ভিড় রাস্তা, পুরনো সিঁড়ি ও নীল সমুদ্রের শহর দুবরোভনিক
Dubrovnik Tour : প্রায় গোটা পথটা বাস চলবে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের বিখ্যাত ডালমেশিয়ান উপকূলের গা ঘেঁষে। নানারকম নীল আর সবুজের মাখামাখি জলের উপরে, আর ছোট-ছোট দ্বীপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সমুদ্রের সর্বাঙ্গে।
জাগ্রেব থেকে দুবরোভনিক লম্বা পথ। বাসে করে প্রায় ঘণ্টা আটেক লাগে। তবু ইচ্ছে করেই বাসে যাওয়া ঠিক করেছি। কারণ খুব সহজ। প্রায় গোটা পথটা বাস চলবে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের বিখ্যাত ডালমেশিয়ান উপকূলের গা ঘেঁষে। নানারকম নীল আর সবুজের মাখামাখি জলের উপরে, আর ছোট-ছোট দ্বীপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সমুদ্রের সর্বাঙ্গে। এত অপূর্ব নিসর্গ এই জীবনে খুব কম দেখেছি। ইতালির আমালফি উপকূল স্বচক্ষে দেখে এসেছি বছর কয়েক আগে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর। কিন্তু এমন ঝিলমিল সেখানেও লাগেনি। বাসের হালকা দুলুনিতে চোখ লেগে যাচ্ছে মাঝেমাঝেই। তবু, প্রায় জোর করে চোখ খুলে রাখছি, যদি কিছু দৃশ্য এই জীবন থেকে বাদ পড়ে যায়! প্লেনে করে এই পথ টুক করে আসা যায়। এই দৃশ্যও চোখ এড়ায় না। কিন্তু এতক্ষণ ধরে এত কাছ থেকে উপভোগ করা যেত না। বাসও দুলকি চালে থামতে-থামতে যাচ্ছে ছবির মত ছোট-ছোট গ্রাম শহরে— জাদার, স্প্লিট, ভার্গোরাচ, প্লোচে, মেটকোভিচ— মানুষজনের নামা-ওঠা চলছে। আমরাও এই সুযোগে নেমে খানিক হাত-পা ছড়িয়ে নিচ্ছি।

জলের উপর নীল আর সবুজের মাখামাখি

ছোট ছোট দ্বীপ জেগে রয়েছে সমুদ্রের বুকে
যাত্রার মাঝপথে ফোন বেজে উঠল। ওদিকে কুনালদার কণ্ঠস্বর: “তোমরা তো আজ দুবরোভনিকের পথে?” বললাম, “হ্যাঁ, আর ঘণ্টা চারেক।” আমাদের ঘুরে বেড়ানোর নানা ছবি ওদের পাঠাতে থাকি মাঝেমাঝেই। মনে ভাবলাম, ঠিক খেয়াল রেখেছে আমাদের যাত্রাপথ। “চলে এসো, আমি আর সুস্মিতা এইমাত্র দুবরোভনিক এয়ারপোর্টে নামলাম। এখন শহরের পথে।” ধন্যি বসু-দম্পতির ঘোরা রোগ! এমন অভিজ্ঞ আর সমরুচির ভ্রমণসঙ্গী জুটে গেলে কার না ভাল লাগে! মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আমাদের শহরে পৌঁছতে বেশ সন্ধে হয়ে গেল। ভাড়ার বাসায় মালপত্তর নামিয়ে ওল্ড টাউন বা পুরনো শহরে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যখন দেখা হচ্ছে তখন অ্যাড্রিয়াটিকের জলের মধ্যে সূর্য ডুব দিচ্ছে সবে।

ওল্ড টাউন দুবরোভনিক
আশ্চর্য সুন্দর শহর দুবরোভনিক। পাথুরে রাস্তা, গির্জা, তস্য সরু কাশীর গলির মতো অন্ধকার গলি, আর পাথরের সিঁড়ির শহর দুবরোভনিক। পুরনো শহরটার দুই দিকে দুটো দরজা— পূব দিকে প্লোচে গেট আর পশ্চিমে পিলা গেট। মাঝের ছোট শহরটা হেঁটে এদিক-ওদিক করতে লাগে বড়জোর মিনিট কুড়ি। তবে কিনা, এ-যাত্রায় অন্য সব শহরে টুকটুক করে হেঁটে বেড়িয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, এখানে তার জো নেই। থিকথিক করছে ট্যুরিস্ট। সারা বিশ্ব থেকে সব পর্যটক এসে জড়ো হয়েছে মনে হয়। সত্যিই পা ফেলার জায়গা নেই। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিনিসপত্রের দাম। একই দেশে, জাগ্রেবে যে জিনিসের যে দাম দেখে এলুম এখানে অন্তত চার গুণ বেশি দামে তা খরিদ করতে হচ্ছে। পরের ক-দিনে খেয়াল করেছি পপুলার কালচারের কী বিশ্বব্যাপী দাপট। ‘গেম অফ থ্রোন্স’ নামের টেলিভিশন সিরিজের অনেকটা জুড়ে রয়েছে এই শহর, শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে সেই সিরিজের বিবিধ ঘটনার অনুষঙ্গ। এই শহরকে কেন্দ্র করে যে সারা বিশ্বের পর্যটকদের এত উৎসাহ তার কারণ বুঝলাম যত না তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, বা ঐতিহাসিক অভিঘাত, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি তার ‘গেম অফ থ্রোন্স’ সঞ্জাত আকর্ষণ। এই কথা মানতে অসুবিধে হলেও এটাই হকিকত!

