মাদার মেরি কামস টু মি | অরুন্ধতীর ঘর-অরুন্ধতীর ঝড়
Book review Mother Mary comes to me: এই বই যত না মায়ের স্মৃতিচারণ, তার চেয়ে বেশি আত্মজৈবনিকই বলা চলে। মায়ের প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণ ছিল অরুন্ধতীর জীবনের অনেকখানি জুড়ে।
‘আমি অরুন্ধতী রায় হব একদিন’, হলফ করে বলা যায়, এমন অভীপ্সা প্রকাশের ঝুঁকি কখনও নেবে না জেন জি। অরুন্ধতী রায় হওয়ার জ্বালা, কম নাকি? স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা, ঝড়ঝঞ্ঝায় আপসহীনভাবে একজন অরুন্ধতী রায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কি আর মুখের কথা, নিজেকে ভাঙতে হয়, একদিন, প্রতিদিন। মেয়ের এই বেপরোয়া ভাব কিন্তু তাঁর মায়ের থেকেই পাওয়া। অরুন্ধতীর এক-বুক ঘেন্না এবং একই সঙ্গে অসহায় ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু তাঁর মা মেরি রায়।
কেরলে নারীর অধিকার এবং ক্ষমতায়নের ইতিহাস লিখতে বসলে মেরি রায়ের নাম উঠে আসে সবার আগে। সালটা ১৯৮৬। সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করে ১৯১৬-র ‘ট্রাভাঙ্কোর ক্রিশ্চান সাকসেশন অ্যাক্ট’-এর এক্তিয়ার বদলে তিনি ছিনিয়ে আনেন, সিরিয়ান খ্রিস্টান মহিলাদের পৈতৃক সম্পত্তির উপর নিজেদের সমান উত্তরাধিকার। তার আগেই অকর্মণ্য, মদ্যপ স্বামীকে ত্যাগ করতে মেরি দ্বিধামাত্র করেননি। তাঁর সহবাস মূলত হাঁপানি, ক্রোধ এবং জেদের সঙ্গেই। ডাকাবুকো মায়ের মেয়ে তো নকশালপন্থীদের ডাকে ঘন জঙ্গলে ছুটে যাবেনই, আজীবন দেশের ফ্যাসিস্টদের তথাকথিত পৌরুষকেও যে অস্বস্তিতে ফেলবেন, তা-ও আর নতুন করে বলার কথা নয়।
অরুন্ধতী নিজের মায়ের কথা লিখছেন তাঁর নতুন বই 'মাদার মেরি কামস টু মি '-তে। তবে এ-ও বলছেন, বিটল্সের গানের মেরি-মায়ের মতো মেরি রায় কিন্তু কখনোই বলেননি, ‘লেট ইট বি’। তাঁর লড়াকু মানসিকতায় বশ্যতাস্বীকারের কোনো জায়গা ছিল না। তাহলে বইয়ের এই নাম কেন রাখলেন অরুন্ধতী? প্রশ্নটা মনস্তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করার মতো, তবে সহজ বুদ্ধি বলে, ‘কামস টু মি’ বলতে উনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন যে, মায়ের মতো হতে না চেয়েও ক্রমশ তিনি নিজের মধ্যে মায়ের ছায়াই দেখছেন। এই বই যত না মায়ের স্মৃতিচারণ, তার চেয়ে বেশি আত্মজৈবনিকই বলা চলে। মায়ের প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণ ছিল অরুন্ধতীর জীবনের অনেকখানি জুড়ে। তাই হয়তো মায়ের মৃত্যুর পর একবার অগোছালো জীবনটাকে ফিরে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
আরও পড়ুন- নধরের ভেলা: গতিময়তার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ
অরুন্ধতী মানেই গদ্যের স্বাদু চলন, নদীর মতো গতিময়তা, তবু, 'মাদার মেরি কামস টু মি 'একদিনে পড়ে ফেলার বই নয়। বইটা গোগ্রাসে গিলে তারপর অরুন্ধতী কীভাবে মা-কে ফেলে দিল্লি চলে গেলেন কিংবা ওঁর দুটো বিয়ে নিয়ে চা-আড্ডাও বোধহয় বইটার সঠিক পাঠভঙ্গি নয়। আবার এটা বেড়াতে গিয়ে পড়ার বইও নয়, মায়, বালিশে হেলান দিয়ে পড়ার বইও নয়— সোজা হয়ে বসে, কষ্ট পেতে-পেতে পড়ার বই 'মাদার মেরি কামস টু মি'। বার বার পড়ার বই।
একরত্তি মেয়ের মাকে আঁকড়াতে চাওয়া স্বাভাবিক প্রবণতা হলেও, মেরি রায় তাঁর ছেলেমেয়ের প্রতি স্নেহের লেশমাত্র দেখাননি কোনোদিন। দু'ভাইবোনের শৈশবের প্রায় সমস্ত স্মৃতিই তাই আঘাত পাওয়ার, পরিত্যক্ত হওয়ার। নিজের সন্তানদের অবাঞ্ছিত বোধ করাতেন অথচ স্কুলের সব কচিকাঁচাদের কাছে সেই মেরিই ছিলেন যেন দেবী, মাতৃপ্রতিম। হয়তো সম্পূর্ণ একা, দুনিয়ার সঙ্গে লড়ে জীবনযাপন করাটাই প্রথাসিদ্ধ মাতৃত্বের মানসিকতা থেকে মেরি রায়কে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। মা হওয়ার যন্ত্রণার চেয়ে মা 'না' হতে পারার যন্ত্রণা শতগুণে বেশি। মেরি মা হতে চাননি, তা-ও হতে হয়েছে। তারপরে, তিনি চেষ্টা করেছিলেন বাস্তবে মা হয়ে ওঠার, আর রাতের পর রাত তাঁর সন্তানেরা ভেবেছে, মায়ের গর্ভই যদি তাদের সমাধি হত!
