দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস; করুণা প্রার্থনার বাজারে বড় ধাক্কা
The Academy of Fine Arts: টানটান উত্তেজনা, রগরগে সংলাপ, উগ্র লালসা, বিক্ষিপ্ত ভালোবাসা, অস্থির যৌনতা এবং চাপা প্রতিহিংসা ও প্রতারণা। আদিম রিপুগুলি থরে থরে সাজিয়ে তৈরি হয়েছে ‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’।
তারিখ নিয়ে জট, মুক্তি নিয়ে জট, পদে পদে বাধা কাটিয়ে সম্প্রতি হলে মুক্তি পেয়েছে জয়ব্রত দাশের ‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস'। ফিল্ম ইস্কুল ফেরত এক আনকোরা যুবার প্রথম পরিচালিত ছবি। প্রথম ছবিতে আলোড়ন, ভাগ্য করে জোটে। সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন। মৃণাল সেন পাননি। ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবিটি তো তার জীবদ্দশায় লোকে দেখতেই পায়নি। সেই হাতেগোনা ভাগ্যবানদের মধ্যে জয়ব্রতও এখন একজন। মুক্তির আগেই ছবিটি নিয়ে যে পরিমাণ জলঘোলা হয়েছিল, তা-ই দর্শককে হলমুখী করবে, আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু পরীক্ষা এরপরে, যারা হলে গেলেন, তারা কী নিয়ে ফিরলেন, আজকের লব্জে, টেক হোম-টা ঠিক কী, 'দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস' কি দাগ কাটতে পারল?
টানটান উত্তেজনা, রগরগে সংলাপ, উগ্র লালসা, বিক্ষিপ্ত ভালোবাসা, অস্থির যৌনতা এবং চাপা প্রতিহিংসা ও প্রতারণা। আদিম রিপুগুলি থরে থরে সাজিয়ে তৈরি হয়েছে ‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’। সোশ্যাল মিডিয়ার সিধু জ্যাঠারা এর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন পাল্প ফিকশনের আঠা। কেউ আবার বলছেন, এ ছবি সাক্ষাৎ কোয়েন্টিন তারান্তিনোর বানানো। কিন্তু জনসংস্কৃতির ছোঁয়াচ মানেই তারান্তিনো, এমন প্রতিতুলনা বালখিল্য। অতএব, এইসব নামের ভার সরিয়েই ছবিটি দেখতে হবে।
ছবিটি আবর্তিত হয় একটি বোতলকে চুম্বক করে। মদের বোতল, অ্যান্টিক। দাম কুড়ি কোটি। আমরা ক্রমে দেখতে পাই পাঁচজন সমাজসেবীর ভেকধারী বন্ধু থুড়ি গ্যাং মেম্বার— দীনবন্ধু, রাখাল, সচিন, জীবন এবং বীরেশ্বরকে। তাঁদের একজন বস, কিমলিং এবং তাঁর একজন ‘মোনা ডার্লিং’ মার্কা প্রেমিকা, রিচা। আরও একজন আছেন অবশ্য, নাম পরিচয় গুপ্ত। যাঁর পরিচয় সিনেমাজুড়ে গুপ্তই ছিল, বাকি গ্যাং মেম্বারদের কাছে। একেবারে শেষে গিয়ে রহস্য উন্মোচন ঘটে। উক্ত ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই 'ফাইন আর্টিস্ট', আর এদের আর্ট: চুরি, রাহাজানি, কিডন্যাপিং ও খুন। প্রত্যেকেই সিদ্ধহস্ত।
আরও পড়ুন- নধরের ভেলা: গতিময়তার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ
পাঁচ বন্ধুর গোলটেবিল বৈঠক সিনেমার প্রথম দৃশ্য। পরিচয় গুপ্তের নিমন্ত্রণে তাঁরা সেখানে উপস্থিত। পরিচয় ‘গুপ্তই’ থাকলেন, সামনে এল স্রেফ একটা টেপ রেকর্ডার— তাতে ঘষাঘষা গলায় পাঁচ বন্ধুর উদ্দেশ্যে পরিচয়ের বার্তা— চুরি যাওয়া ম্যাগক্যাফিনের বোতলটি যদি তাঁরা পরিচয়ের হাতে তুলে দেন তাহলে মোটা টাকার কমিশন পাবেন প্রত্যেকে। এদিকে ওই অ্যান্টিক বোতলের খোঁজে তাঁদের বস কিমলিংও।
কুড়ি কোটি টাকার বোতল— দীনবন্ধু, সচিন, জীবন, বীরু এবং রাখালের মনে আসে অবধারিত প্রশ্ন, ম্যাগক্যাফিন হাতে এলে পরিচয় কিংবা কিমলিং কেন? নিজেদের কাছেই সেটা রাখবেন তাঁরা। প্লট ট্যুইস্ট, প্রতারণার জেরে বোতল গিয়ে পড়ল সেই কিমলিংয়ের হাতেই। কিমলিং— নৃশংস, পাশবিক। প্রত্যেকেই জানত কিমলিংয়ের রাজত্বে তারা পেয়াদা, তাদের দাম শূন্য। তারা বুঝেছিল এই কুড়ি কোটির বোতলেই তাদের ভাগ্যোদয় ঘটতে পারে। এরপর, কিমলিংয়ের থেকে মদের অ্যান্টিক বোতলটি কীভাবে চুরি গেল সেই চুরি একে একে সকলের মুখোশ কী ভাবে খুলে দিল তা নিয়েই এই ছবি।
