ধর্মেন্দ্রর দু'বার মারা যাওয়া আমাদের আদৌ কিছু শেখাতে পারবে?
Dharmendra's death news: ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা আসলে ভীষণই রাজনৈতিক এবং গোটা বিশ্বজুড়ে তা ভীষণভাবে কার্যকর।
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ধর্মেন্দ্র। রোম্যান্টিক হিরোই হোন বা রাগী অ্যাকশন হিরো, বলিউড সিনেমায় ধর্মেন্দ্র য ঈশ্বরতুল্য উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন বহুকাল আগেই। তবে তাঁর মৃত্যু আমাদের সম্পূর্ণ অন্য দিকে নিয়ে গেল। আমাদের নিজেদের গভীর অসুখ চিনতে শেখাল চোখে আঙুল দিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে একবার নয়, দু-বার 'মৃত্যু' হলো ধর্মেন্দ্রর। আমরা দেখলাম, অ্যাড্রিনালিনের তাড়না আমাদের কোথায় এনে ফেলেছে। সংযমের সব দেওয়াল কী ভাবে ভেঙে গিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন গ্রামেগঞ্জে, পাড়ায় পাড়ায় রটে যেত অমুক জায়গায় তমুক সময়ে 'ছেলেধরা'র খোঁজ পাওয়া গেছে, কোনো এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কোনো এক অজ্ঞাত পরিচয়ের শিশুকে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কে যে কাকে চুরি করেছে তার আর হিসেব মিলত না। আরও মজার বিষয় ছিল, সেসব হিসেব মেলানোর অঙ্কে না গিয়ে লোকজন এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত- কে কতটা রসিয়ে, কতটা তাড়াতাড়ি সেই গল্প হাটে-বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারে।
আর এই হিসেব না মেলার চক্করে মাঝেমধ্যেই ঘটে যেত এক বিপত্তি- গ্রামের কোনো বেকার যুবক, যে হয়তো জীবনের লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে তথাকথিত স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে , তাকে সেই ছেলেধরা সন্দেহে দল বেঁধে মারধর করে একদল 'হাতের সুখ'-এর সুখের জোগান ঘটিয়ে নিত। সত্য উদঘাটন কিন্তু অধরাই থেকে যেত। এমন ঘটনার সঙ্গে বোধহয় আমরা কমবেশি অনেকেই পরিচিত।
সময় গড়িয়েছে। যুগ বদলেছে। হাতে স্মার্ট ফোন এসেছে। পলকের ক্লিকে তথ্যের ভাণ্ডার সামনে এসেছে কিন্তু আমরা আসলেই স্মার্ট হয়ে উঠতে পেরেছি কি আদৌ? আমাদের সেই প্রাচীন চরিত্রের কি বদল ঘটেছে? গুজব ছড়ানো ও গুজবে বিশ্বাস রাখার অভ্যাস আমাদের কি আদৌ বদলেছে? আসুন একটু ভেবে দেখা যাক।
আরও পড়ুন- “মওত মুবারক হো মীনা”, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে কেন শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন নার্গিস?
গত ১১ নভেম্বর অভিনেতা ও প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ ধর্মেন্দ্র অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে চারিদিকে হইচই পড়ে যায় তার মৃত্যুসংবাদে। বিভিন্ন মিডিয়া তাদের গল্পের ডালি নিয়ে লিখতে বসে ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুকাহিনী, প্রত্যেকের কাছেই আছে নিজস্ব 'Verified Source' কিন্তু সেই অদৃশ্য উৎসের বিবরণ তারা নিজেরাও জানে না। গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
এবার শুরু পরের খেলা- কে কত তাড়াতাড়ি সেই মৃত্যুসংবাদ নিজেদের সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে সাঁটিয়ে দিয়ে প্রমাণ দিতে পারে যে সে পিছিয়ে নেই, এই প্রতিযোগিতার লড়াইতে সে-ও টিকে গেছে। এই মৃত্যুসংবাদ না ছড়াতে পারলেই সে বরং অনেক বেশি অবসন্ন হয়ে পড়ে, হয়তো এই গতির যুগে সে পিছিয়ে পড়ছে এই ভেবে।
সেসব প্রতিযোগিতায় জল ঢেলে দিয়ে ধর্মেন্দ্র বাবু সুস্থ হয়ে ড্যাং ড্যাং করে বাড়ি ফিরলেও প্রতিযোগীরা কিন্তু ক্লান্ত বা লজ্জিত কোনোটাই বোধ করেন না, শুধু দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া পোস্টটুকুকে সরিয়ে দেন। এটুকুই। কারণ সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এত এত পাপ করতে করতে আমরা এগিয়েছি যে, এটুকু লজ্জাবোধ আমাদের মননে জায়গাই নিতে পারে না। অবশেষে ধর্মেন্দ্র ২৪ নভেম্বর এই পার্থিব জগৎ ত্যাগ করলেন কিন্তু আমরা কি সেই মৃত্যু থেকে কিছু শিখতে পারলাম?
