বিশ্বে আর কোনও প্রাণীই ভালোবাসে না, একমাত্র কেন মানুষের পছন্দ ঝাল খাবার?
Hot Pepper: টিয়া পাখির মতো কিছু পাখি যে দিব্যি লাল লঙ্কা চিবিয়ে খায়? খায় ঠিকই কিন্তু ওরা আসলে তাপ অনুভব করতে পারে না।
ঝাল খাবারে ভারতীয়দের জুড়ি মেলা ভার! বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ রান্নাতেই লঙ্কার ব্যবহার হয়ে থাকে কিন্তু মাত্রার হেরফের ঘটে সর্বত্র। লঙ্কারই জাতভাই ক্যাপসিকাম (ফ্যামিলি সোলানাসি) হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মশলাগুলির মধ্যে একটি। ক্যাপসিকাম দিয়ে রান্নার লাখে লাখে রেসিপি মেলে এই বিশ্বে। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মানুষই সেই একমাত্র প্রাণী যারা ঝাল লঙ্কা খেতে এত পছন্দ করে, নাকের জলে-চোখের জলে হয়েও মানুষ ঝাল খেতে ভালোবাসে। এই গ্রহের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন প্রতিদিন লঙ্কা খান। কেন এত ঝালপ্রীতি মানুষের? উত্তর জানতে খুঁড়তে হবে কলম্বাসের ইতিহাস।
১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস নয়া বিশ্বে প্রবেশ না করা পর্যন্ত লঙ্কা ব্যাপারটাই বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছে অজানা ছিল। অনেক গবেষকই বলছেন, 'যেখান থেকে লঙ্কা এসেছে'- দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশকে এখনও বিশ্ব এইভাবেই চেনে। একটি গবেষণা বলছে, পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ বরাবর একটি অঞ্চলে প্রথম ক্যাপসিকাম মেলে। এই বুনো ক্যাপসিকাম ছিল মূলত ছোট, লাল, গোলাকার, বেরির মতো ফল।
ঘরে লঙ্কা ফলানোর প্রথম প্রমাণ মেলে মেক্সিকো বা উত্তর মধ্য আমেরিকায়, ৬,০০০ বছর আগে! ১৬ শতকে ইউরোপে ক্যাপসিকামের ব্যবহার শুরু হয়। এখন মূলত পাঁচ ধরনের লঙ্কা মেলে, Capsicum annuum, C chinense, C frutescens, C baccatum এবং C pubescens। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেলে ক্যাপসিকাম অ্যানুম, যার মধ্যে রয়েছে নিউ মেক্সিকান জালেপেনো এবং বেল মরিচ। বর্তমানে, বছরে বিশ্বব্যাপী তিন মিলিয়ন টনেরও বেশি লঙ্কা উৎপাদিত হয়। তা এত ঝাল লঙ্কায় আসে কোত্থেকে?
লঙ্কায় থাকে ক্যাপসাইসিন। যখন আমরা ঝাল খাবার খাই, তখন ক্যাপসাইসিন আমাদের মুখের TRPV1 রিসেপ্টরকে উদ্দীপিত করে এবং প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। TRPV1 রিসেপ্টরগুলির উদ্দেশ্য হলো থার্মোসেপশন মানে তাপ শনাক্তকরণ। এই রিসেপ্টর সক্রিয় হলেই ঝাল খাবার থেকে আমরা নিজেদের বিরত রাখি। যখন TRPV1 রিসেপ্টরগুলিকে ক্যাপসাইসিন সক্রিয় করে ফেলে তখন আমাদের মুখে যে ধরনের সংবেদন অনুভূত হয় তা খানিকটা গরম জলে ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো। তবে এই ছ্যাঁকা আমাদের নিউরাল রিসেপ্টরগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়, ঝালের সঙ্গে আসলে গরম ছ্যাঁকার কোনও সম্পর্কই নেই।
আরও পড়ুন- লঙ্কা হইতে সাবধান! ভূত মরিচের এক কামড়েই ফুটো হতে পারে ব্রহ্মতালুও!
১৯১২ সালে, ফার্মাসিস্ট উইলবার স্কোভিল ঝালের তীব্রতা মাপার জন্য একটি স্কেল তৈরি করেছিলেন। এই স্কেলটি মূলত ঝাল খাওয়া মানুষদের ক্যাপসাইসিনয়েড সংবেদনশীলতার উপর ভিত্তি করে কাজ করে। এই স্কেল অনুযায়ী, বেল পেপার (স্কোভিল হিট ইউনিট = ০) সবচেয়ে নীচে। জালেপেনো লঙ্কা থাকে ২,৫০০ থেকে ১০,০০০-এর মধ্যে। টাবাস্কো লঙ্কা ২৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ ইউনিটের মধ্যে এবং হাবনেরো লঙ্কা থাকে ১০০,০০০ থেকে ৩৫০,০০০ এর মধ্যে।
ব্রহ্মাণ্ডে এত এত ঝাল মানুষ ছাড়া আর কেউ পছন্দ করে বলে জানা যায়নি এখনও! এমন একটিও প্রাণী নেই যে ঝাল লঙ্কা খেতে ভালোবাসে। হ্যাঁ, ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরও মানুষের মতোই রিসেপ্টর আছে কিন্তু খাবার হিসাবে ঝাল লঙ্কা ওরা এড়িয়েই চলে। তাহলে টিয়া পাখির মতো কিছু পাখি যে দিব্যি লাল লঙ্কা চিবিয়ে খায়? খায় ঠিকই কিন্তু ওরা আসলে তাপ অনুভব করতে পারে না। পাখিদের রিসেপ্টর মানুষের থেকে আলাদা এবং পাখিরা ক্যাপসাইসিনের প্রভাব বুঝতে অক্ষম। অনেক বিশেষজ্ঞর যুক্তি, মানুষ ঝাল পছন্দ করে কারণ ঝাল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ঝাল খাবার রক্তচাপ কমায় এবং এর কিছু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। ঝাল অন্যান্য ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে।
খুব ঝাল লেগে গেলে অনেকে জল খান, তাতে আসলে ঝাল কমে না কারণ ক্যাপসাইসিন হাইড্রোফোবিক, এর অণুটি জলের সঙ্গে মিলে যায় না। ঠান্ডা বিয়ারের ইথানলও ঝাল বাড়িয়ে তোলে। একমাত্র চিনিযুক্ত পানীয় ঝাল কমাতে সাহায্য করতে পারে কারণ মিষ্টির স্বাদ মূলত আমাদের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে। ফলে বেশি ঝালের তীক্ষ্ণতা কমে যায়। এক গ্লাস দুধ, কয়েক চামচ দই বা আইসক্রিম ঝাল লেগে জ্বালাপোড়া ভাবকে শান্ত করে।