যত্রতত্র ফেলেন, কমোডে ফ্লাশ করেন? মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে আসলে যা করা উচিত
Date Expired Medicines: মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের সঠিক নিষ্পত্তি কীভাবে করতে হয় তা অধিকাংশ মানুষই জানেন না। ফলে মানুষ হয় তা আবর্জনার গাদায় ফেলে দেন বা কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দেন।
আমাদের ওষুধ নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতি অঙ্গের জন্য এক একটি ওষুধ। এবার মুশকিল হচ্ছে, ডাক্তার দেখিয়ে প্রেসক্রিপশনে লিখিত ওষুধ কেনার পর অনেক সময়ই পুরোটা আর শেষ করে ওঠা হয় না। রোগের উপসর্গ কমলেই, বিপদের দিনে পাশে থাকা ওষুধটিকে আমরা সরিয়ে রেখে দিই। ভাবি, আবার এমন দুর্দিন এলে নাহয় কাজে লাগানো যাবে। এই করে ওষুধ আমাদের জমতেই থাকে। আবার অনেকসময় বেশ কিছুদিন একটি ওষুধের কোর্সের পর, হঠাৎ চিকিৎসক ওষুধ বদলে দিলেন হয়তো। আধখাওয়া ওষুধের পাতা রয়েই গেল বাক্সে। তারপর বহুকাল পরে আবার অসুস্থ হয়ে দাওয়াই খুঁজতে গিয়ে আপনি আবিষ্কার করলেন, ওষুধ স্টকে আছে ঠিকই কিন্তু তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। ওই ডেট এক্সপায়ার্ড ওষুধ খেয়ে নিজেরই এক্সপায়ার করার আশঙ্কা বাড়ে! তাহলে উপায়? ওই ওষুধের ভবিষ্যৎ কী? ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের সঠিক নিষ্পত্তি কীভাবে করতে হয় তা অধিকাংশ মানুষই জানেন না। ফলে বিশ্বের বহু দেশেই মানুষ হয় তা আবর্জনার গাদায় ফেলে দেন বা কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দেন। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এভাবে ফেলে দিলে তা স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন-ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায়! তবু কেন অ্যাসিডিটির এই ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ভারতে?
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খাওয়া কেন বিপজ্জনক?
স্থিতিশীলতা পরীক্ষার মাধ্যমে ওষুধের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখটি নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন সংরক্ষণ পরিস্থিতিতে কতক্ষণ ওষুধটি নিরাপদ এবং কার্যকর থাকে তা মূল্যায়ন করা হয়। প্রস্তুতকারকরা সাধারণত ওষুধের গুণমান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখটি অবশ্যই উল্লেখ করে থাকেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের অবনতি হয়। এর মানে হচ্ছে, ওষুধ মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখে পৌঁছলে, ওই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে আর কাজ নাও করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের মতো ওষুধের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয়। সাবথেরাপিউটিক ডোজ (সঠিকভাবে কাজই করে না এবং তাই অসুস্থতা বা সংক্রমণও সম্পূর্ণ সারে না) অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাক ওষুধে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয় তখনই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ঘটে। সংক্রমণের চিকিত্সা করাই তখন কঠিন হয়ে যায়। উল্টে, রোগের বিস্তার, গুরুতর অসুস্থতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ইনসুলিন বা হার্টের ওষুধের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ওষুধের ক্ষমতা হ্রাস হওয়াও উদ্বেগের বিষয়, কারণ এটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ক্ষতিকারক যৌগে ভেঙে যেতে পারে। এর একটি উদাহরণ হলো সিপ্রোফ্লক্সাসিন। এই অ্যান্টিবায়োটিকটি সাধারণত মূত্রনালীর এবং উপরের এবং নিম্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়দ ফুরিয়ে গেলে এটি বিষাক্ত যৌগে পরিণত হতে পারে যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে। এই ওষুধের সঠিক নিষ্পত্তি না হলে তা পরিবেশের জন্যও বিপজ্জনক।
