ক এখন টুইটার সহ পাঁচটি কোম্পানির মালিক। টেসলা, নিউরালিঙ্ক, স্পেসএক্স এবং কসমেটিক ব্র্যান্ড দ্য বোরিং কোম্পানি সামলান এলন মাস্ক। এই চরম ব্যস্ততা কোনওভাবেই ৮ ঘণ্টায় সামলানো সম্ভব না। মাস্ক কিছুকাল আগেই জানান, টুইটার কিনে নেওয়ার পর তিনি এখন সপ্তাহে ১২০ ঘণ্টা কাজ করেন।
মাস্ক বলেছিলেন, "আমার কাজের চাপ সপ্তাহে প্রায় ৭০-৮০ ঘণ্টা থেকে বেড়ে সম্ভবত ১২০ ঘণ্টা হয়েছে। আমি ঘুমোতে যাই, ঘুম থেকে উঠি, কাজ করি, ঘুমোতে যাই, উঠি, কাজ করি, সপ্তাহে সাত দিনই এটি করি"। মাস্কের সম্পত্তির পরিমাণ, ২২,৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ নিজে ৫ টি কোম্পানির মালিক, ১২০ ঘণ্টা কাজ করেন। নিজের সংস্থা আর অন্যের সংস্থায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চাকরির মধ্যে বড় ফারাক কি সত্যিই নেই?
আরও পড়ুন- এক নম্বর ধনকুবের এলন মাস্ককে টেনে নামিয়েছেন ইনি, এই ফরাসি ব্যবসায়ীকে চেনেন?
প্রযুক্তির বিশ্বে বিপ্লব এনেছিলেন সুন্দর পিচাই। গুগলের সিইও পিচাইও কি ৮০ থেকে ১২০ ঘণ্টাই কাটান জীবিকার পিছনে? সুন্দর পিচাই যে পরিবারের সঙ্গে ব্যাপক সময় কাটান তা নানাভাবেই নানা সময়ে তিনি জানিয়েছেন। পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সুন্দরভাবে আলাদা রাখেন তিনি। প্রতিদিনই প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান। দিনে কাজও করেন ঠিক সাত থেকে ৮ ঘণ্টাই! Alphabet-এর সিইও সপ্তাহে ৩৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করেন। বাকি সময়টা ব্যায়াম, পরিবার, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেন পিচাই নিজে।
সপ্তাহে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কেউ টানা কাজ করলে সেই ব্যক্তির শরীর ও মন অন্য কিছুর জন্যই সুস্থ যে থাকতে পারে না তা বলছেন বিজ্ঞানীরাই। হার্টের সমস্যা থেকে শুরু করে হাড়ের সমস্যা, পাশাপাশি মানসিক চাপ ও উদ্বেগ একজন কর্মীকে শেষ করে দেয়। অহেতুক দীর্ঘক্ষণ কাজ কোম্পানির লাভ বাড়ায় অবশ্যই। মাঝেসাঝে নিজের প্রোমোশন ও উন্নতিও ঘটে না তা নয়। তবে সেই উন্নতিকে উপভোগ করার মতো স্বাস্থ্য ও মন থাকে না অধিকাংশেরই। চাকরি চিরকালই অন্যের অধীনের কাজ। সেখানে ৭০ ঘণ্টা দিতে কতখানি প্রস্তুত ভারতের সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা?