Hooliganism: হুলিগানের গুঁতোয় যা যা টের পাওয়া গেল

Hooliganism: কিন্তু যে মফস্বলের টোটোচালক এই আমলেও সিপিএম করেন আর নিয়মিত কুণাল ঘোষের দলের কর্মীদের কাছ থেকে হাতে ও ভাতে মরার হুমকি শোনেন, তিনি দেখছেন তাঁর কথা একটা গানের দল কলকাতা শহরের বুকে ঝলমলে মঞ্চে উঠে বলে দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের বই বাজারে সহায়িকা জিনিসটার বেশ বিক্রি আছে বোঝা যায়। কারণ, প্রকাশকরা টিভিতে ওসব বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতে টাকা খরচ করেন। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে নিয়ে আসেন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশে থাকা ছেলেমেয়েদের। এদিকে এ রাজ্যের শিল্পীদের রোজগার ক্রমশ কমছে বলে খবর পাই। বাংলা সিনেমা, বাংলা নাটক, বাংলা গান– কোনোকিছুই যে আর লাভজনক ব্যবসা থাকছে না, তা তো আমরা অনেকেই এখন জেনে গেছি। কিন্তু পকেটে টান পড়লেও এবার থেকে সঙ্গীতশিল্পীদের গানের সহায়িকা প্রকাশ করা উচিত। গানের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে প্রত্যেক দর্শকের হাতে এক কপি করে সেই সহায়িকা ধরিয়ে দেওয়া উচিত। সেখানে কোন গানের কোন কথাটা আক্ষরিক অর্থে নয়, শ্লেষার্থে বলা; কোন লোকের নাম কেন নেওয়া হয়েছে, কার নাম কেন নেওয়া হয়নি, কোন ঘটনার উল্লেখ কেন এসেছে, শিল্পী অতীতে কোন ঘটনা নিয়ে গান বেঁধেছেন, কোনটা নিয়ে বাঁধেননি, না বাঁধলে কেন বাঁধেননি; কোন মিছিলে গেছেন আর কোন মিছিলে যাননি, না গেলে কেন যাননি – এসব পরিষ্কার করে লিখে দেওয়া উচিত। একজন শিল্পীর অনুষ্ঠান হলে এটুকু করলেই চলবে, কিন্তু গানের দল হলে দলের প্রত্যেক সদস্যের অতীতের কোন ঘটনায় কী মতামত ছিল তাও লিখে দিতে হবে। তবে এটুকু করাই যথেষ্ট নয়। অনুষ্ঠানের প্রচারের সময়ে এই সহায়িকার বিজ্ঞাপনও দিতে হবে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে নিতে হবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের। প্রত্যেকটা সহায়িকার বিজ্ঞাপনেই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে উপস্থিত সব দলের নেতাকে রাখতে হবে। নইলে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে না। এইসব শর্ত মেনে গান না করলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট শিল্পী বা শিল্পীদের দল হয় চটিচাটা, নয় চাড্ডি, নইলে মাকু অথবা সেকু। কখনো কখনো তিনটের মধ্যে দুটো, বা একসঙ্গে তিনটেই।

এখানে দুটো আপত্তি উঠতে পারে।

১) গানের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে বই কে পড়বে?

২) অনলাইনে কে কী বলল তাতে কী এসে যায়?

যে কোনো ফেসবুক-শিক্ষিত বাঙালিই ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে জানিয়ে দেবেন যে ওটা অজুহাত, কোনো প্রশ্ন নয়। কেউ পড়বে কি পড়বে না সেটা ভাবার দায়িত্ব শিল্পীর নয়। শিল্পীকে আমাদের শর্তাবলী মানতে হবে। আমরা অত পড়বও না, সব গান মন দিয়ে শুনবও না। আমরা যারা টিকিট কেটে অনুষ্ঠান দেখতে যাইনি, তারা অনুষ্ঠানে পরিবেশিত গোটা আট গানের মধ্যে গোটা একটা গানের ভিডিও-ও দেখব না অনলাইনে। দেখব সাড়ে তিন মিনিটের ভাইরাল হওয়া ক্লিপ, তারপর লিখব সাড়ে তিন হাজার শব্দের ফেসবুক-প্রবন্ধ। কারণ, শিল্প যিনি বা যাঁরা সৃষ্টি করেন, যাবতীয় দায়িত্ব তাঁদেরই। শিল্পের রসাস্বাদন করতে কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষ যে মানসিক পরিশ্রম করে এসেছে, সেসব করার দায়দায়িত্ব আমাদের নেই। উৎকর্ণ হয়ে গান শোনার দায়িত্ব নেই, গানের কথাগুলো নিয়ে ভাবার দায়িত্ব নেই, যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো কেন বলা হচ্ছে, যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবেই বা কেন বলা হচ্ছে? এসব নিয়ে ভাবা আমাদের কাজ নয়। আমরা শুধু দেখব আমাদের পছন্দের কথা বলা হচ্ছে কিনা। হলে প্রশংসায় ভরিয়ে দেব, ফেসবুকে লাইক দেব, শেয়ার করব। অপছন্দের কথা হলে বলব ‘ছ্যাঃ! এটা গান?’, ‘একে প্রতিবাদ বলে?’, ‘রকের ভাষা স্টেজে উঠে বলে দিলেই শিল্প হয়?’ শ্লেষ বোঝার ধৈর্য না রেখে গান বা কৌতুকের স্রেফ আক্ষরিক অর্থ দেখেই চিল চিৎকার জুড়ে দেব ‘ইশ! নারীবিদ্বেষী কথা বলে চলে গেল, আর লোকে এই নিয়ে উল্লাস করছে!’

আরও পড়ুন- সংখ্যার রাজনীতিতে জাভেদ আখতাররাই চিরশত্রু

২ নম্বর প্রশ্নটা যে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে অবান্তর, তা নিয়ে বোধহয় বিতর্কের অবকাশ নেই। সোশাল মিডিয়া কেবল শিল্পচর্চার নয়, সাধারণ জীবনচর্যারই অবাঞ্ছিত কিন্তু অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গেছে। যে কোনো শিল্পের জনপ্রিয়তা, তা থেকে আয়– অনেকটাই নির্ধারিত হচ্ছে জিনিসটা কতখানি ভাইরাল হল তার উপরে। ফলে কোনো শিল্পমাধ্যমই আজ আর অনলাইন প্রতিক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সিনেমা বা নাচগান, নাটকের ক্ষেত্রে আগে মুখে মুখে প্রচারের যে ব্যাপারটা ছিল, তা এখন প্রায় উঠে গেছে। যা ঘটে তা অনলাইনেই ঘটে। কোন ছবি দেখতে যাব, কাদের গান শুনতে যাব বা কোন নাটক দেখব – আমরা সকলেই ঠিক করি ফেসবুক রিভিউ পড়ে বা ইউটিউবে কেমন হিট হচ্ছে তাই দিয়ে। তাছাড়া অনলাইনে কে কী বলল তাতে যদি কিছু না-ই এসে যায়, তাহলে অনলাইনে ঘৃণাভাষণ বা মহিলাদের প্রতি লিঙ্গবিদ্বেষী মন্তব্য, ধর্ষণের হুমকি দেওয়া নিয়ে আমরা আপত্তি করি কেন?

বলা বাহুল্য, এতগুলো কথা উঠে আসছে গত কয়েক দিনে মিলনমেলা প্রাঙ্গণে একাধিক ব্যান্ডের এক অনুষ্ঠানে হুলিগানইজম ব্যান্ডের একখানা গানের কিয়দংশ নিয়ে তৈরি হওয়া উত্তেজনা সম্পর্কে।