সাদামাটা গল্প। কিন্তু তা-ই টানটান হয়ে উঠেছে পরিচালনার গুণে। অভিনয়প্রতিভায়। 'দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস' প্রমাণ, ভালো ছবি বানাতে চাইলে বাজেট অন্তরায় নয়। এক্সট্রিম লং শট, মিড ক্লোজ আপ, এক্সট্রিম ক্লোজআপ, বার্ডস আই ভিউ, লো-হাই অ্যাঙ্গেলের নির্ভুল ব্যবহার বারবার বুঝিয়ে দেয়, ট্রেনিং, প্রস্তুতি কতটা নির্বিকল্প। সাহিত্যকে পাতা ধরে ধরে উগড়ে দেওয়া সিনেমার কাজ না, সিনেমার নিজস্ব ভাষা আছে, বাংলা ছবি যখন ভুলে যেতে বসেছে তখনই অন্ধের যষ্টি হয়ে উদয় হয়েছে 'দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে'র। 'দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস' সাধারণ সিনেমা, সযত্নে নির্মিত সাধারণ সিনেমা, ওভারক্রাফ্টি, ভেতরে ফাঁপা সিনেমার ভিড়ে এক সচেতন বিস্ফোরণ।

পুরো ছবির কালার গ্রেডিংয়ে কুলটোনের আধিপত্য এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোর ব্যবহার, এমনকি, চরিত্রদের পোশাকের রং নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বাড়তি সচেতনতা বুঝিয়ে দেয় ডার্কনেসকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন পরিচালক। তৈরি করতে চেয়েছেন নির্ভার থ্রিলার। মনে রাখতে হবে এখানেই তিনি তারান্তিনোর থেকে আলাদা। নির্ভার মজাদার কিন্তু পেশাদার বাংলা সিনেমার মুকুটেই বরং পালক 'দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস'। সিজিআই-এর চেয়ে বাস্তবের উপর নির্ভরতা ছবিটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে।
সীমাবদ্ধতাকে ক্ষমতায় পরিণত করব কী ভাবে, জানতেন মৃণাল সেনরা। জয়ব্রতর কৃতিত্ব এই তিনি, ছবির সঙ্গীতে ফিরিয়ে এনেছেন আশির দশকের পপ কালচারের নষ্টালজিয়া, কিশোর কুমার-লতা মঙ্গেশকরের গ্রাম-মফসসল কাঁপানো গানগুলি। অর্থখরচ বেঁচেছে, দর্শকও বুঁদ হয়ে দেখছে শুনছে অব্যর্থ ব্যবহার।
একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছিলেন, “সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে একটা মত প্রচলিত আছে যে, তিনি যে কাউকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু এখন যখন পরিচালকের দৃষ্টিতে আমি সেটা দেখি তখন বুঝতে পারি যে, সেই অভিনয়টা শুধুমাত্র একজন পরিচালকের করিয়ে নেওয়া নয় তাতে একজন অভিনেতারও সমান যোগদান রয়েছে।” 'দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস'-এর প্রত্যেক অভিনেতাই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে তথাকথিত বাংলা ইন্ডাস্ট্রি এদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গেই সুবিচার করেনি। সেই তালিকায় প্রথম নাম রুদ্রনীল ঘোষের। আর তার পাশেই বসবেন অমিত সাহা। রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিত সাহা, সৌরভ দাস, ঋষভ বসু, পায়েল সরকার, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, অনুরাধা মুখার্জী— প্রত্যেকেই নিজেদের চরিত্রের সঙ্গে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার করেছেন। লোভ-লালসা, যৌনতা, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, ভালোবাসা, অনুশোচনা, প্রত্যেকটি অনুভূতি এই ছবিতে সময়ে সময়ে প্রত্যেক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে এমনভাবে সামনে এসেছে যা চোখ ফেরাতে দেবে না।
বাংলা ছবিতে 'খুনখারাপি'র বাড়বাড়ন্ত বেশ কয়েকবছর ধরেই চলছে। কিন্তু নেটফ্লিক্সের যুগে সেইসব খুনখারাপি অ্যাড্রিনালিনের গতি বাড়ায় না। সেই কাজটিই করেছেন জয়ব্রত। জোর গলায় বলতে হবে, এ কাজ করতে গিয়ে জয়ব্রত আজকের নামী পরিচালকদের মতো দক্ষিণী কিংবা বলিউডের দৃশ্য নকল করেননি। চেষ্টা করেছেন নিজের প্রকরণ শিক্ষা, ছবি দেখার অভ্যেসকে একছাঁচে ফেলে একটা নতুন দৃশ্যপট রচনা করতে। আমাদের দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যেসে আমরা তারান্তিনো হিচকক খুঁজছি।
বাংলা ছবি দীর্ঘদিন ধরে করুণার আলোড়ন খুঁজছে, পুরনো বাংলা ছবির বাবার মতোই তার অবস্থা, দায়গ্রস্ত, পাশে দাঁড়ান বার্তাটি অষ্টপ্রহর জাগরুক। এই অবস্থায় তরুণ জয়ব্রত প্রথম ছবিতে এমন কাজ করেছেন, যা কারুণ্য চায় না, দীনতা দেখায় না, আপন আলোয় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সহজ নির্ভার নির্মাণ হয়ে ওঠে। এমন ছবি হতে থাকলে দাবিদাওয়া, আবেদন নিবেদনের প্ল্যাকার্ডগুলি আর তুলে ধরতে হবে না।
Whatsapp
