নধরের ভেলা: গতিময়তার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ
Nadharer Bhela Review: প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ছবিতে বারবার উঠে এসেছে গ্রাম্য লোকের ছাপোষা জীবন, মফসসলের মানুষদের খুচরো পয়সার যাপন, সর্বহারাদের এক মহাকাশ ভালবাসার কথা।
কোনো কোনো কাজের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, এক পৃথিবী লিখব। অথচ সত্য এই লিখতে বসলে নিজেকে শূন্য মনে হয়। মহাশূন্যের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমি এই মুহূর্ত থেকেই টের পাচ্ছি—সবটা লেখার পরেও মনে হবে যে কিছুই তো বলা হলো না, কিছুই লেখা হলো না; আরও, আরও, আরও অনুভব করা বাকি ছিল। আরও সত্যের কাছে পৌঁছনো বাকি ছিল। আর সবটা করতে হতো এই মন, এই আত্মা, এই শরীর—নধরের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে। আমরা কি প্রযুক্তির কাছে, ক্ষিপ্রতার কাছে, গতিবেগের কাছে, উদবৃত্তের কাছে, বিলাসিতার কাছে মাথা নত করতে করতে প্রকৃতির থেকে, মনুষ্যত্বের থেকে, সত্যের থেকে, অস্মিতাভাবের থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছি? নধর সেই প্রশ্নই ছুঁড়ে দেয় আমাদের মতো নির্বোধ, প্লাস্টিক, সুবিধাভোগী মানুষ নামক জন্তুদের দিকে।
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ছবিতে বারবার উঠে এসেছে গ্রাম্য লোকের ছাপোষা জীবন, মফসসলের মানুষদের খুচরো পয়সার যাপন, সর্বহারাদের এক মহাকাশ ভালবাসার কথা— কখনও তা লোকগীতির মাটির গন্ধে, কখনও ডিফোকাসড অর্ধবৃত্তাকার বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে, আবার কখনও ক্রুড হ্যান্ডহেল্ড শটের অস্থির ঝাঁকুনির মধ্য দিয়ে। গ্রাম্য জীবন, গ্রামীণ রাজনীতি, প্রকৃতির মাঝে তাদের চলাফেরা— এসবই ফিরে ফিরে আসে কাঁচা সত্যির মতো।
কিন্তু নধর আসলে কে? সে কি ফেলে আসা সময়? নাকি আমাদের দংশিত বিবেক? নাকি হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা, যার কথা আমরা শুধু ইতিহাস বইতেই পড়ে এসেছি? নাকি নধর আসলে প্রথম বহুকোষী প্রাণী, যার জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর পরে? নধরের আবহমান ধীরগতির চলন আমাদের মগজে অপ্রকাশ্যে ঢুকিয়ে দেয়— নধর আসলে চিরন্তন। তার সৃষ্টি অথবা বিনাশ নেই, কারণ তার জন্মই হয়নি। আসলে নধর এই পৃথিবীর একমাত্র সত্য। নধর মহাকাশে মিলিয়ে যাওয়া 'ওম' ধ্বনি। নধরই 'কুন ফায়া কুন'। তাই এই পৃথিবীতে তার একমাত্র সত্য মন্থরতা, স্থাণুভাব, চলচ্ছক্তিহীনতা, ধৈর্য, সময়ের ব্যবহার, পলকের জপমন্ত্র, সিন্ধু থেকে বিন্দুর দিকে যাত্রা করা। কিন্তু থেমে না থাকা। হার না মানা। লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে না পড়া। নিজের প্রতি অবিচার না করা। নিজের সত্য থেকে পিছু না হটা।
আরও পড়ুন- শশী তোমার শরীর নাই, ঘর নাই? পুতুলনাচের ইতিকথা ছবির নিবিড়পাঠ