সাড়ে তিন মিনিটের ওই ভিডিওর ভাইরাল হওয়া প্রমাণ করে, যাবতীয় ডানপন্থী ও বামপন্থী আপত্তি সত্ত্বেও বহু মানুষের ওই পরিবেশনা ভাল লেগেছে। লাগারই কথা, কারণ আজকের পশ্চিমবঙ্গে যেসব কথা সাধারণ মানুষ আলোচনা করেন ফিসফাসে, সেসব কথা হুলিগানইজম মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলে দিয়েছে। এই বাংলায় যাঁরা ঠিক করেন কোনটা গান, কোনটা প্রতিবাদ, কোনটা সিনেমা; যাঁদের সম্পর্কে নচিকেতা সেই বাম আমলে লিখেছিলেন “সংস্কৃতির গ্রাফ উঠছে না নামছে/ফিতে দিয়ে মাপছেন তাঁরা”, সেইসব লোক ও মহিলাদের চোখে ওটা গান না-ই হতে পারে, প্রতিবাদও না হতে পারে। কিন্তু যে মফস্বলের টোটোচালক এই আমলেও সিপিএম করেন আর নিয়মিত কুণাল ঘোষের দলের কর্মীদের কাছ থেকে হাতে ও ভাতে মরার হুমকি শোনেন, তিনি দেখছেন তাঁর কথা একটা গানের দল কলকাতা শহরের বুকে ঝলমলে মঞ্চে উঠে বলে দিয়েছে। যে সিপিএম করা বাসচালক নিজে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি, ভেবেছিলেন ছেলেকে অনেকদূর পড়াবেন অথচ দেখছেন স্কুল-কলেজের বারোটা বেজে গেছে, এদিকে কেন্দ্রের শাসক দলের নেতা গরুর দুধে সোনার তত্ত্ব দিচ্ছেন, পাশের পাড়ায় বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময়ে এগারো হাজার হিন্দু মারার গালগল্প– তিনি নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তিনি দেখছেন, একটা জনপ্রিয় মুখ গরুর দুধে সোনার তত্ত্ব দেওয়া সাম্প্রদায়িক নেতাকে হাসির পাত্র করে দিচ্ছে। ভাবছেন যদি তাতে ছেলেপুলেদের উপর একটু প্রভাব পড়ে।

শতরূপ ঘোষের বাবুয়ানি নিয়ে দু-চার কথা বললে এঁদের কিচ্ছু এসে যায় না, বরং হয়ত ভালই লাগে। কারণ, বামপন্থী দলের সংস্পর্শে এসে যদি তাঁরা একটা জিনিসও শিখে থাকেন তা এই, যে লোকে কপালের দোষে গরিব হয় না। দুনিয়ায় বড়লোক আছে বলেই গরিব আছে। সে বড়লোকের টাকা আইনি পথেই আয় করা হোক বা বেআইনি পথে।

কথাটা আলালের ঘরের দুলাল সিপিএমদেরও শেখার কথা ছিল, কিন্তু হুলিগানইজমের হুল্লোড়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে না পার্টির পক্ষ থেকে শেখানো হয়েছে। ফলে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটছে গত কয়েক দিন ধরে। যে নেতাকে নিয়ে টিপ্পনী কাটা হয়েছে, তিনি ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেননি। অথচ সমর্থকদের ক্রোধ আর ফুরোচ্ছে না। নেতা বুদ্ধিমান, তিনি একবার, আমার বাবার টাকায় আমি গাড়ি কিনেছি বেশ করেছি– এই মর্মে আস্ফালন করেই সম্ভবত বুঝে গেছেন যে কমিউনিস্ট পার্টি করে ওকথা বলা চলে না। কিন্তু বিদেশে ছুটি কাটাতে যাওয়া, দামি গাড়ি চড়া ভক্তবৃন্দের এ যে অস্তিত্বের সংকট। যে ভোগে আপাদমস্তক ডুবে আছেন, তা কমিউনিস্টসুলভ নয় – এ বার্তা দিকে দিকে রটে গেলে বামপন্থী হওয়ার রেলাটি বজায় রাখা যে শক্ত হয়ে যাবে। মঞ্চের হুলিগানরা যেভাবে তাঁদের নেতাকে নিয়ে খিল্লি করল, তাতে সাহস পেয়ে যদি গরিব নিম্নবিত্ত বামপন্থীরা এঁদের নিয়ে খিল্লি করতে শুরু করে! এই আতঙ্কেই ‘ওটা কোনো গান নয়’, ‘ওটা প্রতিবাদ হয়নি’, ‘ওই আক্রমণে হুল নেই’ ইত্যাদি বাণী সাড়ে তিন দিনে সাড়ে তিন লক্ষ বার সোশাল মিডিয়ায় লেখা, সাড়ে তিন কোটি শেয়ার করা নয় তো? কিছুই যখন হয়নি, তখন রিমের পর রিম এ নিয়ে লেখার দরকার কী? যাদের জিনিসটা ভাল লেগেছে তাদের দিকে তেড়ে যাওয়ার দরকারই বা কী?

