বিফলে গেল ক্যামেরামুখী ধ্যান! বিবেকানন্দের কাছেই হেরে গেলেন নরেন্দ্র মোদি?

Vivekananda Vs Modi: জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৯ বার দেশের দক্ষিণের রাজ্যে গিয়েছিলেন মোদি। এত কিছুর পরও তামিলনাড়ু থেকে একজনও সাংসদ নেই বিজেপির।

বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মসভার সেই অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় ধর্মের নামে হিংসা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। গীতার উল্লেখ করে বলেছিলেন, কেন হিন্দুধর্ম সর্বজনীন। সভায় দশটি ধর্মের উপস্থিত প্রতিনিধির সামনে বক্তৃতা পেশ করেন স্বামীজি। ১৩১ বছর আগে কন্যাকুমারীতে ধ্যান করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যাঁকে গোটা বিশ্ব চিনেছে স্বামী বিবেকানন্দ নামে। ১৮৯৩ সালে এখান থেকেই পাড়ি দিয়েছিলেন শিকাগো ধর্মসভার উদ্দেশে। তার ঠিক ১৩১ বছর পর আরেক নরেন্দ্র ধ্যান করেছেন এখানে। এই নরেন্দ্র দেশের তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী। কন্যাকুমারীতে ধ্যান করা প্রধানমন্ত্রী ভোট প্রচারে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের দিকে মুসলিম তোষণের অভিযোগ তুলেছিলেন। যথারীতি ভুল যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, কংগ্রেসের ইস্তেহারে নাকি 'মুসলিম লীগের' ছাপ রয়েছে। অথচ বাস্তবে ওই ইস্তেহারে মুসলিম শব্দটুকুও ছিল না। বরং ইস্তেহারে 'সংখ্যালঘু' ও 'সংখ্যাগরিষ্ঠ'-র মতো শব্দবন্ধের ব্যবহার করা হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন, তাহলে কি মোদিকে বিবেকানন্দ ভক্ত ধরে নেওয়া যায়?

বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতায় তিনটি আদর্শের কথা বলেছিলেন। প্রথমত, হিন্দুধর্মে সব ধর্মই সমান; দ্বিতীয়ত, সমাজে ধর্মীয় বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ; তৃতীয়ত, প্রতিটি ধর্মেই ত্রুটি রয়েছে, তাই ভিন্ন ধর্ম থেকেও শিক্ষা নেওয়া উচিত। তিনি ভারতের প্রথম সোশ্যালিস্ট ছিলেন। গান্ধি 'হরিজন' কথাটি যে অর্থে ব্যবহার করেছিলেন, তার অনেক আগেই বিবেকানন্দ 'দরিদ্রনারায়ণ' শব্দবন্ধের উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনও ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে মানলে তা একই লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর আগে রামকৃষ্ণ মঠের মূল নীতিতে লেখা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি রাজনীতিতে যুক্ত হবে না। এই প্রতিষ্ঠান সকল ধর্মকেই সমান জায়গা করে দেবে এবং রামকৃষ্ণ মিশনের গুরুরা ভোট দেবেন না।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে, গত ১০ বছরে ধর্মের নামে হিংসা নিয়ে সচেতন বিবেকানন্দের কোনও নীতিই পালন করতে দেখা যায়নি। অথচ তিনি রীতিমতো দাবি করে যান বিবেকানন্দের ভক্ত তিনি। মোদি ৩১ মে নির্বাচন প্রচার শেষে ধ্যানে বসেছিলেন তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়ালের ধ্যানমণ্ডপে। সেখানে রুদ্রাক্ষের মালা পরে, গেরুয়া বসনে ৪৫ ঘণ্টা ধ্যান করেন। লক্ষ্যে পৌঁছতেই বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত এই ধ্যানমণ্ডপকে বেছে নিয়েছিলেন মোদি, রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা অন্তত তাই অনুমান করছেন। অজস্র ক্যামেরার মুখোমুখি হয়ে ধ্যান সম্পন্ন হয় প্রধানমন্ত্রীর। এদিকে বিবেকানন্দ রকে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। এই কর্মসূচি নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গ করছে বলে কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছিল সিপিএম এবং কংগ্রেস। কমিশন জানিয়েছিল, কোনও আচরণবিধিই লঙ্ঘন করছেন না মোদি। ভোট মরসুমে দেশের প্রধানমন্ত্রীর এত পরিকল্পিতভাবে ধ্যানের আয়োজন নাকি নিয়ম লঙ্ঘন করছে না। তবুও বিবেকানন্দকে হাতিয়ার করেও ভোট কৌশলে সাফল্য পেল না বিজেপি। বিবেকানন্দর নীতিরই জয় হলো। মোদি গত ১০ বছরে যেভাবে ধর্মের মেরুকরণে রাজনীতি করেছেন, তাতে বিবেকানন্দের ভক্ত বলে নিজের পরিচয় দেওয়া আসলে নীতির অবমাননা করা। ভোটের প্রচারে 'হিন্দুত্ববাদী', 'ইসলামোফোবিক' কথার রেকর্ড গড়েছেন মোদি।

আরও পড়ুন- অযোধ্যা কেন বিজেপিকে তাড়াল? কী বলছেন রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত?

গত এক দশকে ভারতে অন্যান্য রাজ্যে যেভাবে পদ্ম ফুটেছিল তার সঙ্গে দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে মেলানো যাচ্ছিল না। এবারেও মেলানো যায়নি। তবে, মোদি প্রচার করতে গিয়ে দাবি করে ফেলেছিলেন, এবার নাকি দক্ষিণের মন বদলেছে। উল্লেখ্য, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রামলালার মূর্তিও দক্ষিণ ভারতীয় ছাঁচে গড়া হয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণভারতে রাম ততখানি জনপ্রিয় নন। উত্তরভারতের রামায়ণ আর দক্ষিণ ভারতের রামায়ণ বিপরীতমুখী। দক্ষিণভারতকে বিজেপিমুখী করতেই এই সকল প্রয়াস। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে বারবার জোড়ার চেষ্টা করেছে মোদি সরকার। তামিলনাড়ু থেকে সংসদ ভবনের উদ্বোধনের জন্য আনা হয়েছিল 'সেঙ্গল' বা 'রাজদণ্ড'। জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৯ বার দেশের দক্ষিণের রাজ্যে গিয়েছিলেন মোদি। এত কিছুর পরও তামিলনাড়ু থেকে একজনও সাংসদ নেই বিজেপির।

মোদি প্রতিবারই ভোটপ্রচার শেষে মৌনসময় কাটাতে ধ্যান করেন। মোদি যুগে ধ্যানও এক ধরনের প্রচার কৌশল হয়ে গিয়েছে। আগে কোনও রাজনীতিবিদ হয়তো ভাবতেই পারেননি এভাবেও প্রচার সম্ভব। মোদি গোড়া থেকেই হিন্দুধর্মের নীতি-আদর্শের সঙ্গে রাজনীতির নীতি-আদর্শ মিলিয়ে ফেলেছেন বারবার, আর তাতে ভুগতে হয়েছে দেশবাসীকে। নিজের বাড়িতে বা ক্যামেরা ছাড়া সাধারণ স্থানে ধ্যান করলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব পড়ত না। তাই বিবেকানন্দের প্রতি ভক্তির ছদ্ম ছবি বাজারে ছড়িয়ে দেওয়াই যেন তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যে এবং পশ্চিমবঙ্গে ভালো ফল সহজেই পাওয়া যাবে বলে মনে করেছিলেন মোদি কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি।

কন্যাকুমারী দেশকে ঘিরে রাখা তিন সাগরের মিলন স্থল। ফলত একদিক থেকে এটি যেমন দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের মিলনভূমি। অন্যদিকে এখান থেকেই বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধি ভারত জোড়ো যাত্রার সূচনা করেছিলেন। এই ধ্যানমণ্ডপ বাঙালির কাছেও আবেগের। একইভাবে ২০১৪-তে মোদি গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রতাপগড়ে, তখনও প্রধানমন্ত্রী হননি। সেখানে ছত্রপতি শিবাজির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। ছত্রপতি শিবাজি মুসলিম আধিপত্য থেকে মারাঠা জাতি ও দেশকে রক্ষা করেছিলেন। ১৬৫৯ সালে সুলতাম আদিলশাহের সেনাপতি আফজল খানের থেকে রক্ষা করেছিলেন মারাঠা সাম্রাজ্য। শিবাজি মহারাজ আফজল খানকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। আবার ২০১৯ সালে হিন্দু তীর্থস্থান কেদারনাথে ধ্যানে বসেছিলেন মোদি। বিশ্বাস করা হয় ওখানেই শিবের জন্য ধ্যান করেছিলেন পার্বতী। সেইবার মোদির ধ্যানের ছবি দিতেই তোলপাড় হয়েছিল নেটদুনিয়া। এগুলি একটাও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

রানাডের জন্মবার্ষিকীতে মোদি বলেছিলেন, তাঁর কাছে বড় অনুপ্রেরণা রানাডের জীবন। এর থেকেই মোদি আর রানাডের সংযোগ মেলানো যাচ্ছে। ১৮৯২ সালে আরএসএসের পথপ্রদর্শক একনাথ রানাডে বিবেকানন্দ রকে তিনদিন ধ্যান করেছিলেন এবং স্বামী বিবেকানন্দ শিলাসৌধর প্রচার চালিয়েছিলেন। ফলত এটি আরএসএসেরই মস্তিষ্কপ্রসূত এবং গোড়া থেকেই এই স্থানকে বেছে নেওয়া যে সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক প্রচার কৌশল তা এবার সহজেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। শুধুই ভোটের অঙ্কই নয়, এতে অতীতের রাজনীতিও রয়েছে। তবে দেখা গেল আগেও সাফল্য মেলেনি, এবারেও মিলল না। মোদির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠের সুসম্পর্কের কথা সবাই জানে। একদা স্বামী আত্মস্থানন্দ মহারাজের সেবক ছিলেন মোদি। পরবর্তীতে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে, বিজেপির মূল সংগঠনের সঙ্গে কন্যাকুমারীর যোগ রয়েছে। রামমন্দির আন্দোলনে আরএসএসের অবদানের মতো, কাছাকাছি অবদান রয়েছে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলাস্মারক স্থাপনে। কিছুটা হলেও দু'টি আন্দোলনের মধ্যে পদ্ধতিগত যোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন- মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে পুজো করেছিলেন বিবেকানন্দ, কীভাবে বাংলায় শুরু হল কুমারী পুজো

