মাটির নিচে ন'দিনের বিভীষিকা! সিনেমার সাসপেন্সকে হার মানাবে সেই কিশোরীর লড়াই
৯দিন ধরে এলিজাবেথের ঘটনার টানাপোড়েন চমকে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে।
এ যেন অনেকটা ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর গল্প, তবে সিনেমা বা সিরিজের না বরং বাস্তবের। ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ সিরিজের উইলের মতোই হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেছিল ১৪ বছর বয়সি এলিজাবেথ শফ। তবে তাকে গল্পের মতো কোনও ডেমোগর্গন নামক দৈত্য তুলে নিয়ে যায়নি, তাকে কিডন্যাপ করেছিল এক রক্তমাংসের ভয়ংকর অপরাধী, যার নাম ছিল ভিনসন ফিলয় (৩৬)। মাটির তলার বাঙ্কারে আটকে থাকা এলিজাবেথ শফ কাটিয়েছিল জীবনের বিভীষিকাময় ৯টা দিন।
গলায় ভারী লোহার চেন, আর তার সঙ্গে বম্ব যুক্ত করে এলিজাবেথকে আটকে রেখেছিল অভিযুক্ত, এখানেই শেষ নয়, ধর্ষণ পর্যন্ত হয়েছিল তার। সিনেমা বা সিরিজ হার মানবে। বাস্তবে, আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে ঘটে যাওয়া এলিজাবেথ শফের গল্প আমাদের শুধু রোমাঞ্চিত করবে না, বরং শিক্ষাও দেবে তার সঙ্গে, শেখাবে কী করে বিপদের সময় নিজের ওপর বিশ্বাস আর মাথা ঠান্ডা রাখার দক্ষতা আমাদের আবার আলোর দিশা দেখায়।
১৪ বছর বয়সি এলিজাবেথ শফ দক্ষিণ ক্যারোলিনের লুগফ বলে একটি ছোট শহরে মা-বাবা আর ছোট ভাই ডনির সঙ্গে থাকত। বাড়িতে আদর করে সবাই ডাকত লিজি বলে। কিশোরী এলিজাবেথ তখন কল্পনাও করতে পারেনি, কী ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি হতে চলেছে সে। ২০০৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল ১৪ বছর বয়সি এলিজাবেথ, কিন্তু বাড়ি সেদিন আর পৌঁছতে পারেনি সে। মাঝরাস্তা থেকে রীতিমতো অদৃশ্য হয়ে যায় এলিজাবেথ।
আরও পড়ুন: কল্পনার রাক্ষস নেমে এসেছিল বাস্তবে? যে গবেষণা নিয়ে আজও রটে ফিসফাস
বিকেল চারটে তিরিশ মিনিট নাগাদ স্কুল ছুটি হওয়ার পর অন্যান্য দিনের মতোই ছোট এলিজাবেথ বাড়ি ফিরছিল, স্কুল বাস থেকে নেমে সে-বাড়ির রাস্তা ধরে। বাস স্টপ থেকে এলিজাবেথের বাড়ির দূরত্ব ছিল দেড়শো মিটারের মতো, প্রতিদিনের মতো বাস থেকে নেমে এলিজাবেথ একা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বাড়ি পৌঁছনোর কিছু আগে হঠাৎ করেই পুলিশের ইউনিফর্ম পরা এক ব্যক্তি এলিজাবেথের রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। সে এলিজাবেথকে বলে যে, তাদের বাড়ি থেকে নাকি গাঁজা পাওয়া গেছে এবং সেই অপরাধে তার ভাই ডনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এলিজাবেথকেও সেই একই অভিযোগে গ্রেফতার করে সে। ছোট এলিজাবেথ কিচ্ছু বুঝতে পারে না, ঘাবড়ে গিয়ে সে ভাইয়ের চিন্তায় সে পুলিশের সঙ্গে বনের দিকে হাঁটা দেয়।
কিছু রাস্তা যাওয়ার পরেই এলিজাবেথ বুঝতে পারে কিছু গণ্ডগোল আছে, কারণ লোকটি জনবসতির দিকে তাকে না নিয়ে গিয়ে ক্রমাগত গভীর জঙ্গলে নিয়ে চলেছে। হঠাৎ কিছু রাস্তা যাওয়ার পর অভিযুক্ত এলিজাবেথকে একই জায়গায় গোল গোল ঘোরাতে থাকে ও সবশেষে তাকে মাটির তলার একটা ১৫ ফিট নিচে ৮ বাই ৮ ফুটের এক বাঙ্কারে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই এলিজাবেথ বুঝতে পারে, কতটা মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন সে হয়েছে।
অন্যদিকে সময় পেরিয়ে গেছে, অথচ এলিজাবেথ ঘরে না ফেরায় এলিজাবেথের মা ও বাবা লিজির খোঁজ করতে বেরয়। এলিজাবেথের বন্ধু, স্কুল- সর্বত্র খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, এলিজাবেথ কোথাও কোনও বন্ধুর বাড়ি বা পার্টিতে যায়নি এবং স্কুল বাসও ঠিক সময় নামিয়ে দিয়েছিল তাকে। তাহলে গেল কোথায় মেয়ে? মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল এলিজাবেথের মা-বাবার। সন্ধে ৭টা ৩০ মিনিট নাগাদ ডায়েরি করা হলো পুলিশে। কিন্তু তারা অতটা পাত্তা দিতে চায়নি প্রথমে। কারণ ১৪ বছর বয়সটা বয়ঃসন্ধির সময়। এসময় বাচ্চা নিজের খেয়ালখুশিমতোই থাকতে চায়, হয়তো সেই কারণেই কোনও বাড়ির ঝামেলার জন্য এলিজাবেথও পালিয়ে গেছে সময় হলে ঠিক ফিরে আসবে সে। কিন্তু এলিজাবেথ ফিরে আসে না, একটা গোটা রাত কেটে গেলে চিন্তায় পড়ে পুলিশ। শুরু হয় নিখোঁজ এলিজাবেথ শফের খোঁজ।