ব্যাপারটাকে খিস্তি খেউড় বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা যাঁরা করছেন, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন– এটা বাংলা। এখানে কবির লড়াই, তরজা, খেউড়ও খাঁটি দিশি সংস্কৃতি। হুলিগানইজমের অন্যতম প্রধান গায়ক অনির্বাণ ভট্টাচার্য নাহয় ‘গরিবের উত্তমকুমার’ (এই অভিধার প্রকট সাহেবিয়ানা এবং গরিবের সংস্কৃতিকে নিকৃষ্ট বলার প্রচ্ছন্ন বাবুয়ানিটি কি বামপন্থী?), শতবর্ষে পা দেওয়া আসল উত্তমকুমারের এন্টনী ফিরিঙ্গী (১৯৬৭) দেখলেই ব্যাপারটা জানা যায়। অবশ্য শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বামপন্থীদের অনেকে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের বাইরে বাংলা ছবি দেখেননি। ফলে তাঁরা না-ও জানতে পারেন। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে কীভাবে প্রতিবাদের ভাষা এবং ভাষ্য পালটে ফেলছেন শিল্পীরা; শিল্পমাধ্যম এবং সাংবাদিকতার সীমারেখা কীভাবে প্রায়শই মুছে যাচ্ছে – সেটুকু তো জানা উচিত। বামপন্থী নেতাদের থেকে সাধারণ জীবনযাপন আশা করা অনুচিত– এমনটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। এরপর কি শুনতে হবে তাঁদের কাছে আন্তর্জাতিক চেতনাও আশা করা উচিত নয়? নাকি সেটা বছর বছর ১ সেপ্টেম্বরের মিছিলেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মেনে নিতে হবে?

চলতি বামাবেগের অরাজনৈতিকতা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় হুলিগানইজমের পরিবেশনা নিয়ে ডানপন্থী আপত্তির দিকে তাকালে। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে নিয়ে টিপ্পনী কাটা হয়েছে, তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন – বাকস্বাধীনতা আছে বলেই যা খুশি বলা যায় না। অথচ তাঁর দলের আইনজীবী নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারি হুলিগানইজম এবং তাঁদের দুই প্রধান গায়কের অন্যতম, অনির্বাণের নামে পুলিসে যে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তা কিন্তু দিলীপের প্রতি কটূক্তি নিয়ে নয়, সনাতন ধর্ম সম্পর্কে অন্য একটা টিপ্পনীর জন্য। সোশাল মিডিয়ার ডানপন্থীদেরও ওই সাড়ে তিন মিনিট নিয়ে আপত্তির কারণ সনাতন সম্পর্কে রসিকতা – যা ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ব্যক্তি নেতাকে নিয়ে তাঁরা ভাবিত নন। অথচ বামেরা উত্তেজিত শতরূপের গাড়ির মান বাঁচাতে। তাহলে কি নেতা আর পার্টি অভিন্ন এঁদের কাছে? যেমন হিন্দুত্ববাদীদের কাছে ২০২৪ নির্বাচনের আগে পর্যন্তও নরেন্দ্র মোদি আর বিজেপি অভিন্ন ছিলেন? শতরূপ কি এত বড় নেতা? যদি তা-ই হয়, তাহলে আবার ‘সাহস থাকলে মহম্মদ সেলিমকে আক্রমণ করতে পারত, সফট টার্গেট বেছেছে’ – এমন কথা উঠছে কেন? যে নেতার এত অনুরাগী, তিনি ‘সফট টার্গেট’ হন কী করে? আর যদি ‘সফট টার্গেট’-ই হন, তাহলে তাঁকে নিয়ে সামান্য একটা গানের দলের টিপ্পনীকে পার্টির প্রতি আক্রমণ বলে ভেবে ফেলা কেন? তৃণমূল সরকার যখন খামোকা মীনাক্ষী মুখার্জিকে হাজতবাস করাল, তখন এর অর্ধেক উৎসাহ নিয়ে সিপিএমের এই সদস্য সমর্থকরা তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে গেলেও বোধহয় সরকারের হৃদকম্প হয়ে যেত, তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হত। তা তো করা হয়নি। তাহলে ‘সফট টার্গেট’ আসলে কে? শতরূপ না মীনাক্ষী? বামেরা বলছেন হুলিগানদের অন্য দুই টার্গেটও ‘সফট’। হয়ত ঠিকই বলছেন, কারণ কুণাল আর দিলীপকে নিয়ে তাঁদের পার্টির সদস্য, সমর্থকরা কিন্তু এত হইচই করলেন না।

এইবার যে যুক্তিটা উঠে আসা অনিবার্য, সেটা শিল্প সম্বন্ধে নয়, শিল্পী সম্বন্ধে। শিল্পীর অধিকার সম্বন্ধে বললেও ভুল হয় না। নিশ্চয়ই বলা হবে, হুলিগানইজম বলে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আসল হল অনির্বাণ। তিনি সুবিধাবাদী, তিনিই চটিচাটা, তিনিই আর জি কর আন্দোলন নিয়ে চুপ ছিলেন, তিনিই শিক্ষা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেননি। এখন তিনি জ্ঞান দিলে শুনতে হবে?

