কখন ঘুম থেকে উঠবেন?

ঘুম থেকে ওঠার কি কোনও নির্দিষ্ট সময় আছে? ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা ভালো না খারাপ? কী হয় ঘুম পূরণ না হলে? ঘুম পূরণ না হলে কি শারীরিক অসুস্থ্যতা হতে পারে? কমে যেতে পারে আয়ু? জেনে নিন।

ছোট্টবেলা থেকে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই শুনে আসছি সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা সম্পর্কে। আমাদের আত্মীয় পরিজন, আমাদের গুরুজন, শিক্ষক, বাবা-মা প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের শিখিয়েছেন রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠতে হয়। কোনও গুরুজন আমাদের কোনওদিন বলেননি যে, 'খুব সকালে ঘুম থেকে উঠিস না। একটু বেলা অবধি ঘুমাস।'

কিন্তু কেন বলেননি? তার মানে কি এটা সত্যি যে প্রত্যেকটা মানুষের সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়া উচিত? সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার কি শুধুই উপকারিতা আছে? কোনও অপকারিতা নেই? উত্তরটা শুনলে আপনি চমকে যাবেন।

সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন সার্ভে করে এবং সেই সার্ভে গবেষণার মাধ্যমে গবেষকরা জানতে পেরেছেন কিছু  চমকে দেওয়ার মতো তথ্য। যা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার উপকারিতার দোয়ারে ধাক্কা মারে সম্পূর্ণ নতুন এক দিগন্ত নিয়ে। কিন্তু কী সেই নতুন দিগন্ত?

অপকারিতা। হ্যাঁ, গবেষকদের গবেষণায় বহু মানুষদের জীবনে ধরা পড়েছে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অপকারিতা। গবেষকরা বলছেন, প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, আলাদা তাদের কাজবাজ, জীবন ধারণের অভ্যাস, শারীরিক গঠন,  ঘুমের চাহিদা এবং ঘুমের অভ্যাস। কারোর শরীরের জন্য ৫ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট, আবার কারোর জন্য ১০ ঘন্টা ঘুমও যথেষ্ট নয়। কেউ শুলেই ঘুমিয়ে পড়ে, কারোর ঘুম আসতে সময় লাগে ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ সন্ধ্যা ৮টায় ঘুমায় আবার কারোর ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ১টা বেজে যায়। তাই এই বিভিন্ন বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন বিভিন্ন জীবন যাপনের ধরণ সার্ভে করে দেখা গ্যাছে, প্রত্যেকের জন্য আর্লি মর্নিং ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যকর তো নয়ই, উল্টে তা ক্ষতি ডেকে আনছে সংশ্লিষ্ট মানুষের জীবনে। কিন্তু কীভাবে? আসুন জেনে নেওয়া যাক -

ঘুম পূরণ না হওয়া / ঘুমের ঘাটতি :

ধরুন আপনি এমন একটা কার্য্য জীবনের সাথে জড়িত যার জন্য আপনার রাতে ঘুমাতে দেরি হয়। কিন্তু আপনি ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা ভালো ভেবে, রোজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন। এতে আপনি আপনার শরীরের স্থায়ী ক্ষতি করে ফেলছেন। এবং শুধু শরীরের নয়, কার্য্যক্ষেত্রেও ক্ষতি করছেন। যখন আমাদের ঘুম পূরণ হয় না তখন আমাদের মস্তিষ্ক নিজের পূর্ণ উপযোগীতায় কাজ করে না। এর ফলে আমরা আনমনা থাকি। চারপাশের অনেক কিছুই লক্ষ্য করতে পারি না। যার ফলে কার্যক্ষেত্রে আমাদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। উন্নতি হয় না। এ ছাড়াও ঘুমের ঘাটতি থেকে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে বিভিন্ন ধরণের রোগ। যা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকারক। একটি সাম্প্রতিক সার্ভে অনুযায়ী যারা দিনে মাত্র ৬ ঘন্টা ঘুমায় তারা, যারা দিনে ৮ ঘন্টা ঘুমায় তাদের থেকে ১২% সময় বেশি তাড়াতাড়ি মারা যান। অর্থাৎ ঘুমের ঘাটতি আপনাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। ভাবুন ভাবুন।

ক্লান্তি :
কত মানুষ আছেন যাদের রাতে ঘুম আসে না। কিংবা যাদের ঘুম আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। অথবা যাদের একটু বেশি সময় ঘুমাতে লাগে। ৭-৮ ঘন্টার ঘুম যাদের জন্য যথেষ্ট নয়, এই মানুষগুলো যখন ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা শুরু করেন তখন এদের ঘুম পূরণ না হওয়ার কারণে সারাদিন কার্য্য ক্ষেত্রে কাটে ক্লান্তিতে। ঘুমের অভাব শরীরে ডেকে আনে চূড়ান্ত ক্লান্তি। সেই ক্লান্তি অধিকাংশ সময়ই একই মানুষকে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য করে। যার ফলে আবার রাতে ঘুম আসে না। এই ভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে, তা মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।