এই ছবি দেখতে দেখতে সাই মিং লিয়াং-এর 'Journey to the West' ছবির কথা মনে পড়ে যায়। গ্লোবালাইজেশনের বিপরীতে ধীরে ধীরে পা ফেলে এক বৌদ্ধ সাধু হেঁটে যাচ্ছেন— মাথা নত, লক্ষ্যে অবিচল। তিনি থামছেন না। সময়ের পূর্ণ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছে যাচ্ছেন সভ্যতার আদিতে। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ছবিতে নধর যেন সেই বৌদ্ধ সাধু। লুঙ্গি পরিহিত সেই সাধু আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে নিজের উপস্থিতি দিয়ে আনেন এক ফালি স্পিরিচুয়ালিটি। যদিও তার জীবনদর্শন বোঝার ক্ষমতা কারও নেই বললেই চলে, আর সেজন্যই সে হয়ে ওঠে সমাজের খেলনা পুতুল— উপহাসের প্রিয়পাত্র, সার্কাসের নতুন আকর্ষণ। অপ্রাসঙ্গিক গতিময়তার জীবনের বিরুদ্ধে তার নীরব প্রতিবাদ ক্যানভাসে আগুন লাগানোর মতো প্রোজ্জ্বল হয়েও তার উপস্থিতি মিলিয়ে যায় নদীবক্ষের নাভিকেন্দ্রে।

কোনো মাস্টারপিস সিনেমাই শুধু পরিচালকের নির্দেশনার দক্ষতায় মহীয়ান হয়ে উঠতে পারে না। সিনেমা— এই ‘কোলাবরেটিভ’ মাধ্যমই শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে সমস্ত শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রতিভার অনুদানে। নধরের ভেলায় যাঁরা যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের পরিশ্রম এবং চরিত্র হয়ে ওঠা যেন পাহাড়ি ফুলের মতো সহজ ও সুন্দর। ‘নধর’-এর চরিত্রে অমিত সাহা, ‘শ্যামা’-র চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা সরকার, ‘ম্যানেজার’-এর চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী যেমন তাঁদের সুদক্ষ থাবা বসিয়েছেন; পার্শ্বচরিত্রগুলির মধ্যে অপরাজিতা, শতাক্ষী, নিলয়, সোহম, সায়ন— সবাই চরিত্রের সঙ্গে ন্যায়বিচার করেছেন।
নধরের চরিত্রে অমিত সাহা যদি এই সিনেমার ভেলা হন, তবে শ্যামার চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা সরকার এই ভেলার নাবিক। নধর যত সমাজের চোখে ভুল করে, যত বেগতিক হয়, যত 'সোলো'(slow) হয়; শ্যামা ততই তার ভুল শোধরাতে শোধরাতে যায়; এমপ্যাথি আর ফিলানথ্রপির নরম তুলো দিয়ে নধরের রক্তাক্ত জায়গায় বোরোলিন লাগিয়ে দেয় শ্যামা। নধর যেমন নিজের সবটা দিয়ে নিজের ধর্মের প্রতি, নিজের মুক্তির পথের প্রতি একাত্ম থাকে; শ্যামা একইরকম ভাবে নধরের 'ভালমানুষির', 'শ্লথতার', 'বহমানতার' একনিষ্ঠা শিষ্যা হতে শুরু করে। খানা-খন্দ ভরা একটা সার্কাসের মাঠে বিভিন্ন তাঁবুতে যখন যৌনতা ও লাস্যের খেলা চলতে থাকে; শ্যামা নধরের দিকে তাকিয়ে জীবনের সত্যকে অনুভব করার সাহস খুঁজে পায়। শ্যামার খানা-খন্দ ভরা পথে রূপা ধ্যানভঙ্গ করার জন্য আসে বটে; কিন্তু নধরের সাধুতা, নধরের মন্থরতার প্রতি অন্ধত্ব শ্যামাকে নিজের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
প্রিয়াঙ্কাকে প্রণাম, পর্দায় এই অভিনয় ফুটিয়ে তোলার জন্য। অভিনয়গুণের প্রশংসা করে আমরা 'অ্যাক্টর'দের ক্ষেত্রে প্রায়শই বলে থাকি, তাঁরা যেন 'বিহেভ' করেছেন, 'অভিনয়' করেননি। প্রিয়াঙ্কা 'শ্যামা'র চরিত্রে এমন ভাবে সমাপতিত হয়েছেন, যেন মনে হয়েছে, বহু দশক উনি 'শ্যামা' হয়ে বেঁচেছেন; তার প্রকাশ আমরা সবেমাত্র পেলাম। আসলে শ্যামাই প্রিয়াঙ্কা— প্রিয়াঙ্কাই শ্যামা। 'প্রিয়াঙ্কা'র থেকেই 'শ্যামা'র এমপ্যাথির জন্ম। তাই তারা অভিন্ন।