১৯৭০ সালে স্মারক স্থাপনে প্রধান ভূমিকা ছিল রানাডের। ১৯৩৭ সালে সঙ্ঘের বয়স যখন ১২ বছর, তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যোগ দেন আরএসএসে। পূর্বক্ষেত্রের প্রচারক হয়ে উঠেছিলেন রানাডে। সাংগঠনিক বিচারে পূর্বক্ষেত্রের মধ্যেই আছে পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৪৮ সালে গান্ধি খুনের ঘটনায় দেড় বছর নিষিদ্ধ ছিল আরএসএস। বহুজন গ্রেফতার হলেও রানাডে ধরা পড়েননি। জানা যায়, তখন তিনি কলকাতাতেই আত্মগোপন করে ছিলেন। তৎকালীন আরএসএস প্রধান মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকরের (গুরুজি) পরের ক্ষমতাবান পদই ছিল একনাথের। ১৯৬২ সালে স্বামীজির জন্মশতবর্ষের বছরে শুরু হয় কন্যাকুমারীর শিলাস্মারক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। তার জন্য 'বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল কমিটি'র সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছিল একনাথকে। এই শিলা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। শিলার ওপর স্মৃতিসৌধ এবং শিলার পেছনে একটি সেতু স্থাপন করতে চেয়েছিল সঙ্ঘ পরিবার। এই কথা ছড়িয়ে পড়তেই স্থানীয় ক্যাথলিক মৎসজীবীরা পাথরের ওপর 'ক্রস ' চিহ্ন আঁকেন। একই শিলাকে হিন্দুরা 'বিবেকানন্দ রক' এবং খ্রিস্টানরা 'সেন্ট জেভিয়ার্স রক' বলেন। পরিশেষে, হিন্দুদের জয়ে ক্রসটি সরিয়ে ফেলা হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই কন্যাকুমারীর শিলাস্মারক প্রতিষ্ঠার কাজ করেছিলেন একনাথ। এতেই প্রচার-পরবর্তী ধ্যানের স্থান নির্বাচনের সরল জবাব মেলে। যদিও এখন আরএসএস এবং বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্বই চলছে।

গুজরাতের দ্বারকায় সমুদ্রতলে ধ্যান, কুম্ভমেলায় কালো পোশাক পরে গঙ্গাস্নানের নজির গড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মোদির ধ্যান নিয়ে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং বলেছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি আইনের শাসনের অধীনে পড়েন না? তিনি কি আইনের শাসনের উর্ধ্বে?" আসলে অনৈতিকভাবে দেশের একটি অংশে প্রভাব ফেলতেই এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। মোদি এখানেই সমস্যা করে ফেলেছেন। একই কৌশলে বারবার বারবার জয় পেতে চেয়ে, মানুষকে নিজেই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন আসলে এগুলি অবিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রতিবার প্রচার শেষে ধ্যান, হিন্দু আবেগের স্থানগুলিকেই বাছাই করা, প্রতিবার যে রাজ্য টার্গেট সেখানের হিন্দু কেন্দ্রবিন্দুতে ধ্যান করার কৌশল ধরে ফেলেছে দেশবাসী। এত কিছুর পরেও দক্ষিণবঙ্গে ১৩০ টি আসনের মধ্যে মাত্র ২৯ টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। কর্ণাটক থেকে ১৭ টি, তেলঙ্গানা থেকে ৮ টি, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ৩ টি, কেরল থেকে ১ টি। তামিলনাড়ুতে এবারেও খাতা খুলতে পারেনি বিজেপি। দেশ জুড়ে মাত্র ২৪০টি আসনে জয় পেয়েছে পদ্মশিবির। ৪০০ পেরোনোর লক্ষ্য পূরণ তো দূর, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পায়নি দল। গত লোকসভা থেকেও আসন কমেছে। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ আসনে রামমন্দিরের অবস্থান। এখানেও বিজেপি হেরে গিয়েছে। ধর্মীয়মেরুকরণ যে কোনও কাজেই আসেনি তা পরিষ্কার। পরিশেষে বলাই যায়, দেশবাসী জিতিয়ে দিল বিবেকানন্দের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি, হেরে গেল মোদির বিভাজনের রাজনীতি। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল বার্তাই হলো, রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম নেই। মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারবেন তো?

More Articles