অলি গলি চলি রাম

সিঁড়ি আর ট্যুরিস্টের শহর
আমরা যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছি সেটা ওল্ড টাউন থেকে খানিক দূরে। বৃদ্ধ দম্পতির বাড়ি। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। ওঁদের মেয়ে থাকেন লন্ডনে, আপাতত মা-বাবার কাছে এসেছেন। খুবই অতিথিবৎসল আর মিশুকে। একদিন সন্ধ্যায় এক বোতল ঘরে-তৈরি ওয়াইন আর অরেঞ্জ কেক নিয়ে গল্প করতে এলেন। আমাদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত শুনলেন উৎসাহ নিয়ে। “এখানে কেমন লাগছে?” জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, “টুরিস্ট দেখছি প্রচুর, কিন্তু অন্যান্য শহরের মতো এখানকার স্থানীয় মানুষ চোখে পড়ছে না বিলকুল।” হাসলেন ভদ্রলোক। “আসলে স্থান মাহাত্ম্য বুঝলেন। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হওয়ার পর থেকেই এই শহরে সারা বিশ্বের পর্যটকের ভিড়। এইটুকু তো শহর। স্থানীয়রা সকলেই নিজেদের বাড়িকে সরাইখানায় বদলে দিয়েছে। কেউ দিয়েছে দোকান। তাই লোকালদের খুব একটা চোখে পড়ে না।” “তা নিজেরা থাকেন কোথায়?” জিজ্ঞাসা করি। “যদি আমার মতো দোতলা বাসা থাকে তাহলে অনেকে একতলায় থাকেন। নাহলে আশে-পাশের গ্রামে নিজেরা অনেক সস্তায় বাসা ভাড়া করে নেয়।” লন্ডন প্রবাসী আনিয়া বলে ওঠেন, “আসলে এখানে ট্যুরিস্ট সিজন চার থেকে ছ-মাসের। ওই সময়ে সারা বছরের রোজগার করে নেন স্থানীয় মানুষ। আর ট্যুরিজম এখানকার ইকনমির মেরুদণ্ড।” ব্যাপারটা খোলসা হল খানিক।
আরও পড়ুন-
স্লোভেনিয়ায় ‘সোনার তরী’, নতুন পাওয়া বইবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ
আমরা সারাদিন দুবরোভনিকের অলিতে-গলিতে হেঁটে বেড়াই। ভিড়ের রাস্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি। আলস্য মুড়ে নিই গায়ে হালকা চাদরের মতো। এত যে হইহই, পর্যটক, সৌন্দর্য, ‘গেম অফ থ্রোন্স’ ঘিরে উন্মাদনা, তবু ইতিহাসের ক্ষত, রক্তপাত, ধ্বংসের দিনগুলোকে সম্পূর্ণ ঢেকে উঠতে পারেনি দুবরোভনিক শহর।

সমুদ্রের ধারে অলস পর্যটক
সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, মন্টেনেগ্রো— যুগোস্লাভিয়ার ভাঙনের চিহ্নগুলি এই সব দেশের প্রত্যেক শহরের মতোই এখানেও দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে বেরোয় দামী আলখাল্লার ফাঁক দিয়ে। পথে যেতে-যেতেই সরু গলির মধ্যে থমকে দাঁড়াই। একটা বাড়ি, ভাঙাচোরা। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে কিছু একটা লেখা। এগিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করি শিল্পী ইভো গ্রবিচের বাড়ি। ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে সার্বিয়ার দুবরোভনিক আক্রমণের সময় গোটা শহর কেঁপে উঠেছিল পরপর বোমার আঘাতে। সেই আঘাত এসে লাগে গ্রবিচের বাড়িতে। আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায় গোটা বাড়ি, ভিতরে গ্রবিচের গোটা জীবনের আর্ট, লেখালিখি, চিঠিপত্র। সব শান্ত হলে কয়েক বছর পরে এই বাড়ি সংস্কার করা থেকে বিরত থাকেন গ্রবিচ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই আয়োজন করেন বিবিধ প্রদর্শনীর। এই বাড়ি রয়ে যায় আক্রমণের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে, ইতিহাসের মূর্ত দলিল হয়ে, গ্রবিচের বয়ানে, “Lest we forget!” তবে এও ঠিক যে চোখে না পড়ে গেলে, খুব চোখে আঙুল দিয়ে দুবরোভনিক শহর তার অপর এই দিকটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চায় না।

