জলবায়ু সঙ্কটে জনশূন্য গ্রাম! একাকিত্ব যেভাবে গ্রাস করছে পুরুলিয়ার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের
Purulia Climate Crisis and Migration: বছরের পর বছর আবহাওয়ার পরিবর্তন আর চাষাবাদে আয়ের ঘাটতি— পুরুলিয়ার মানুষদের পরিযায়ী শ্রমিক করে তুলছে, এটাই যেন এখন তাঁদের স্থায়ী সমাধান।
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার চাতরমহুল গ্রামে ৮৫ বছরের শকুন্তলা রাজওয়ার শুয়ে আছেন মাটির দেয়ালঘেরা একটি অন্ধকার ঘরের চাটাইয়ের উপর। সূর্যের আলো সেখানে ঢোকে না, আর পাশের গোরুর খোঁয়াড় থেকে ভিজে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে।
তাঁর দুই ছেলে— রাজেন (৬২) ও কার্তিক (৬০), গত এক দশক ধরে ওড়িশায় দৈনিক মজুরের কাজ করেন। তাঁরা কেবল ধান কাটার মরসুমে বাড়ি ফেরেন। ছেলের স্ত্রীদের পক্ষে যতটা সম্ভব হয় দেখভাল করেন বৃদ্ধাকে। কষ্ট করে উঠে বসতে বসতে শকুন্তলা বললেন,
“এখানে খুব গরম লাগে, কিন্তু কিছু করার নেই”।
তাঁর এখনও মনে আছে ছেলের প্রথম ঘর ছাড়ার কথা। তিনি বলেন,
“আমি কেন তাকে আটকাছিলাম জানি না? সবাই চলে যাচ্ছিল। আমরা গরিব মানুষ, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করতে হয়। আমি কীই বা বলতে পারতাম? ভেবেছিলাম, অন্তত ছোট ছেলে আর বউমারা থাকবেই।”
তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৩।
বছরের পর বছর আবহাওয়ার পরিবর্তন আর চাষাবাদে আয়ের ঘাটতি— পুরুলিয়ার মানুষদের পরিযায়ী শ্রমিক করে তুলছে, এটাই যেন এখন তাঁদের স্থায়ী সমাধান। বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার পরিবর্তন ও কৃষিজ আয় কমে যাওয়ায় পুরুলিয়ার বাসিন্দাদের স্থায়ী জীবনযাপন অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে।
এই বছর জুন মাসে পুরুলিয়ায় প্রবল বৃষ্টি হয় এতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে আমন ধান; এই অঞ্চলের মানুষদের প্রধান ফসল এটিই। জুন থেকে অগাস্টের মধ্যে বোনা হয় এবং শীতকালে কাটা হয় আমন ধান। এই ফসলের জন্য দরকার নিয়মিত বৃষ্টি। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই কৃষকেরা প্রতিকূল আবহাওয়ার সম্মুখীন হচ্ছেন। কখনও খরায় চারা শুকিয়ে যায়; আবার কখনও আকস্মিক বন্যায় সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাজেনের ছোট জমিটিও এ বছর ডুবে গিয়েছে।
আগে তিনি পুরুলিয়ার মধ্যেই শ্রমিক হিসেব কাজ করতেন। কিন্তু একফসলি কৃষিনির্ভর এই জেলায় ফসলের বারবার ক্ষতির ফলে কাজের সুযোগও কমে গিয়েছে। রাজেন বলেন,
“এখানে এখন চাষ করা মানে জুয়া খেলা। গত বছর বৃষ্টির অভাবে চারা মরে গিয়েছিল, আর এ বছর সবকিছু ডুবে গেল।”
বারবার ক্ষতির পর নতুন করে চাষ করার সামর্থ্য এখন খুব কম মানুষেরই আছে। ফলে রাজওয়ারের মতো পরিবারগুলির জন্য একমাত্র উপায় অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেওয়া।
পুরুলিয়ায় শুধু রয়ে গিয়েছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, কেউ পরিচিত গ্রাম ছেড়ে যেতে চান না, আবার কেউ চলাফেরার অসুবিধার কারণে যেতে পারেন না, কারণ তাতে তাঁরা পরিবারের উপর বোঝা হয়ে উঠবেন।

অপুষ্টিতে ভোগা পুরুলিয়ার বয়স্ক মহিলারা (ছবি: জয়মালা বাগচী)
পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনযাত্রা
পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকরা বছরে একবারই ফেরেন— ধান কাটার মোরসুমে, অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। রাজেন আর কার্তিকও তখন ফিরে আসেন, নিজেদের জমিতে কাজ করার পাশাপাশি অন্যের জমিতে দিনমজুরির কাজ করেন, প্রতিদিন মজুরি পান ২৫০ টাকা করে। তবে ফসল ভালো না হলে সেটাও লাভজনক হয় না।
পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের কেতলাপুর গ্রামে থাকেন ৫০ বছর বয়সি মনি বড়্যাকার। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এখন স্বামীর সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করেন। যেদিন কাজ পান না, সেদিন খাওয়াও জোটে না।
গলায় ফুলে ওঠা একটি গাঁট নিয়ে শুকনো চেহারার মনি বললেন,
“আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে কে? দুই মেয়েই তো এখন সংসার করছে।”

মনি বড়্যাকার গলায় ফুলে ওঠা গাঁটের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা করাননি (ছবি: জয়মালা বাগচী)
মনি ও তাঁর স্বামী সেইসব মানুষদের প্রতিনিধি, যাঁরা বয়স ও শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে আর অন্যত্র কাজের খোঁজে যেতে পারেন না। তিনি বলেন, “যদি কম বয়স হত, তাহলে হয়ত চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন যেতেও ইচ্ছে করে না। যাবই বা কোথায়? সারাজীবন এখানেই থেকেছি। অন্তত এখানে নিজের ঘর আছে, গ্রামবাসীদের চিনি, বিপদে কিছু না কিছু জোটে। অন্য জায়গায় কে কাজ দেবে এখন? দীর্ঘক্ষণ কাজ করতেও আর পারি না।”
মনির মতো গল্প পুরুলিয়ার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই শোনা যায়। খরাপ্রবণ এই জেলা গরমে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভাসছে, আবার শীতে কাঁপছে। জলের অভাব সর্বত্র।
বেসরকারি সংস্থা ‘SwitchON Foundation’-এর এক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতি বছর পুরুলিয়ায় ৩০ থেকে ৪৪ দিন গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা ৪০°C বা তার বেশি ছিল। ১৯৬৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পুরুলিয়া জেলায় মোট ১১৭ দিন ভয়াবহ তাপপ্রবাহর কথা উল্লেখ রয়েছে ওই রিপোর্টে। ২০২৪ সালের মে মাসে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৪৫°C-এর উপরে।
২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৭%। ২০১৭ সালে ভয়াবহ খরার পরে প্রায় ২.৮ লক্ষ হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে। পুরুলিয়ার মোট আবাদি জমির ৮৩% খরিফ ধানের উপর নির্ভরশীল, আর বহুফসলি জমি মাত্র ১৫%। ফলে অনিয়মিত বর্ষা, সীমিত সেচব্যবস্থা ও কম সারপ্রয়োগের কারণে ফলন ক্রমশ কমে যাচ্ছে, আর গ্রামীণ সংকট বাড়ছে।
পুরুলিয়ার প্রায় ৮৭% মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করেন, এবং তাঁরা প্রতিদিনই লড়ছেন জলবায়ুর এই চাপ ও ঝুঁকির সঙ্গে।
দুই দশক ধরে পুরুলিয়া থেকে শ্রমিকদের অন্য রাজ্যে যাওয়া চলছিলই, তবে গত ছয়-সাত বছরে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। আগে শুধু পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই কাজের খোঁজে বাইরে যেতেন। এখন দেখা যাচ্ছে, পুরো পরিবার, মহিলা-সহ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামে রয়ে যাচ্ছেন শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।

পুরুলিয়া জেলার বেশিরভাগ নলেই অনেকটা পরিমান আয়রন থাকে (ছবি: জয়মালা বাগচী)
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের জনগণনায় মূল কর্মরত শ্রেণি ছিল ২৫.৪৩ %, যা ২০১১ সালে নেমে আসে ২০.৯৩ %-এ। অন্যদিকে, আংশিক কর্মরত শ্রেণি বেড়েছে ১৯.০৩ % থেকে ২১.৭১ %-এ। অনেক চাষি পেশা বদলে অন্য কাজের জন্য চলে গিয়েছেন।
এই প্রতিবেদক পুরুলিয়ার আটটি গ্রাম (উকা, আল্লাদিহ, দানদুয়া, শ্বেতপলাশ, সালতোরা, রতনপুর, কেতলাপুর ও চতর্মাহুল) ঘুরে প্রায় ১৮-২০টি পরিবারে গিয়েছিলেন। দেখা যায়, অন্তত ১৭টি ঘরেই শুধু বৃদ্ধ মানুষরা রয়েছেন।
কেন এখন গ্রাম জনশূন্য?