সিনেমাটোগ্রাফার জয়দীপ দে’র ক্যামেরার ভাষা নদিয়ার পল্লি এলাকার আনকম্প্রোমাইজড ল্যান্ডস্কেপে ছবিতে চিরাচরিত গ্রামবাংলার জৌলুসহীন আরাম এনেছে। শব্দগ্রহণে সৌরভের এবং শব্দমিশ্রণে অনিন্দিতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সিনেমার কর্মী হয়ে বহুবছর কাজ করার পরও ছবিতে শব্দের ব্যবহারের রিয়ালিজম বোঝার দক্ষতা আমাদের বেশিরভাগেরই শ্রোতা হিসেবে তৈরি হয় না। নধরের ভেলায় শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ ছবির ইমেজের সাথে এত সাযুজ্য এনেছে যে দর্শকের মনের অবচেতনে তা হাতুড়ির আঘাতের মতো বাজে। এক অস্বস্তিসূচক অভিব্যক্তি সৃষ্টি করে, যা গ্রহণ করতে অসুবিধা হয়, কিন্তু বুঁদ হয়ে থাকতেও ইচ্ছে করে। এই অব্যর্থ প্রয়োগ আমাদের নধরের মতোই 'শ্লথ' করে দেয়। ফলত, ছবি দেখতে দেখতে কখন চোখ থেকে অকৃপণ বারিধারা গাল বেয়ে নেমে আসে, কিন্তু মনে হয় না, আঙুল দিয়ে তা মুছে ‘পারফেক্ট’ হওয়ার চেষ্টা করি। কারণ হৃদয়েরও ভিতরের যে হৃদয়, তাতে কেউ কড়া নেড়ে বলে, এই অশ্রু আসলে দীর্ঘদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত।
আরও পড়ুন- ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার: যে রাজনৈতিক ছবি এখানে হবে না
ছবিতে সাত্যকি ব্যানার্জির সঙ্গীত আসলে নধরের ভেলার বাঁধুনি। সঙ্গীত সবাইকে বেঁধে রেখেছে— মায়ের মতো, আঁচলের মতো, আঁচলের গিঁটে থাকা চাবির মতো। তাই প্রসঙ্গের প্রয়োজনে ছবিতে যখনই “মা, মর না...” গানটা ফিরে ফিরে আসে, তখনই দর্শকের মাথায় এক আবেশ তৈরি হয়, যা সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় নধরের ট্রুথের কাছে— নধরের যাপনের ট্রুথের কাছে, নধরের প্রতিবাদের ট্রুথের কাছে। সেই সমস্ত মুহূর্তে আমাদের বুক হু হু করে কাঁপে। আমরা বলে উঠতে চাই “বেহুলার ভেলায় ভাসিয়ে দাও আমারে”, কিন্তু বলতে পারি না।
এ পৃথিবী এক 'মহাহত্যাশালা' এবং আমরা প্রত্যেকে এক একজন খুনি। এই সত্য অনুধাবন করতে এক মহাভারত বিদ্যা লাগে না, ১০০০ শ্লোক মুখস্থ করতে হয় না। শুধু প্রয়োজন হয় বোধশক্তির। মনে করিয়ে দেয় নধরের ভেলা।
সোশ্যাল মিডিয়া, রিল, ডুম্ব-স্ক্রোলিং, পেইড কোল্যাব, নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল, অ্যামাজন প্রাইমের দুনিয়ায় তিন ঘণ্টার ছায়াছবি নধরের ভেলা এক থেরাপিউটিক সেশন; একটি স্পিরিচুয়াল রিট্রিট; মেসোপটেমিয়ার পুনরুদ্ধার; নেভার-এন্ডিং ম্যানিফেস্টেশন টু সেল্ফ-অ্যাওয়ারনেস। আসলে এই ছবি এখনও শেষ হয়নি। এই ছবি এখনও বোনা চলছে। কোথাও না কোথাও, কেউ বা কারা এই ছবি তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নধরদের সাগা অনাড়ম্বর ভাবে বলে যাওয়ার চেষ্টা করছে অনন্তকাল; ধীর গতিতে, ধৈর্যের সাথে, মন্থরতার সাথে, স্থাণুভাবে। আর আমরা ফিরে ফিরে যাচ্ছি আমাদের প্রায়শ্চিত্তগুলোর মুখোমুখি; মাথার ভিতর বাজছে সাত্যকি ব্যানার্জির খান খান করা নেপথ্য বাজনা,
আর এক বুক হু হু করা স্তব:
“ভেসে যায় ভেলা... নধরের ভেলা।”
Whatsapp