তাপ, আর্দ্রতা এবং আলো সংস্পর্শে এলে ওষুধের সক্রিয় উপাদানগুলিতে ভাঙন ধরতে পারে। প্যারাসিটামল খুব সাধারণ এক ওষুধ। ব্যথা এবং জ্বরের জন্য সকলেই এই ওষুধ কেনেন। এক বছরের পুরনো প্যারাসিটামল ট্যাবলেট বিপজ্জনক নাও মনে হতে পারে কিন্তু যদি ওষুধটি পচে যেতে থাকে তাহলে ব্যথা বা জ্বরের চিকিৎসায় তা আর কাজ করবে না, রোগ সারবে না। সারছে না বলে, অনেকেই বেশি মাত্রায় ওষুধ খেতে থাকেন, যার ফল ভালো নাও হতে পারে।
কেবল ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল নয়, কাশির সিরাপ, চোখের ড্রপ, কানের ড্রপেরও মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা দূষণ ঘটায় কারণ এতে থাকা প্রিজারভেটিভগুলি তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। এটি ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়, যার থেকে আবার সংক্রমণ হতে পারে। বাড়িতে রেখে দেওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ভুল করে শিশুরা খেয়ে ফেললে বিপদ চরম।
আরও পড়ুন-মুঠো মুঠো ব্যথার ওষুধ খাচ্ছেন? পেইনকিলার নিয়ে যে আশঙ্কার কথা জানাচ্ছে সরকার
কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, সময় পেরিয়ে গেলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, তবে তা খেয়ে নিলে নিরাপত্তার কোনও গ্যারান্টি নেই। মানুষ এবং পরিবেশ দুইয়ের সম্ভাব্য ক্ষতি রোধ করার জন্য তাই এই ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের নিরাপদ নিষ্পত্তি অপরিহার্য। মেয়াদোত্তীর্ণ বা উদ্বৃত্ত ওষুধ আবর্জনার গাদায় ফেলে দিলে বা টয়লেটে ফ্লাশ করে দিলে তা পরিবেশের জন্য খারাপ। গৃহস্থালির আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেওয়া ওষুধগুলির মধ্যে থাকা সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদানগুলি মাটি এবং ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করতে পারে।
বেসিনের সিঙ্ক বা টয়লেটে ওষুধ ফ্লাশ করার ফলে এই পদার্থগুলি সরাসরি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। সেগুলি জলে মিশে জলজ বাস্তুতন্ত্রে ঢুকে পড়ে। বন্যপ্রাণীদের ব্যাপক ক্ষতি হয় এতে। আর পানীয় জলে যদি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মিশে যায় তাহলে মানুষের সরাসরি বিপদ। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের পাশাপাশি এবং এন্ডোক্রিন সমস্যাও বাড়ে। এই সমস্যা দেখা দিকে মানব দেহের প্রাকৃতিক হরমোনগুলি প্রভাবিত হয় যার ফলে স্বাস্থ্যে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা দেখা যেতে পারে।
তাহলে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সবচেয়ে নিরাপদভাবে কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায়?
অব্যবহৃত বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের নিষ্পত্তির সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হলো ড্রাগ টেক-ব্যাক প্রোগ্রাম। এতে অনুমোদিত কর্মীরা, যেমন ফার্মাসিস্ট বা মনোনীত কর্মকর্তারা ওষুধের নিষ্পত্তি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে জনসাধারণকে ওষুধ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা দিয়ে যেতে হয়। তবে এই ব্যবস্থা সব দেশে নেই। সেক্ষেত্রে ব্যবহৃত কফি গ্রাউন্ড বা বিড়ালের লিটারের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে তা রেখে ভালো করে বন্ধ করে ফেলা যেতে পারে যারে কোনও শিশু বা অন্য প্রাণী তা খুলে না ফেলতে পারে। এতে অন্তত ওষুধগুলি টয়লেট বা ড্রেন থেকে দূরে থাকছে, যার ফলে জল দূষণ এবং জলজ জীবনের ক্ষতি কম হয়।