বাংলা সিরিয়ালের তিন দশক || কী ছিল কী হইল...

এখন এক দিনের এপিসোড মিস হলে তা পরক্ষনেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এসে যায়, শুধু আসে না নব্বই দশকের সেই সন্ধ্যেবেলাগুলো, কিছু বিখ্যাত বাংলা সিরিয়ালের সাধারণ অথচ রিয়্যালিস্টিক এপিসোডগুলো।

নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম আর স্মার্টফোন এই নিয়েই এখন জগৎ আমাদের। এককালে বেশি টিভি দেখা নিয়ে বকা খওয়া ছিল সদ্যযুবাদের রোজের অভ্য়েস। সেই বোকাবাক্সই আজ নাম লিখিয়েছে বাতিলের খাতায়। তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে স্মার্টফোন আর নয়তো ল্যাপটপ। আজকের এই ঝকঝকে ফ্ল্যামিলি ড্রামা থুড়ি সিরিয়াল, অতিরঞ্জিত শো সিরিজ নব্বই দশকের সেই পুরানো সিরিয়ালগুলিকে এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দিতে সক্ষম হলেও সেই আবেগ তৈরি করতে অক্ষম। এখন এক দিনের এপিসোড মিস হলে তা পরক্ষনেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এসে যায়, শুধু আসে না নব্বই দশকের সেই সন্ধ্যেবেলাগুলো, কিছু বিখ্যাত বাংলা সিরিয়ালের সাধারণ অথচ রিয়্যালিস্টিক এপিসোডগুলো।

সামান্য উপাদান, বাস্তবতা দিয়ে তৈরি তখনকার সিরিয়ালগুলোর প্রত্যেকটির গল্পও অন্যটি থেকে ভিন্ন ছিল। আজকের মতো সবই গিয়ে সেই অবৈধ সম্পর্কের ঘোর প্যাঁচে আটকে যেত না। কিন্তু সময় যেমন মানুষের থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয়, তেমনি আবার সময়ই পরিস্থিতির চাপে তা ফিরিয়ে দেয় কখনও কখনও। আর তারই প্রমাণ হল করোনার অতিমারীতে ফিরে আসা হারিয়ে যাওয়া নস্টালজিয়াগুলো। দু'বছর ঘরবন্দি থাকতে থাকতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সব ওয়েব সিরিজ প্রায় দেখে নেওয়ার পরে সবাই যখন ভাবছিল আর কি দেখা যায় তখনই উপায় হিসাবে হাজির হয় কিছু বিখ্যাত পুরানো সিরিয়াল যা আজ নব্বই দশকের দর্শকদের মনে জায়গা দখল করে আছে। করোনা কালে শ্যুটিং বন্ধ থাকার দরুন পুরানো সিরিয়ালের পুনঃসম্প্রচার
শুরু করে চ্যানেল কর্তৃপক্ষরা। ব্যাস, সাধারণ মানুষ ফিরে পেল তাদের নস্টালজিয়াকে।

তখন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত একটার পর একটা টানা সিরিয়াল হত না। ছিল অল্প কিছু চ্যানেল আর তাতে সম্প্রচারিত হওয়া অল্প কিছু সিরিয়াল, সিরিজ ও শো। কলকাতায় ১৯৯৫-২০০০ সালের মধ্যে প্রায় সবার ঘরেই তখন মোটামুটি টিভি এসে গেছে। বিকেলবেলা থেকেই শোনা যেত কিছু বিখ্যাত বিখায় শোএর মিউজিক। ছিল রোজগেরে গিন্নি, এক আকাশের নীচে, জন্মভূমি, তেরো পার্বন ইত্যাদি সিরিয়ালগুলো। হিন্দি অনেক সিরিয়াল তখন হলেও বাংলাতে তখন বাংলা শো-এর কদরই বেশি ছিল। একটু ঢুঁ মেরে আসা যাক পুরানো সেই দিনের টি.ভির পর্দায়, আলোচনা করা যাক সেই কিছু বিখ্যাত সিরিয়াল নিয়ে যা আজও সাধারণ মানুষের ভালো লাগার লিস্টে আছে।

