4B Movement: বিয়ে-সন্তান-যৌনতাকে 'না'! কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে এই আন্দোলন?
South Korea 4B Feminist Movement: পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো এবং বৈবাহিক নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই ধরে নেওয়া হয় এই মহিলা নিশ্চয়ই সমকামী!
বিয়ে না 'হলে' যে গুরুজনদের রাত্রি বিনিদ্র হয়ে যায়, অরুচি জাগে বা উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় দেহ ক্রমেই অবসন্ন হতে থাকে, সেই গুরুজনদের এই চিরাচরিত প্রত্যাশাকে বহু মানুষই এখন চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ করছেন। চ্যালেঞ্জ করছেন প্রেমের পরিণতি হিসেবে বিয়ের বাধ্যবাধকতাকে, চ্যালেঞ্জ করছেন সন্তান জন্মের জন্য বিয়ের প্রয়োজনীয়তাকে। এই নিয়ে আন্দোলনও শুরু হয়েছে বিশ্বের বহু জায়গাতেই। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়া। বিবাহ, মাতৃত্ব এবং বিষমকামী সম্পর্কের সামাজিক প্রত্যাশাকে সেখানে হেলায় প্রত্যাখ্যান করছেন যুবতীরা। আর এই যুবতীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়াতে এই আন্দোলন 4B Movement বা 4 Nos নামে পরিচিত।
‘B’ হচ্ছে কোরিয়ান শব্দ bi (비/非)-এর একটি হোমোফোন, যার অর্থ 'না’। চারটি না-এর নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে এই আন্দোলন। ১) বিহোন (বিয়েতে না), ২) বিকুলসান (কোনও সন্তানের জন্ম নয়), ৩) বিয়োনাই (কোনও ডেটিং নয়) এবং ৪) বিসেকসু (কোনও যৌনতা নয়)। বিয়ে করা, সন্তান ধারণ করা, প্রেম করা বা পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যেতে অস্বীকার করছেন মহিলারা। 4B আন্দোলনের নারীবাদীরা সামাজিক লিঙ্গ ভূমিকার বাইরে গিয়ে তাঁদের জীবনকে নতুনভাবে দেখতে চাইছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এই আন্দোলন নতুন গতি পেয়েছে মার্কিন মুলুকে।
আরও পড়ুন- ডিয়ার পুরুষ, ‘লড়কিও কি না মে হাঁ নেহি হোতি হ্যায়’
কিন্তু 4B আন্দোলন কী, কীভাবে এর সূত্রপাত আর কেনই বা মহিলারা এই পথে হাঁটছেন?
4B আন্দোলন আসলে দক্ষিণ কোরিয়ার যুবতীদের মধ্যে দীর্ঘকালের অসন্তোষের ফল। বাড়িঘরের নিশ্চয়তা না থাকা, ডিজিটাল যৌন হিংসা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক চাপের মুখোমুখি হওয়া মহিলাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াতেই এই আন্দোলনের জন্ম। দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীবাদের প্রতি আগ্রহ ও চর্চা বৃদ্ধির পর, ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রাথমিকভাবে মহিলাদের অনলাইন গ্রুপগুলির মাধ্যমেই তা ছড়িয়ে পড়ে।
4B আন্দোলনের শিকড় দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং ২০০০-এর দশকের তরুণ প্রজন্মের নানা চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় যুবতীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা মূলে আছে লিঙ্গ বৈষম্য। লিঙ্গভিত্তিক মজুরির ব্যবধানের ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া ধারাবাহিকভাবে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থায় চিরাচরিত পদ্ধতিতে জীবন বাঁচা, বিয়ে, সন্তান ধারণ এবং গৃহবধূ হওয়া আর মেয়েদের প্রলোভিত করে না। দক্ষিণ কোরিয়ার পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে পুরুষবিহীন বিকল্প জীবনকেই কৌশল হিসেবে অবলম্বন করছেন মেয়েরা।