যে নষ্টনীড়ে জন্মগ্রহণ করেন অরুন্ধতী, তাতে বাবার প্রশ্রয় বা মায়ের আদর কোনোটাই ছিল না তাঁর জন্য। তাই হয়তো সুখের সংসার গড়তে চাননি কোনোদিন। বরং, যখনই কোনো মানুষের কাছে আশ্রয় পেয়েছেন, আতঙ্কিত হয়ে ছুটে পালিয়েছেন সেই অচেনা শান্তি থেকে। ভালবাসার সঙ্গে এই নাক্ষত্রিক দূরত্ব ছোট্ট অরুন্ধতীকে টেনে এনেছিল তাঁর নিজেরই কাছে। নিজেই নিজেকে বড়ো করেছেন— প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে শিখেছেন, অপরিচিত কাঠবেড়ালিকে সহজেই পোষ মানিয়েছেন, নদীর দিকে যাওয়ার সমস্ত অলিগলি আত্মস্থ করেছেন। দিল্লি স্কুল অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্কিটেকচারে যতটা পড়াশোনা করেছেন তাঁর চেয়ে বেশি শিখেছেন নিজের জন্য দু-বেলা, দু-মুঠো খাবার জোগানোর কায়দাকানুন। দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রামই তাঁকে শিখিয়েছিল থিসিসে আকাশচুম্বী ইমারত নিয়ে গবেষণা না করে শহরের গরিব বাসিন্দাদের নিয়ে দু-কথা বলা জরুরি। যত ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, ততই পুষ্পিত হয়েছে তাঁর লেখকসত্তা। টাকা রোজগার হোক অথবা শ্বাস নেওয়া, কলম ধরা ছাড়া আর কিছুই তিনি করতে চাননি। সিনেমার স্ক্রিপ্ট থেকে শুরু করে সরকারকে আক্রমণ করে প্রবন্ধ— সবই লিখেছেন। তবে, তাঁকে সবচেয়ে এগিয়ে দিয়েছিল 'দ্য গড অফ স্মল থিংস', যা তিনি লিখেছিলেন নিজের প্রাণের আরামে।
অরুন্ধতীর তছনছ হওয়া ছেলেবেলার নেপথ্যে প্রধান কারণ, তাঁর মায়ের নির্মম, অন্যায় আচরণ। তবু মানতে দ্বিধা হয়, জেলে যাওয়ার আগের মুহূর্তে যিনি নিজের মেয়েকে ‘বাই বেবি গার্ল’ বলে সাহস জোগান, তিনি আদতে মেয়ের পাশে নেই। মেরি শূন্যতাকে ঢাকতে চেয়েছিলেন ক্রোধ দিয়ে; ভেবে দেখেননি, সেই ক্রোধের আগুন পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে তাঁর নিজেরই শিশুদের। অরুন্ধতী এটা জানেন। তাঁর বইতে মায়ের এই পৈশাচিক রূপ লুকোনোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি তিনি। ভুল-ত্রুটি-অন্যায় সমেত রক্তমাংসের মায়েরই বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। পাঠক মেরি রায়ের উপর ক্ষুব্ধ হলেও, অরুন্ধতী তাঁর মাকে বুঝেছেন। সমস্ত মানসিক যন্ত্রণা পেরিয়েও, মায়ের কাছেই ফিরেছেন বার বার। হয়তো কিছুটা বড়ো হওয়ার পর আশ্রয়ের খোঁজে আসেননি আর, তবে ‘সেডিশাস হার্ট’ শক্ত রাখতে মিসেস রায়ের প্রয়োজন ছিল তো বটেই।
অরুন্ধতী আর তাঁর ভাই ললিত কুমারের হয়তো মা হিসেবে পাওয়ার কথা ছিল ‘ভার্জিন মেরি’কে, তার বদলে তাঁরা পান ‘ব্লাডি মেরি’কে, যাঁর হাত মেরি টিউডরের মতো রক্তমাখা না হলেও, দু-দুটো ছেলেবেলার সারল্য পিষে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মায়ের সঙ্গে বোঝাপড়ার যন্ত্রণায় অরুন্ধতীর দেহ-মন নীল হয়ে যায়, অথচ কোথাও যেন জেগে ওঠে বিপ্লবী অরুন্ধতী রায়। মা-কে নিভৃতে ক্ষমাও করেন তিনি। শেষবেলায় বলেন,
"Bye-O, Mart Roy. / I’ll be seeing you."
কোথায় দেখা হবে? ওইপারে? ফুঃ! কঠিন সময়ে, নিজের মধ্যেই।

Whatsapp
