হাই কোর্টে ফের মুখ পুড়ল রাজ‍্যের! কেন বিতর্ক সোনালি চক্রবর্তীকে নিয়ে?

Sonali Chakrabarty: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে সোনালি চক্রবর্তীকে সরানো নিয়ে হাই কোর্টে আবার মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের।

করোনা হোক কিংবা এসএসসি। বারবার হাই কোর্টে মুখ পুড়েছে রাজ্য সরকারের। এসএসসি কেলেঙ্কারি নিয়ে বারবার রাজ্য সরকারকে জেরবার হতে হয়েছে উচ্চ আদালতে। রাজ্য সরকারি কর্মীরা ডিএ না পাওয়ায় সেই মামলাও গড়ায় হাই কোর্টে। এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে সোনালি চক্রবর্তীকে সরানো নিয়ে হাই কোর্টে আবার মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের।

সোনালি চক্রবর্তীকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট। একই সঙ্গে তাঁর পুনর্নিয়োগের সিদ্ধান্তও খারিজ করল প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী সোনালি। তাঁকে পুনর্নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে সোনালি চক্রবর্তীর নিয়োগ ইউজিসি-র নিয়ম মেনে হয়নি বলে এই অভিযোগে আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলা (PIL) দায়ের হয়। ১২ জুলাই এই মামলার শুনানির পর রায়দান স্থগিত ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর সেই মামলায় কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্যের পুনরায় নিয়োগের সিদ্ধান্তকে খারিজ করে। একই সঙ্গে আদলতের পর্যবেক্ষণ, রাজ্য সরকারের উপাচার্য নিয়োগের কোনও এক্তিয়ার নেই। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য যেতে পারে বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন: পথকুকুরের দায়িত্ব নিলেই বাড়তি চাপ! সুপ্রিম মন্তব্যে তীব্র আলোড়ন শহরের পশুপ্রেমীদের মধ্যে

কেন অপসারণ
২০২১ সালের ২৭ অগাস্ট সোনালি চক্রবর্তীকে পুনরায় উপাচার্য পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সিদ্ধান্ত খারিজ করল কলকাতা হাই কোর্ট। এর ফলে সোনালি ওই পদে থাকতে পারবেন না। হাই কোর্টের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের এক্তিয়ার নেই উপাচার্য নিয়োগের। ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করেছিল রাজ্য সরকার। সেই সময়ে রাজ্যপাল তথা আচার্য জগদীপ ধনকড় এই নিয়োগে অনুমতি দেননি। রাজভবনের সিলমোহর ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ করেছিল রাজ্য সরকার। এরপরই হাই কোর্টে যে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে বলা হয়েছিল, এই নিয়োগ বেআইনি। রাজভবনকে এড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করার অর্থ সাংবিধানিক পদ, প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি অস্বীকার করা। মামলাকারীর আবেদনে উল্লেখ করা হয়, একটা গণতান্ত্রিক দেশের রাজ্য সরকার যদি সাংবিধানিক বিধিকে লঙ্ঘন করে, রাজ্যপাল তথা রাজভবনকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাথায় পছন্দের লোক বসায়, তাহলে সেখানে সংকট অনিবার্য।

এই নিয়ে দীর্ঘ শুনানি হয় কলকাতা হাই কোর্টে। এরপর ১৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চ সোনালি চক্রবর্তীর নিয়োগকে খারিজ করে দিল। আদালত স্পষ্ট করেই বলেছে, এইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় পছন্দের লোক বসানো যায় না।

সোনালি চক্রবর্তী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপিকা। ২০১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অস্থায়ী উপাচার্য সুরঞ্জন দাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দিলে সেই শূন্যপদে সোনালি চক্রবর্তীকে স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সোনালি চক্রবর্তী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কন্যা এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বামী। বিখ্যাত পরিবারের উত্তরাধিকারী এবং স্বামী প্রভাবশালী হওয়ার কারণেই কি তিনি রাজ্য সরকারের পছন্দের লোক হয়ে ওঠেন? এত করেও 'রাজ্য সরকারের পছন্দের' সোনালির পদ টিকল না। তাঁকে অপসৃত হতেই হলো।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সোনালির কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর। ২৭ অগাস্ট তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে পুনর্নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। সেইমতো তিনি কাজ শুরু করেন। তবে তাঁর নিয়োগ নিয়ে হাই কোর্টে মামলা দায়ের হয়। মামলায় বলা হয়েছিল, এই নিয়োগ বেআইনি। অনেক শুনানির পর প্রধান বিচারপতি তাঁর নিয়োগ খারিজ করে দেন।

রাজ্যের যুক্তি
হাই কোর্টের নির্দেশ জারির পর এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে সরতে হবে সোনালি চক্রবর্তীকে। তবে রাজ্য সরকার এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে। রাজ্যের যুক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজকর্ম ভালোভাবে চালানোর জন্যই সোনালিকে ওই পদে পুনর্নিয়োগ করা হয়েছিল। এটা কোনও পক্ষপাতিত্ব নয়। প্রশ্ন হলো, তাঁর ব্যক্তি-পরিচয় কি এক্ষেত্রে কোনও প্রভাব বিস্তার করেনি? এদিকে শিক্ষা দফতর-সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাজ্যের আরও ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একইভাবে বহাল রেখেছে উচ্চশিক্ষা দফতর। অর্থাৎ, পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে আরও পাঁচ বছরের জন্য বহাল রাখা হয়েছে। এই তালিকায় যেমন রয়েছে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি- তেমনই রয়েছেন রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্যও। সোনালি চক্রবর্তীর মামলার রায়কে হাতিয়ার করে কেউ বাকিদের নিয়োগ নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করলে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের বক্তব্য, জুলাই মাসে মামলার শুনানিতে রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সোনালি চক্রবর্তীর নিয়োগের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, "কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী নিয়োগ এবং পুনর্নিয়োগ আলাদা ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (University Grants Commission, UGC) নীতি অথবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী নিয়োগ করা যায়।" তিনি জানান, উপাচার্য পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের ক্ষমতা একইরকম নয়। এ-বিষয়ে রাজ্যের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে হয় রাজ্যপালকে। বিশ্ববিদ্যালয় সেনেট ও মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে উপাচার্যকে নিয়োগ করতে পারেন রাজ্যপাল।

মামলাকারীর আইনজীবীর যুক্তি
উপাচার্য পুনর্নিয়োগের বিরোধিতা করেন মামলাকারী অনিন্দ্যসুন্দর দাস। তাঁর আইনজীবী বিল্বদল ভট্টাচার্য জানান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আইন অনুযায়ী রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাজ্যপাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা রাজ্যপালেরই। রাজ্যপালের সম্মতি না নিয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা যায় না। সোনালি চক্রবর্তী নিয়োগের ব্যাপারে তৎকালীন রাজ্যপালকে কিছুই জানানো হয়নি৷ প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চ দু'পক্ষের বক্তব্য শুনে দীর্ঘদিন রায়দান স্থগিত রেখেছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয়, সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়োগ আইন স‌ংগত হয়নি। তাই তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে সরানো হোক। তাহলে এবারও পুনর্মূষিক ভবঃ, আদালতে মুখরক্ষা হলো না রাজ্যের।

More Articles