এই গল্পে অবশ্য ধর্মেন্দ্র একা নন, তাঁর সঙ্গে আরও অনেক সেলিব্রিটিই আছেন, যাঁরা একইরকমভাবে প্রয়াত হয়েছেন, আবার কোনো 'এফোর্ট' ছাড়াই পুনর্জন্ম লাভ করে বাড়ি ফিরে গেছেন।
কিন্তু ভুল তথ্য ছড়ানোর এই প্রাচীন অভ্যাস সময়ের সঙ্গে যে বদলাতে পারেনি, বরং দিনের পর দিন উল্টে বেড়েছে, আধুনিক প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে সময়ের সঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়েছে এটা যথেষ্ট চিন্তার এবং একইসঙ্গে লজ্জারও। যদিও আগেই বলেছি, লজ্জা পাওয়ার অভ্যাসও আমাদের একই হারে কমেছে।
সেলিব্রিটি মৃত্যুর ভুয়ো খবর, সেই সেলিব্রিটির পরিবারের ঠিক কতটা মানসিক ক্ষতি করে আমার জানা নেই। কিন্তু এটা সুস্পষ্ট যে, দুই দেশের মধ্যে ঘটে চলা যুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত কোনো তথ্যবিকৃতি কিংবা দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া গুজব একটি সমাজব্যবস্থাকে ভেতর থেকে ঘুণ ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এশা দেওলের পোস্ট
একটা সময় ছিল যখন টিভিতে হিন্দি ছবির কোনো বিশেষ দৃশ্য দেখে বাড়ির বড়রা বলে উঠতেন, “এগুলো ক্যামেরার সাহায্যে সাজিয়ে করা” তারাই এখন অনেকে ইউটিউবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত কোনো ফুটেজ দেখে নিষ্পাপ মনে তাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন। কি অদ্ভুত মজার! আর শুধু বিশ্বাস করাটুকুতে থেমে নেই তারা, সেসব জিনিস যতক্ষণ না ৬৯ জনকে ফরওয়ার্ড করে কান ধরে দেখাতে ও বিশ্বাস করাতে না পারছেন তাদের শান্তি নেই।
আমাদের এই মনোভাবটুকুই একদল দুষ্টু লোকের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে অচিরেই। হান্ট অ্যালকটের একটি গবেষণা জানাচ্ছে, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় এক বিপুল পরিমাণ ভুয়ো খবরের উত্থান হতে শুরু করে, যার মূল হাতিয়ার ছিল সমাজ মাধ্যম। এই গবেষণাপত্রে খুঁজে পাওয়া যায়, সেসময় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মোট ৪১ টি লেখা পাওয়া গেছে। ট্রাম্পের পক্ষে প্রায় একশটির বেশি। এই একশটির বেশি লেখা ৩০ মিলিয়নের বেশি শেয়ার করা হয়েছে সমাজ মাধ্যমে, যার বৃহদাংশই ছিল ভুয়ো তথ্যে ভরা।
অর্থাৎ, এ কথা আলাদা করে বলে দেওয়ার আর প্রয়োজন নেই যে, এই ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা আসলে ভীষণই রাজনৈতিক এবং গোটা বিশ্বজুড়ে তা ভীষণভাবে কার্যকর। ঠিক যে কারণে প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলির তরফ থেকেই আজকের দিনে সবথেকে বেশি ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দেওয়ার উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে।
তাত্ত্বিকভাবে এই সময় কালকে আমরা উত্তর-সত্য সময় কাল বলছি, অর্থাৎ যেখানে সত্য আর মিথ্যের হিসেবে অদ্ভুত দোলাচলে দোদুল্যমান। উপরতলার গডফাদার লোকজন আসলে বুঝে গেছেন যে মানুষের মধ্যে ভুয়োতথ্য নিয়ে লাফালাফি করার, তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রবল। ছড়িয়ে দেওয়ার আগে একবারের জন্যও মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করে না।
আরও পড়ুন- রশ্মিকার পর ক্যাটরিনা! টাইগার ৩-এর তোয়ালে দৃশ্যের ‘ফেক’ ছবি ভাইরাল