তেরো পার্বন

১৯৯৭ সালে তেরো পার্বন সিরিয়ালটি ছিল বেশ জনপ্রিয় বা বলা ভালো এই সিরিয়ালের হাত ধরেই বাংলা টেলিভিশনের ইতিহাসে এক নতুন যুগ আসে। এই ধারাবাহিকের পরিচালক ছিলেন জোছন দস্তিদার। অনেক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী যথা সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইন্দ্রাণী হালদার-এর অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল এই সিরিয়াল থেকেই।

জন্মভূমি

জন্মভূমি ছিল বাংলা সিরিয়ালের ইতিহাসে সবথেকে দীর্ঘ সম্প্রচারিত হওয়া সিরিয়াল। ১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই সিরিয়াল। সিরিয়ালের পরিচালক ছিলেন ইন্দর সেন, ডিডি বাংলায় দেখান হত সিরিয়ালটি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন রুপা গঙ্গোপাধ্যায়, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, সুমন বন্দোপাধ্যায়, জয়জিৎ বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যাক্তিদের অভিনয় জীবনের
বড় ধাপ ছিল এই সিরিয়াল বা বলা ভালো লঞ্চপ্যাড ছিল এই ধারাবাহিক। সন্ধ্যে হলেই বেশির ভাগ বাড়ি থেকে ভেসে আসত জন্মভূমির টাইটেল ট্র্যাকের মিউজিক। টানা পাঁচ বছর ধরে এই সিরিয়াল চললেও জনপ্রিয়তায় কখনও ভাঁটা পরেনি।

রোজগেরে গিন্নি

রোজগেরে গিন্নির কথা ভুলে গেলে কী করে হবে? প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল এই রিয়্যালিটি শো। ই-টিভি বাংলাতে বিকেলবেলা করে সম্প্রচারিত হত এই শো। গৃহিণীদের নিয়েই এই রোজগেরে গিন্নি হত। থাকত বিভিন্ন গেম, জিতলে থাকত অর্থ জয়ের সুযোগ। তিনজন সঞ্চালিকা এই শো কে সঞ্চালনা করেছেন যথা- পরমা ব্যানার্জী, মধুমন্তী মৈত্র, লাজবন্তী। রোজগেরে গিন্নি রিয়্যালিটি শো হলেও এখনকার শো এর সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ। আজকের দিনের শোএর মত এতটা অতিরঞ্জিত ছিল না, ছিল না এত স্টেজ, আলোর ঝলকানি, শুধু ছিল সামান্য উপকরণ দিয়ে মন জয় করে নেওয়ার ক্ষমতা।

এক আকাশের নীচে

নব্বই দশকের দর্শক আর এক আকাশের নীচে ধারাবাহিকের ভক্ত ছিল না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। রজতাভ দত্ত, শ্বাশত চ্যাটার্জী, দেবলীনা দত্ত, মনামী, কনীনিকা ব্যানার্জী, কৌশিক সেন ও প্রমুখ জনপ্রিয় তারকাদের ভিড়ে ফুল প্যাক-আপ ছিল এই সিরিয়াল। রবি ওঝা ছিলেন এই সিরিয়ালের পরিচালক। সম্প্রচারিত হত জি বাংলায়। একই আকাশের তলায় থাকা বিভিন্ন মানুষের জীবনের হাসি, কান্না, দুঃখের গল্পও বলত এই সিরিয়াল। প্রাইভেট চ্যানেলের যুগে এত সিরিয়াল থাকা স্বত্ত্বেও ‘এক
আকাশের নীচে-র জনপ্রিয়তা কেউ এখনও ছুঁতে পারেনি। ধারাবাহিকের পুনঃপ্রচার আর ইউটিউবে কয়েক লাখ ভিউস দেখেই তা বোঝা যায়। এই সিরিয়ালের অভিনীত অনেক তারকাই বলেন যে আজকে তাদের জনপ্রিয়তার পিছনে অন্যতম অবদান এই সিরিয়ালের।