এ থেকেও বামপন্থীদের সম্বন্ধে ভারি মজার কিছু কথা টের পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণের তির অনির্বাণের উপর স্থির থাকার কারণ সহজবোধ্য। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সনাতন নিয়ে রসিকতা তিনিই করেছেন। শতরূপ ঘোষকে নিয়ে রসিকতা কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে বেরোয়নি। অন্য দুই ঘোষকে নিয়ে তিনি ফুট কাটলেও, শতরূপকে নিয়ে ছড়া কেটেছেন দেবরাজ ভট্টাচার্য। অথচ তিনি চটিচাটা– এমন অভিযোগ কেউ তুলছেন না। এ বোধহয় ব্যক্তির ঊর্ধ্বে দল– মার্কসবাদের এই প্রাথমিক পাঠ ভুলে মেরে দেওয়ার ফল। বস্তুত, ব্যাপারটাকে শতরূপ বনাম অনির্বাণ বানিয়ে ফেলা বামেদের বয়ান দেখে মনে হচ্ছে না তাঁরা কেউ জানেন যে গানগুলো ‘অনির্বাণের গান’ নয়, ব্যান্ডটার গান। এমনও হতে পারে, ওই গা জ্বালানো ছড়াগুলো অনির্বাণের লেখাই নয়। সেক্ষেত্রে ব্যান্ডের বাকিদের তৃণমূলী সংযোগের ফর্দ দেওয়াও কর্তব্য ছিল। অথচ হুলিগানদের উপর রেগে কাঁই হয়ে যাওয়া জনপিণ্ডের কতজন ওই ব্যান্ডের বাকি সদস্যদের নাম বলতে পারবেন তা নিয়েই সন্দেহ আছে। কেবল গৌরবে বহুবচন করা তো ঠিক নয়, তাই হুলিগানইজমের বাকি সাতজনের নাম এইবেলা স্মরণ করে নেওয়া যাক– শুভদীপ গুহ, কৃশানু ঘোষ, সোমেশ্বর ভট্টাচার্য, নীলাংশুক দত্ত, প্রীতম দাস, প্রীতম দেব সরকার, সুশ্রুত গোস্বামী।

সে যা-ই হোক, ওই দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ যখন অনির্বাণ, তখন তাঁকেই আক্রমণ করার যুক্তি ভুল নয়। অনির্বাণের বিজেপির লোক হওয়ার প্রমাণ হাজির করতে না পারলেও, তৃণমূলের পক্ষের লোক হওয়ার প্রমাণ হাজির করেছেন সোশাল মিডিয়ার বীরপুঙ্গবরা। তিনি খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হাত থেকে সরকারি সম্মান গ্রহণ করেছেন। এ একেবারে বামাল সমেত ধরা পড়া যাকে বলে। মুশকিল হল, সরকার আর দলের ভেদরেখা মুছে যাচ্ছে বলে এ রাজ্যের বিরোধীরা সঙ্গতভাবেই চেঁচামেচি করে থাকেন। কিন্তু সরকারি সম্মানকে এক্ষেত্রে তৃণমূল দলের দেওয়া সম্মান বলে ধরে নিতে একটুও ইতস্তত করছেন না। যদি তাও হয়, তাহলে একই যুক্তিতে প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও তৃণমূলের লোক বলতে হয়। কারণ শেষ বয়সে তিনিও রাজ্য সরকারের দেওয়া বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার (২০১৭) গ্রহণ করেছিলেন। সুখের বিষয়, তেমনটা কোনো সিপিএম সদস্য সমর্থক আজ পর্যন্ত বলেননি। আমৃত্যু সৌমিত্র প্রকাশ্যেই বামপন্থী ছিলেন, তাঁর সেই সম্মান আজ পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা বামপন্থীরা করেননি। ফলে গুটিটা গোড়াতেই কেঁচে যাচ্ছে।