ইভো গ্রবিচের বাড়ির প্রদর্শনীর ছবি

জাগ্রেবের টানেল গ্রিচ
জাগ্রেবে যেমন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মায় শহরের পেট চিরে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার ফুট লম্বা টানেল গ্রিচ আমাদের বারবার নিয়ে ফেলবে তার অন্ধকার সময়গুলোর কাছাকাছি, দুবরোভনিক যেন তার পর্যটন, আহারের বাহার, 'গেম অফ থ্রোন্স', আনন্দের হররা আর পুঁজিবাদের বিস্ফোরণ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের দিকে। নীলের থেকেও নীল সমুদ্রের উপরে আলতো ভেসে থাকা এক স্বপ্নের নগরীর মতো।
আরও পড়ুন-
জাগ্রেব শহরে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া বাঙালি বন্ধু!
সেদিন সকালে বাসার বারান্দায় বসে ব্রেকফাস্ট করছি, কুনালদার ফোন, “নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপ্সে!” “কী হল আবার?” আমি জিজ্ঞাসা করি। জানা গেল ওদের পাশের ঘরের বাসিন্দা আপাতত অনন্যা পাণ্ডে, আর উপরের ঘরে কার্তিক আরিয়ান। পাঠক অবিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু এঁদের নাম আমি এর আগে শুনিনি। নন্দিনী চিনিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ, “আরে চাঙ্কি পাণ্ডের মেয়ে!” বোঝো! তৈরি হয়ে ওঁদের বাসায় পৌঁছে দেখি বাইরে শুটিং পার্টির ভিড় বেশ, সরু গলিতে এদের হুজ্জুতিতে যাওয়া-আসা করা মুশকিল। আর বসু দম্পতি বেরনোর জন্য ছটফট করছেন। পুছতাছ করে জানলাম একটা হিন্দি ছবির শুটিং চলছে এখানে, ছবির নাম ‘তু মেরী ম্যায় তেরা ম্যায় তেরা তু মেরি’। হ্যাঁ, এটাই ছবির নাম, একটাই ছবির নাম, আর মাঝে কমা, দাঁড়ি কিছু নেই। ঠিক করলাম দেশে ফিরে চারজনে মিলে এই ছবিটা দেখতে যাব!

শুটিং পার্টির দাপটে গলির কোণে আটক আমি আর কুনাল-দা
দিনের শেষে আজ চারজনে একটা পানশালায় এসে বসেছি। অভিনব পানশালা। একেবারে সমুদ্রের গায়ে, পাথরের উপরে চেয়ার টেবিল পাতা। কোথাও পাথরে রাখা একটা গদি। শুয়ে বসে থাকা যায় ইচ্ছামত। অনেকে দেখলাম সোজা সমুদ্রে নেমে পড়ছে। খানিক জলে ভেসে বেড়িয়ে উঠে এসে পানীয়তে চুমুক দিচ্ছে। বেশ বুর্জোয়া একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার! পানশালাটির নাম বুজা বার। তা আমরাও পছন্দের পানীয় নিয়ে বসেছি এমন সময় কথাটা পাড়ল কুনালদা, “বলছি, এত কাছে এসেছি, একবার বসনিয়া যাবে না?” সত্যি কথা! বাসে করে মাত্র ঘণ্টা আড়াই লাগে বসনিয়া পৌঁছতে। আবার একটা ইতিহাসের হাতছানি। বাঁধ সাধল আমাদের নাগরিকত্ব। বসু দম্পতির ভিসা লাগবে না, ওদের পাসপোর্ট উচ্চ ঘর, কংসরাজের বংশধর! কিন্তু আমাদের সেনজেন ভিসায় বসনিয়া যাওয়া যায় না। কুটকুট করে ফোনের বোতাম টিপছে কুনালদা: “এই দেখ, সেনজেন ভিসা বা আমেরিকার ভিসা থাকলে ভারতের নাগরিক বসনিয়ায় যেতে পারে।” দেখলাম গুগল তাই বলছে। আমাদের এই দুটোই রয়েছে, কিন্তু গুগলের উপর কি ভরসা করা চলে! কুনালদা লেখক মানুষ, কল্পনাপ্রবণ মন, “বেশ হয় কিন্তু! তোমাদের বর্ডারে আটকে দিল, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। একটা নো ম্যান্স ল্যান্ড, মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হতে পারে একটা!” সবাই হেসে উঠি।

বুজা বার
আজ সকলে মিলে আমাদের বাসায় ফেরা গেল। সুস্মিতাদি বিখ্যাত শেফ, যে জানে সে জানে! আজ সকলে ওর হাতের পাস্তা খাব। সন্ধ্যার আড্ডা আর রান্নাবান্না যখন চলছে আমি বসনিয়ার ভারতীয় দূতাবাসে একটা মেইল করলাম। আমাদের পাসপোর্ট, ভিসার ডিটেল দিয়ে লিখলাম যদি ওঁরা জানান আমরা বসনিয়া ঢুকতে পারি কিনা! নতুন একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে মনটা খুঁতখুঁত করছে। দেখা যাক কী হয়!
Whatsapp