সামাজিকতা বজায় না রাখা :
মানুষ সামাজিক প্রাণী। মানুষ নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে মিলে মিশে থাকতে ভালোবাসে। কাজের শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, কিংবা পরিবারের সাথে সিনেমা দেখা, অথবা নিজের জন্য একটা গল্প বই, ফেসবুক স্ক্রল করা, লেট নাইট পার্টি ইত্যাদি চলতেই থাকে। কিন্তু একটা মানুষের মাথায় যখন তাড়া থাকে যে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে হবে, তখন সে কাজ শেষ করে বাড়িতে এসে আর অন্য কিছুর জন্যই সময় বার করতে পারে না। রাতের খাবার খেয়ে সে চায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে, যাতে পরের দিন ভোরবেলা সে সময়ে উঠতে পারে। এর ফলে কাছের মানুষের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। কাজের জন্য যেমন সময় রাখা উচিত তেমন কাজের শেষে সম্পর্কের জন্যেও সময় রাখা উচিত।  দিনের পর দিন সম্পর্ককে অবহেলা করলে, সময় না দিলে, একটা সময় পর সবাই দূরে চলে যায়। এবং সেই মানুষটা একলা হয়ে পরে। যা তার মানসিক জীবনের জন্য প্রচন্ড ক্ষতিকারক।

স্বাস্থ্যের বিপদ :
ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্ট মিনস্টারের একটা সার্ভে অনুযায়ী যারা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেন তাদের মধ্যে স্ট্রেস লেবেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সার্ভে থেকে আরও জানা যায় যারা সকাল ৭টার আগে ঘুম থেকে উঠছিলেন তাদের শরীরের মধ্যে স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি যারা সকালে আরেকটু বেশি ঘুমাচ্ছিলেন তাদের থেকে। যে সমস্ত মানুষ সব সময় খুব চাপে থাকেন তারা ভবিষ্যতে মাইগ্রেন, মুড সুইং, মাংস পেশির যন্ত্রণায় ভুগতে পারেন বলেও এই সার্ভে থেকে জানা যায়।

নিজের শরীরের বিরুদ্ধে লড়াই :
প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, আলাদা তাদের জীবনধারণ, তাদের শারীরিক গঠন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রাত প্যাঁচা, আবার কেউ কেউ ভোরের আলো ফুটতে দেখে গান করা কোকিল। আমাদের শরীরে উপস্থিত জিন আমাদের স্বাভাবিক ভাবেই এরকম বানিয়েছে। ধরুন আপনি রাত পেঁচা, কিছুতেই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারেন না, অথচ রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চলেছেন শুধু এটা ভেবে যে ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা ভালো। তারপর সারাদিন ক্লান্তিতে কাটাচ্ছেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে আপনি পটল খেতে পারেন না জানার পরেও রোজ জোর করে পটল খাচ্ছেন পটল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ভেবে এবং বমি করছেন। এতে আপনারই ক্ষতি হচ্ছে। না পেট ভরছে, না পুষ্টি পাচ্ছেন। আপনি নিজের শরীরের বিরুদ্ধে নিজেই লড়াই শুরু করে দিয়েছেন নিজের অজান্তেই। যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভবিষ্যতে ক্ষতিকারক।

সবসময় মনে রাখবেন এই পৃথিবীতে নির্দিষ্ট বলে যা যা বস্তু আছে তার বেশিরভাগটাই প্রাকৃতিক। সূর্য আজন্ম পূর্বে উঠে পশ্চিমেই অস্ত যাবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার এমন কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। নিজের শরীরকে বুঝুন। যদি আপনার কার্যক্ষমতা একটু বেশি ঘুমালে বৃদ্ধি পায়, তবে বেশি ঘুমান। যদি আপনার রাতে ঘুম না আসে সহজে, তবে একটু দেরি করে উঠুন সকালে। মোদ্দা কথা নিজের ঘুম পূরণ করুন। সেটা যদি ভোর ৫টায় উঠে পূরণ হয় তবে ভোরে উঠুন। আর যদি সকাল ৯টায় উঠে ঘুম পূরণ হয় তবে তাই উঠুন। আগে শরীরকে বুঝুন। সে যা চায়, তার যা ধরণ, সেভাবেই চলুন। ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

তথ্যসূত্রঃ

More Articles