অনেকের অবশ্য সূক্ষ্মতর বক্তব্য আছে। অনির্বাণ তৃণমূলী নন, কিন্তু সুবিধাবাদী। কারণ তিনি আর জি কর আন্দোলনে যোগ দেননি। পশ্চিমবাংলার এত বড় নিয়োগ কেলেঙ্কারির কথা তাঁদের ব্যান্ডের গানে নেই। কেন আর জি কর আন্দোলনে যোগ দেননি, তার ব্যাখ্যা অনির্বাণ ইতিমধ্যেই বহুবার দিয়েছেন। সে ব্যাখ্যা কেউ অবিশ্বাস করতেই পারেন, বিশ্বাস করলেও অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা অন্য। যে কোনো ব্যক্তিরই নিন্দা করা যেতে পারে কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ না করার জন্যে। কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো বিষয়ে তিনি কথা বললেই ‘তখন কথা বলেননি, অতএব এখনো চুপ করে থাকতে হবে’ – এই দাবি প্রথমত বনলতা সেনগিরি, দ্বিতীয়ত গা জোয়ারি। এতে মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছাই প্রকাশ পায়। শেষ বিচারে সেটা দক্ষিণপন্থাই।

এটাই বা কীরকম আবদার, যে একজন শিল্পীর শিল্পকে বিচার করতে হবে তিনি শিল্পের বাইরে কী করেছেন বা করেননি তা দিয়ে? আমি জানি অমুক ডাক্তার চমৎকার পেটের চিকিৎসা করেন। আমার পেটের অসুখ দীর্ঘদিন ধরে সারছে না, হাজারটা ডাক্তার দেখিয়ে হয়রান হয়ে গেছি, তবু তাঁর কাছে যাব না, যেহেতু তিনি বিবাহ বহির্ভূত প্রেম করেন? এরকম হাস্যকর যুক্তিতে আর কোন জিনিসটা করি আমরা? শিল্পীদের নিয়ে ভাবতে গেলেই আমাদের এরকম ভাবনার উদয় কেন হয় – তা নিয়ে বোধহয় রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি করানোর ব্যবস্থা করা উচিত এবার।

পৃথিবীর যে কোনো দেশে, যে কোনো কালে শিল্পীদের প্রধান কাজ ক্ষমতাবানের ত্রুটি ধরা, শাসককে এবং সমাজকে নিয়ে বিদ্রুপ করা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দেওয়া। আন্দোলনে নামলে ভাল, না নামলে মহাপাপ হয় না। আন্দোলন করা রাজনীতির লোকেদের কাজ। শিল্পীরা চাইলেই যে আন্দোলন করতে পারবেন তাও নয়। সবাই রবীন্দ্রনাথ হন না যে স্বয়ং স্বদেশি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। লক্ষণীয়, সে আন্দোলন থেকে তিনি আবার বেরিয়েও এসেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, ওই আন্দোলনে সত্যের চেয়ে ভান বেশি। এই সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে তখনকার জাতীয়তাবাদীদের বিষনজরেও পড়তে হয়েছিল। তারপরেও হিজলি জেলে বন্দিহত্যা নিয়ে তিনি ‘প্রশ্ন’ কবিতাটা লিখেছেন। সে কবিতায় না আছে হিজলি জেলের নাম, না আছে ইংরেজ সরকারের উল্লেখ। এখন হলে নির্ঘাত তাঁকে শুনতে হত ‘ওসব চালাকি। দম থাকলে গভর্নর জেনারেলের নাম করে লিখত।’ ভাগ্যিস তখনকার বাঙালির সহায়িকা দরকার হত না!