শুধু তোমারই জন্য

না, এটা দেব শ্রাবন্তী সিনেমা না, এই টেলিফিল্মের সিরিজটি হত ই টিভি বাংলাতে। শ্রাবন্তী চ্যাটার্জী, সায়ন্তনী ঘোষ, অপরাজিতা আঢ্য, পরমব্রত, যীশু সেনগুপ্ত প্রমুখ অভিনেতা এই সিরিজে অভিনয় করেছেন। শ্রাবন্তী, পরমব্রতর টিনেজ জুটি হিট ছিল এই সিরিজে। শনিবার করে সম্প্রচারিত হত এই শো। নব্বই দশকের মানুষদের কাছে এই শো এর আজও সেই পুরান দিনের দুপুরকে ফিরিয়ে আনে। আজ এত সিরিজের মাঝে সাতচল্লিশ মিনিটের এই আবেগ, ভালোলাগার অনুভুতিকে আর কেউ তৈরি করতে পারেনি।

সোনার হরিণ

ই-টিভি বাংলায় জনপ্রিয় সিরিয়াল ছিল সোনার হরিণ। সমতা দাস, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম ছিল এই সিরিয়ালের কাস্টিং-এ। দর্শকদের মনের খুব কাছের ছিল এই ধারাবাহিক। লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন এই সিরিয়ালের লেখিকা, তাঁর লেখার বুননে এই সিরিয়াল কিন্তু বিশাল জনপ্রিয় হয়েছিল। একটি সাধারণ মেয়ের জীবনের লড়াইয়ের গল্পও বলেছিল এই ধারাবাহিক।

বলতে দ্বিধা নেই,  এই সময়কালের প্রত্যেকটি সিরিয়ালের সাধারণ ঘরোয়া উপস্থাপনা দর্শকদের স্পর্শ করেছিল। এতটা বাস্তবভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পও আজ আর কেউই দেখায় না। তাই আজও এই সিরিয়ালগুলোর ক্রেজ আকাশছোঁয়া। এখনকার মতো একটা সিরিয়ালের পেছনে লেগে থাকত না অন্য সিরিয়ালের লাইন, যে কয়টা ধারাবাহিক সম্প্রচার হতো, প্রত্যেকটির মধ্যে ছিল সামঞ্জস্য। আজ টিভি খুললেই প্রাইভেট চ্যানেলের রাজত্ব, নেই ডিডি বাংলা, নেই ইটিভি বাংলা। সিরিয়াল তো প্রচুর হয়। কিন্তু তাঁর সঙ্গে বাস্তবতার মিল কই? দর্শকদের মানসিকতাও যেন সিরিয়ালের কুচুটেপনা আর ষড়যন্ত্রের প্যাঁচে আটকে গেছে। সিরিয়ালের চরিত্ররা হয় বড়লোক, নয় গরিব, হয় শত্রু নয় মিত্র। সবটাই দুইয়ে দুইয়ে চার। ভাবনার জন্যে এক চিলতে কোনো কোণ নেই।

ফিকশন, নন-ফিকশন গল্পে বুঁদ সবাই, লার্জার দ্যান লাইফ করে সব কিছু দেখানোর প্রচেষ্টা ফেসবুক আবিষ্ট স্বল্প মনযোগী দর্শকদের আকৃষ্ট করে বেশি। ৯০ দশকের সিরিয়ালের সেই টাইটেল ট্র্যাক, বিখ্যাত বিখ্যাত গীতিকারদের গাওয়া গান আজ হারিয়ে গেছে সিরিয়ালের ধুম তানানা ব্য়াকগ্রাউন্ড মিউজিকে।

করোনা আসার আগে অবশ্য এই সিরিয়ালগুলোর কথা আমাদের মনেও ছিল না, ভুলেই গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ। কিন্তু অতিমারীর এই বন্দিদশা ও অফুরন্ত সময় ফিরিয়ে এনেছে এই নস্টালজিয়াগুলোকে। নাভিশ্বাস গতির এই যুগে, একটা সিরিজ শেষ হতে না হতেই আর একটা সিরিজের হাতছানি,ব্যস্ত জীবনের মধ্যে এই পুরানো শো, ধারাবাহিকগুলো যেন অসময়ে প্রাণভরে একটিবার শ্বাস নিতে জানলা খুলে দেয়।

More Articles