হ্যাঁ! প্রশ্ন… পৃথিবীর অনেক সমস্যার সমাধান আসলে এই প্রশ্ন। ছোট থেকে আমরা বিজ্ঞানের যে পাঠ শিখে বড় হয়েছি তা আসলে এই প্রশ্ন করার শিক্ষা। যেকোনো তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার আগে যদি নিজের বিচার-বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে একবার প্রশ্ন করি নিজেকে, তাহলে কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই বুঝে ওঠা যায় যে, তথ্যটি কি আদৌ বাস্তবসম্মত? কিন্তু আমরা প্রশ্ন করি না... কারণ আমরা 'কাকে কান কেটে নিয়ে চলে গেছে' শুনলে, কানে হাত দেওয়ার থেকে কাকের পেছনে ছোটা অনেক বেশি জরুরি মনে করি। এই উওর-সত্যকালে তা আরও বেশি করে মনে করি।
ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে যাই, তবুও মনে প্রশ্ন আসে না যে, কানটা কি আদৌ আমার মাথার সঙ্গে আছে না নেই? ক্রমাগত প্রশ্ন যে বিচার বুদ্ধির জন্ম দেয়, তা দিয়ে এই ভুয়ো খবরের সঙ্গে কিন্তু খুব সহজেই লড়াই করা যায়। এই লড়াই জারি রাখার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, কোনো কিছু বিচার না করে খবরটা তড়িঘড়ি ছড়িয়ে না দেওয়া।
একবারটি ভেবে দেখা যেতে পারে ঠিক এইভাবে কত নিরীহ প্রাণ গেছে, কত মহিলা ডাইনি সন্দেহে নিগৃহীত হয়েছেন শুধুমাত্র গুজবের জন্য। একটু নিজের ওপর ভরসা করে, নিজেদের প্রশ্ন করে যদি তথ্যের যাচাই করতে থাকি তাহলে কিন্তু অনায়াসেই এই নিগ্রহ আটকানো যেতে পারে। অশান্তি ছড়ানো আটকানো যেতে পারে। বিভ্রান্তির পরিবেশ সৃষ্টি আটকানো যেতে পারে।
তথ্য যাচাই করার প্রসঙ্গ যখন এল, তখনই উত্তর-সত্যকালে এই বিষয়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, এখন আমাদের কাছে তথ্য যাচাই করার জন্য নানান উপাদানও আছে। কোনো খবর হাতে পেয়েছি মানে তা চোখ-কান-নাক বন্ধ করে অপরকে শোনাতেই হবে এমনটা নয়। বরং, সেই খবরটিকে আমি বিভিন্নভাবে গুগল সার্চ-এর মাধ্যমে যাচাই করে দেখতে পারি। গুগল লেন্স বলে একটি অ্যাপ আছে, যার মাধ্যমে ছবি বা ভিডিও যাচাই করা যায়। আমরা সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারি। এছাড়াও বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং এজেন্সি/ প্ল্যাটফর্ম আছে, তাদের ওয়েবসাইটে নজর রাখতে পারি, তাদের শরণাপন্ন হতে পারি।
আর এই কোনোকিছুই যখন কার্যকরী হয়ে উঠছে না, একটু অপেক্ষা করতে পারি। এই তড়িঘড়ি পোস্ট করার প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটে কি পাচ্ছি নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি। একটু অপেক্ষা করে গেলে কি সুবিশাল ক্ষতি হয়ে যায়? সব জল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধর্মেন্দ্র প্রথমবার ফিরে এসেছিলেন। যদিও, শেষরক্ষা হয়নি। এই প্রতিবেদন যখন প্রকাশিত হচ্ছে, বলিউডের 'হি ম্যান' তখন ইহলোক ছেড়ে পরলোক গমন করেছেন। কিন্তু, এই ঘটনা আমাদের ভাবতে শেখাক, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে ভাবতে শেখাক এই তড়িঘড়ি পোস্ট করার প্রতিযোগিতা থেকে আমরা আসলে কী পাচ্ছি? কারণ ধর্মেন্দ্র বেঁচে ফিরলেও যারা প্রান্তিক, অবহেলিত মানুষ তাদের গণপিটুনি খাওয়ার পর ফিরে আসার আর পথ থাকে না। তাদের হত্যা করেছি আমরা, ভুয়ো খবর ছড়ানোর মধ্য দিয়েই।

Whatsapp