আরও পড়ুন- সিনেমায় বিকৃত ১৯৪৬, ইতিহাসের নামে চলছে যে রাজনীতির খেলা

কদিন আগেই উৎপল দত্তের জন্মদিন গেছে। তিনি ঘোষিত বামপন্থী, আমৃত্যু সিপিএম দলের ঘনিষ্ঠ, নাট্যজগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য এবং মঞ্চে তাঁর সব কাজই রাজনৈতিক। কিন্তু গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে সন্দেহ হচ্ছে– তাঁর জন্মদিনকে ব্যবহার করে যাঁরা ফেসবুক পোস্টে লিখছিলেন উৎপলবাবুর মেরুদণ্ড ছিল, আজকের শিল্পীদের নেই, উৎপলবাবুকে আজ পেলে তাঁকেও মেরুদণ্ডহীন বলতেন। কারণ তিনি রোজগারের জন্যে জনপ্রিয় হিন্দি বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। এমনকি প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র তো লিখেছেন, নাটক করার অপরাধে কংগ্রেস আমলে কারারুদ্ধ উৎপলকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন বম্বের কোনো ছবির প্রযোজক, যাতে তাঁর শুটিং নষ্ট না হয়। এই লোকের কল্লোল বা দুঃস্বপ্নের নগরী যতই সরাসরি রাজনৈতিক হোক, আজকের কমরেডরা কি আর পাত্তা দিতেন? তখন বাঙালির রাজনীতির সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি ছিল– জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তেরা ধুন্ধুমার আন্দোলন করবেন। নিজেদের শিল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা দেবেন উৎপলবাবু বা মৃণাল সেনরা। এখন ডান, বাম নির্বিশেষে বাঙালির চাহিদা হয়েছে উলটো– শতরূপ, দিলীপদের স্টুডিওয় যেতে হবে। মিছিলে যেতে হবে অনির্বাণদের।

এই উলটো বুঝলি প্রজার দেশে গানের দলের সমালোচনায় তাদের গান নিয়ে আলোচনা হবে না। হুলিগানইজমের এর আগে প্রবল ভাইরাল হওয়া ‘মেলার গান’-এর রাজনীতি আজ পর্যন্ত খেয়াল করার সময় সুযোগ পাননি বামপন্থীরাও। অনির্বাণের সমালোচনা করতে হলেও তাঁর কাজের সমালোচনা করা হয় না। হয় তিনি কাকে বিয়ে করেছেন আর কাকে করেননি তা দিয়ে সুবিধাবাদী প্রমাণের চেষ্টা, নয় কোন মিছিলে গেছেন আর কোন মিছিলে যাননি তা নিয়ে ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকারদের মত গ্রাফিক বিশ্লেষণ। এসব আলোচনার সিদ্ধান্ত আগে থেকেই স্থির থাকে। নইলে ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে অনির্বাণ নির্দেশিত 'মন্দার' সাম্প্রতিককালের বাংলা বিনোদন জগতের সবচেয়ে রাজনৈতিক দুটো ওয়েব সিরিজের অন্যতম (অন্যটা প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য নির্দেশিত 'বিরহী')। মন্দারে গোড়াতেই একটা রাজনৈতিক হত্যা দেখানো হয়, যিনি খুন হন তিনি একজন বামপন্থী শ্রমিক নেতা। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিন্দুমাত্র ধোঁয়াশা রাখা হয়নি। তাছাড়া বাংলা ছবির ইতিহাসে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা গতবছর ঘটিয়েছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায় আর অনির্বাণ। তাঁদের যুগ্ম নির্দেশনায় মুক্তি পেয়েছে অথৈ। মঞ্চসফল নাটক থেকে করা এই ছবিতে পশ্চিমবাংলার ভদ্রলোকদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দেখানো হয়েছে তাদের জাতপাতের বাছবিচার কত ভয়ঙ্কর।

তালিকা দীর্ঘতর করা যায়, তবে লেখা দীর্ঘতর করে লাভ নেই। কারণ একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের মনোযোগের আয়ু মাত্র আড়াই মিনিট। কিন্তু এই ভাবনা পীড়াদায়ক যে সংস্কৃতি আর রাজনীতি নিয়ে চিরকাল কলার তোলা বাঙালির এখন ভোট চুরি, ভোটার তালিকার আসন্ন বিশেষ নিবিড় সংশোধনী, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালি বিতাড়ন নিয়ে দিনরাত উত্তেজিত থাকার কথা ছিল এবং সব দলের নেতাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখার কথা ছিল। অথচ বাঙালিদের একটা অংশ মেতে আছে থিয়েটার ও সিনেমার একজন জনপ্রিয় শিল্পীর যাবতীয় কাজ নস্যাৎ করে দিতে, যেহেতু তাঁর গানের দল তাদের আদুরে নেতার ত্রুটি তুলে ধরেছে। দেখছি, মেলার গানে যথার্থই লেখা হয়েছে ‘আমাদের জীবনতলায় মোটরগাড়ি ঘুরছে মরণকুয়ায়…’।

 

More Articles