মহার্ঘ নিরামিষ থালি! কেন ২.৩% ভারতীয়র দু'বেলা নিরামিষ খাবারও জোটে না?

Veg & Non-Veg Thali Price: অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য, বিশেষ করে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, একবেলা পেট ভরা সুষম খাবার এখনও নাগালের বাইরে।

সাধারণত বিশেষ কোনওদিন ছাড়া বাঙালি অন্তত বাইরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে নিরামিষ খেতে পছন্দ করে না। রোজ যে খাবার বাড়িতেই খাওয়া যায়, অতিরিক্ত দাম দিয়ে সেই নিরামিষ খাবার বাইরে খেতে পকেট চুলকায় বটেই! কারণ সাধারণ জনমানসে ধারণা হচ্ছে, নিরামিষ খাবার হচ্ছে আদতে 'সস্তা'। আমিষের জন্য বেশি খরচ করা যায়। যদিও গেরুয়া দল ঘনিষ্ঠবৃত্তে 'নিরামিষ' ভোজনকে 'মেইনস্ট্রিম' করতে চাইছে। এ তাদের নিজস্ব রাজনীতিরই অংশ। আশ্চর্যজনক এক তথ্য বলছে, সাম্প্রতিককালে নিরামিষ খাবারই মহার্ঘ হচ্ছে। এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও যোগ আছে সত্যিই? নিরামিষ খাবার অর্থাৎ সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের ভরসা। তার দাম বাড়লে মানুষের বিপদ। ২০১৯-২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এক প্লেট সাধারণ খাবারের দামের মাধ্যমে খাদ্যের ক্রয়ক্ষমতা বোঝার জন্য থালিনোমিক্স চালু করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২০ সালের মধ্যে নিরামিষ থালির গড় দাম হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ বোঝা যায়, দেশজুড়ে খাবারের নাগাল বেড়েছে মানুষের কাছে। ন্যাশনাল নিউট্রিশন ইনস্টিটিউট ভারতীয়দের জন্য ২০১১ সালে যে খাদ্যতালিকাগত নির্দেশিকা দেয়। সেই তালিকা অনুসারে, মূল থালিনোমিক্সে, একটি থালির উপাদানগুলিতে ৩০০ গ্রাম শস্য (চাল এবং গম), ১৫০ গ্রাম শাকসবজি এবং ৬০ গ্রাম ডাল (অথবা আমিষ থালির জন্য মাংস, ডিম বা মাছ) অন্তর্ভুক্ত ছিল। দামের মধ্যে রান্নার তেল, জ্বালানি (এলপিজি বা জ্বালানি কাঠ) এবং সাধারণত ব্যবহৃত মশলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি একটি সাধারণ, পুষ্টিকর খাবারের জন্য খরচের অনুমান পেতে সাহায্য করে।

২০২৩-২৪ সালের গৃহস্থালি খরচ ব্যয় সমীক্ষা (HCES) প্রকাশের পর খাদ্যের ক্রয়ক্ষমতার আরও সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছে। শুধুই দামের ভিত্তিতে নয়, একটি পরিবার পেট ভরে খেতে আসলে কতটা খরচ করতে সক্ষম তারও আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৯-২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে তিনটি মূল তথ্য জানা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন- ফসল ফলিয়েও অপুষ্টিতে ভুগছে কৃষকদের সন্তানরাই! যেভাবে লড়ছে অসমের জনজাতিরা

থালির দাম বেড়েছে

২০১৯-২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষার মূল থালিনোমিক্স থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে জাতীয় স্তরে নিরামিষ থালির দাম ২০১৫-১৬ সালে প্রায় ২৭ টাকা থেকে কমে ২০১৯-২০ সালে ২৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিপরীতে, আমিষ থালির দাম একই সময়ের মধ্যে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-২০ সালের মধ্যে তা প্রায় ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৮ টাকা। প্রতিটি রাজ্যের থালির দাম হিসেব করে দেখা হয়েছে, ২০১৯-২০ সালের জাতীয় গড়ের তুলনায়, বর্তমান দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

বর্তমানে গ্রামীণ নিরামিষ থালির দাম:

ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে ২৫-২৮ টাকা
বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশে ৩২-৩৪ টাকা
পুদুচেরি, লক্ষদ্বীপ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৪৫-৫১ টাকা

বর্তমান গ্রামীণ আমিষ থালির দাম:

উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহারে ৩৩-৩৬ টাকা
মিজোরাম, পুদুচেরি এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৫০-৫৩ টাকা

দিনে দু'বার পেট ভরা খাবারের খরচ জোগাতে পারে কারা?

ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য, ব্যক্তিপিছু প্রতিদিন (৩০ দিনের জন্য) দু'টি থালির মাসিক খরচ আর HCES-তে উল্লিখিত মাসিক মাথাপিছু খাদ্য ব্যয়ের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। একটি পরিবারের মাথাপিছু ব্যয় এই মানদণ্ডের চেয়ে কম হলে বোঝা যাবে যে সেই পরিবার রোজের খাবার জোগাড় করতে অপারগ।

যা জানা গেল:

৪.৭ শতাংশ পরিবার প্রতিদিন দু'বার আমিষ খাবারের খরচ চালাতে পারে না।

২.৩ শতাংশ পরিবার দু'বেলা নিরামিষ খাবারের খরচও চালাতে পারে না।

ঝাড়খণ্ডে, এই সংখ্যা বেড়ে ১৮ শতাংশ (আমিষ) এবং ১১ শতাংশ (আমিষ)। গ্রামীণ ঝাড়খণ্ডে, আমিষ খাবারের খরচ বইতে না পারার হার ২০.৪ শতাংশে পৌঁছেছে।

ওড়িশা, মেঘালয় এবং মণিপুরেও এই হার বেশি।

অর্থাৎ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য, বিশেষ করে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, একবেলা পেট ভরা সুষম খাবার এখনও নাগালের বাইরে। যার ফলে পূর্ব, মধ্য এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের পুষ্টির হারও কমের দিকে।

তবে সামর্থ্য থাকলেই যে পর্যাপ্ত পুষ্টি মিলবে তাও না। অর্থনৈতিক সমীক্ষার খাদ্যতালিকাগত অনুমান অনুসারে, অনেক পরিবার যারা দিনে দু'বার খাবারের খরচ বহন করতে পারে, তারা এখনও পুষ্টিকরভাবে সুষম থালি খাওয়ার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে কম খরচ করে।

ভারতীয় পরিবারের ৪৬ শতাংশ মৌলিক, পুষ্টিকর খাবারের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে কম ব্যয় করে।

ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে এই সংখ্যা ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যেও ৪০ শতাংশেরও বেশি পরিবার এই পুষ্টি ব্যয়ের সীমার নীচে পড়ে।

এটি পুষ্টি-ঘাটতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে। এমনকী যেসব পরিবার পর্যাপ্ত ক্যালোরি গ্রহণ করে তাদের ক্ষেত্রেও এই চিত্র বাস্তব।

আরও পড়ুন- দেশজুড়ে অপুষ্টি, অনাহার! দারিদ্র কমার শুকনো পরিসংখ্যান হাসি ফোটাবে ভারতীয়দের মুখে?

মূল থালিনোমিক্স বলছে খাদ্যের দাম কমেছে কিন্তু HCES এর ২০২৩-২৪-এর বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, ভারতীয় পরিবারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে খাবারের প্রাপ্তি এখনও অবাধ নয়। দাম বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতি রয়ে গেছে এবং পুষ্টির ঘাটতিও ব্যাপকহারে বাড়ছে। রেস্তোরাঁয় খরচ করে নিরামিষ খাওয়া আর রোজ বাড়িতেও সেই সামান্য নিরামিষ জোটাতে না পারা আসলে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার এক বিশাল ফাঁককে প্রকট করে।

ডাল, শাকসবজি, রান্নার তেল এবং জ্বালানির ক্রয়ক্ষমতা যা সুষম খাদ্যের কেন্দ্রবিন্দু সেই সংক্রান্ত সমস্যার বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করা প্রয়োজন। বিষয়টি নেহাতই পয়সা দিয়ে নিরামিষ খাবার খাওয়ার প্রতি অনীহার মতো সামান্য নয়। খাবারের দাম বৃদ্ধি বুঝিয়ে দিচ্ছে নাগরিকরা পর্যাপ্ত পরিমাণে, নিয়মিত খেতে পাচ্ছে কিনা। নিরামিষের দাম বাড়া বা সেই সামান্য খাবারও কিনে খেতে না পারা আখেরে ভারতের চরম বৈষম্যের দিকেই ইঙ্গিত করে।

More Articles