চতর্মাহুল গ্রামের ৭০ বছরের এক মহিলা রাজওয়ার বলেন, তিনি মাসে ১,০০০ টাকার ভাতা ও গোবরের উপলা বিক্রি করে বেঁচে আছেন। তাঁর খাবার বলতে সাধারণত ভাত আর আলু। তিনি বলেন, “আমি একাই থাকি। অসুস্থ হলে গ্রামবাসীরা সাহায্য করে”। তাঁর ছেলেও বাধ্য হন গ্রাম ছাড়তে।
উকা গ্রামের ৫৯ বছর বয়সি শম্ভু, একাই থাকেন তাঁর মাটির ঘরে। তাঁর একমাত্র ছেলে প্রায় ছয় বছর আগে হায়দরাবাদে কাজের জন্য গিয়েছে, বছরে একবার ছৌ নাচ উৎসবে বাড়ি ফেরে। শম্ভু বলেন,
“দু’বছর আগে ছেলে বলেছিল, সঙ্গে যাব কি না। আমি না বলেছিলাম। কেন যাব এমন জায়গায় যেখানে আমার কাউকে চিনি না? গরিব মানুষ তো সব জায়গাতেই গরিবই।”
দারিদ্র্যপীড়িত পুরুলিয়ায় একা বৃদ্ধদের জীবন এখন প্রতিদিনের লড়াই। অনেকেই ভাতা, ছেলেদের পাঠানো সামান্য টাকা বা প্রতিবেশীদের সহায়তার উপর নির্ভর করেন। পুষ্টিকর খাবার তাঁদের কাছে বিলাসিতা, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকাই তাঁদের জীবন। একাকীত্ব এই কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
কেতলাপুর গ্রামের ৬০ বছর বয়সি গোপাল বড়্যাকার তিন বছর ধরে শারীরিকভাবে অক্ষম। হাত তুলতে বা সোজা হাঁটতেও পারেন না। দুই ছেলে অনেক আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে—একজন ঝাড়খণ্ডে, অন্যজন বেঙ্গালুরুতে। বড় ছেলে মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পাঠায়, আর এক ভাইপো দুপুরে একবেলা খাবার দেয়। রাতে দোকান থেকে কেনা বিস্কুট খেয়েই কাটান গোপাল।
তিনি বলেন,
“এখন খুব একা লাগে। কাজ করতে পারি না। ভাইজি একটু ভাত দেয়, ওটাই আমার খাবার। ছেলেদের সঙ্গে থাকতে চাই, কিন্তু ওরা নিতে চায় না, খরচ বেশি বলে। মাঝে মাঝে আসে, তারপর চলে যায়। আমার এখন একটাই চাওয়া—পেট ভরে একবেলা খাওয়া।”
অন্যদিকে, যারা কাজের জন্য বাইরে গিয়েছেন, তাঁরাও বিপাকে। পঞ্জাবে কাজ করা এক শ্রমিক বলেন,
“আমার বাবা-মা একা থাকে। ওদের ফোন নেই, অনলাইনে টাকাও পাঠাতে পারে না। কেউ কেউ প্রতিবেশীদের হাতে নগদ টাকা পাঠাতেও রাজি হন না। এখনকার অনলাইন ব্যবস্থা নিরাপদ, কিন্তু আমাদের মতো লোকদের পক্ষে তা সম্ভব নয়।”

গোপাল বড়্যাকার তাঁর বাড়ির সামনে (ছবি: জয়মালা বাগচী)
সবই একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত
পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সুপেন হেমব্রম বলেন,
“জলবায়ু বদলাচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের উপার্জনের পথও। সবকিছুই একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত।”
সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গৌতম মুখার্জি জানান,
“দেরিতে বর্ষা আসা আর শিল্প কমে যাওয়ার কারণে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। আগে বর্ষা জুনে আসত, এখন অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের আগে আসে না। ফলে একফসলি জমিরও ক্ষতি হচ্ছে, মানুষ বাধ্য হয়ে বাইরে চলে যাচ্ছেন। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পও কমছে, ফলে চাকরির সুযোগও হ্রাস পাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন,
“অনেক যুবক জীবিকার জন্য গ্রাম ছাড়ছে, আর তাঁদের বাবা-মায়েরা একা হয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই একাকীত্বে মারা যাচ্ছেন।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এমন চাকরি বা কাজের ব্যবস্থা না করা যায়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতেও টিকে থাকতে পারে; তাহলে পুরুলিয়ায় এই অভিবাসন চলতেই থাকবে। আর তার সঙ্গে বাড়বে একাকী বৃদ্ধদের সংখ্যা— যারা নিঃশব্দে, একলা লড়ছেন জীবনের সঙ্গে।
মূল প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ভাবে 101 Reporters-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সংবাদ মাধ্যমের অনুমতিক্রমে প্রতিবেদনটি অনুবাদ আকারে ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত হলো।
(অনুবাদ: তনভিয়া বড়ুয়া)
Whatsapp