২০১৬ সালে সিওলে এক পুরুষ ট্রেনের স্টেশনের টয়লেটে একজন মহিলাকে হত্যা করে, যার পর থেকেই এই আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে যায়। অনলাইন নানা মাধ্যমে এই চিন্তাধারার মহিলারা ক্রমেই নিজেদের হতাশার কথা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেছেন, পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের সমালোচনা করতে পারছেন এবং প্রতিবাদও সংগঠিত করতে পারছেন। এই সময়ে আরও কিছু আন্দোলনের কথা জানা যায় যেখানে মেকআপ, কসমেটিক সার্জারি এবং পোশাকের বিধিনিষেধকে নস্যাৎ করে সামাজিক সৌন্দর্যের মানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বহু মহিলা।
আরও পড়ুন-পুরুষ প্রবেশ নিষেধ, দশকের পর দশক ধরে এ গ্রামে জয়জয়কার নারীদেরই
দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। সরকার দীর্ঘদিন ধরেই এই বিষয়টিকে জাতীয় সংকট হিসেবেই দেখে আসছে। নবদম্পতিদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত আবাসন এবং পরিবারের জন্য করছাড়ের মতো নীতি এনে বিবাহ এবং সন্তানের জন্মদানকে উত্সাহিত করার চেষ্টা করেছে সরকার৷
২০১৬ সালে সরকার প্রতিটি জেলায় প্রজননক্ষম বয়সের মহিলাদের সংখ্যা অনুমান করে একটি জাতীয় গোলাপি জন্ম মানচিত্র চালু করে। এই ঘটনা ঘিরে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মহিলারা বলতে থাকেন "আমার গর্ভ জাতীয় সম্পত্তি নয়" এবং "একজন মহিলা শিশু তৈরির মেশিন নয়"। এই 4B আন্দোলনের অংশ হওয়া মহিলারা বলছেন, একজন মহিলার স্বাধীনভাবে বাঁচার বদলে রাষ্ট্র জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেই অগ্রাধিকার দেয়। যার প্রতিক্রিয়া হিসাবেই, আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিক প্রতিরোধের অংশ হিসাবেই বিবাহ এবং মাতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে।
মহিলারা বিয়ে-সন্তান চাইছেন না এর চেয়ে বড় 'অলক্ষুণে' কী হতে পারে আর! ফলে কড়া সমাজ আরও কড়া হচ্ছে। যে মহিলারা এসবের বিরোধিতা করছেন তাঁদের স্বার্থপর বা অসামাজিক হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো এবং বৈবাহিক নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই ধরে নেওয়া হয় এই মহিলা নিশ্চয়ই সমকামী! এই 4B আন্দোলনকে ভালো চোখে নেয়নি রাজনৈতিক দলগুলিও। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী লি সেউং-চেওন ২০২০ সালে তাঁর প্রচারে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ‘4B আন্দোলন' বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন তিনি। তবুও, নিজের জীবন নিজের শর্তে বাঁচার 4B আন্দোলনেরত মেয়েরা অবিচল। পিতৃতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়ার নতুন নতুন উপায় খুঁজে চলেছেন তাঁরা রোজ।
আরও পড়ুন-অ্যানিমেল : বন্দুক ও পুরুষাঙ্গের জান্তব আস্ফালন
তাঁদের এই 4B আন্দোলনের ধারণার সঙ্গে একাত্ম হচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলারাও। ট্রাম্পের নানা পিতৃতান্ত্রিক বক্তৃতা এবং প্রজননের অধিকার বিষয়ক বিতর্কের মধ্যে এই আন্দোলন প্রসঙ্গিকতা খুঁজে পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে। আবারও গর্ভপাতের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার নীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, নারীর অধিকার খর্ব করা বিষয়ে নানা কট্টরপন্থী বক্তৃতাও বাড়ছে।
অন্যদিকে চিনে দানা বাঁধছে 6B4T আন্দোলন যা 4B আন্দোলন দ্বারাই অনুপ্রাণিত। আন্দোলনের এই সংস্করণে অতিরিক্ত কিছু নীতিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভোগবাদ প্রত্যাখ্যান করা এবং অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে পারস্পরিক সহায়তাকে উৎসাহিত করা। এশিয়া জুড়ে এবং তার বাইরেও 4B ধারণার বিস্তার নারীবাদী সংগ্রামের সার্বজনীনতাকে তুলে ধরছে। বিয়ে-বাচ্চা-সংসারের গণ্ডিকে হেলায় তুচ্ছ করে নতুন বিস্তৃত নিজস্ব আকাশ খুঁজছেন মেয়েরা, অর্ধেক নয়, গোটা, আস্ত একটা নিজস্ব আকাশ।