পুলিশ, সাধারণ মানুষ চারদিক তোলপাড় করে খোঁজ করতে থাকে। লিজির কিন্তু কোথায় কে? কুকুর, হেলিকপ্টার কিছু বাদ থাকেনি। এতকিছু সত্ত্বেও এলিজাবেথের টিকি-টি পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায় না। এইভাবেই কেটে গেল তিন-চার দিন। ধীরে ধীরে মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমতে লাগল। কিন্তু হাল ছাড়েননি এলিজাবেথের মা। সবাই হতাশ হলেও তিনি জানতেন, তাঁর মেয়ে ঠিক ফিরবে।
একদিকে যখন লিজির খোঁজে লন্ডভন্ড চলছে, তখন অন্যদিকে এলিজাবেথ বাঙ্কারে বসে দেখছে সবকিছু, দেখেছে কীভাবে তার মা-বাবা-ভাই কাঁদছে, এক মুহূর্তে ছুটে তাদের কাছে যেতে চাইত সে, কিন্তু উপায় নেই। কারণ এলিজাবেথের গলায় তখন ঝুলছে ভারী লোহার চেন, আর সেখান থেকে ঝুলছে অভিযুক্ত ভিনসন ফিলয়ের নিজের হাতে বানানো বোমা।
এলিজাবেথকে বাঙ্কারে ফেলে দিয়ে নিজেও সেই বাঙ্কারে নেমে আসে ফিলয়। প্রথম যে প্রশ্ন সে এলিজাবেথকে করে, তা হলো, সে অক্ষতযোনি কি না? এবং তারপরেই এলিজাবেথকে রীতিমতো ধর্ষণ ও নিগ্রহ করে ভিনসন। এবং একবার না, বন্দি থাকাকালীন প্রায়ই এলিজাবেথকে যৌন নির্যাতন করে সে। প্রাণভয়ে সব মেনে নেয় লিজি।
৮ বাই ৮ ফুটের বাঙ্কারে বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে ছিল অভিযুক্তের বানানো টাইম বম্ব, কিছু রান্নার বাসন আর ব্যাটারিচালিত টিভি। পুরো বাঙ্কারটাই ভিনসন নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে বানিয়েছিল ও বাঙ্কারটি ছিল এলিজাবেথের বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে। ভাবলেই অবাক লাগে, কীভাবে বাড়ির কাছে থেকেও কেউ বিন্দুমাত্র হদিশ পায়নি তার। তার অবশ্য কারণ ছিল। চালাক ভিনসন ধরা পড়ার ভয়ে এলিজাবেথকে অপহরণ করে বাঙ্কারে নিয়ে আসার পথে নিজের আর এলিজাবেথের জুতো খুলে নেয়, যাতে মাটিতে জুতোর দাগ না পড়ে, ধরা না পড়ে যায় তারা।
ভিনসন শুধু এলিজাবেথকেই ধর্ষণ করেনি, ১২ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এলিজাবেথকে অপহরণ করার দু'দিনের মাথায় এলিজাবেথ মাটির ওপর পায়ের আওয়াজ পায়, মুক্তির আলো দেখতে পেয়ে এলিজাবেথ ভাবে, নিশ্চয়ই উদ্ধারকারী দল এই লুকোনো বাঙ্কারের খোঁজ পাবে। কিন্তু ভাগ্য এত তাড়াতাড়ি প্রসন্ন হয়নি লিজির ওপর। অন্যদিকে চেন আর বম্ব দিয়ে বাঁধা এলিজাবেথও চিৎকার করে উদ্ধারকারী দলের নজর টানতে পারছে না। তার দিকে তখন বন্দুক তাক করেছিল ভিনসন। এদিকে এলিজাবেথের হদিশ না পেয়ে ফিরে যায় উদ্ধারকারী দল। মাটির তলায় থাকা এলিজাবেথ হতাশ হলেও দমে যায়নি। বরং পালানোর অন্য পথ খুঁজতে থাকে সে।
একদিন রাত্রে ভিনসন ঘুমিয়ে পড়লে এলিজাবেথ উঠে কোনওরকমে ভিনসনের একটা বন্দুক বাগে পায়। ততক্ষণে আওয়াজ পেয়ে উঠে বসেছে ভিনসন, কিন্তু লিজি ভিনসনের দিকে তাক করে বন্দুক চালাতেই হেসে ওঠে ভিনসন। কারণ সেই বন্দুক চলে না, তা জ্যাম হয়ে গেছে। ভয়ে সিঁটিয়ে যায় লিজি। ভিনসনও রাগের মাথায় অকথ্য অত্যাচার করে তার ওপর।
কিন্তু ভাগ্য বারবার বিরূপ হয় না! পরের দিন থেকে এলিজাবেথ শুরু করে অন্য খেলা। এমন হাবভাব করে লিজি, যেন সে ভিনসনকে ভালবেসে ফেলেছে। ব্যস, ভিনসনও ফাঁদে পড়তে থাকে লিজির বুদ্ধির খেলায়। ধীরে ধীরে ভিনসনের ভরসা অর্জন করে এলিজাবেথ। অপহরণের আট নম্বর দিনে ভিনসন লিজিকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। ভিনসন এলিজাবেথকে বলে, সে যদি ভুলেও পালানোর চেষ্টা করে তাহলে ভিনসনের পোঁতা মাইন-এ (মাটির তলায় পোঁতা বম্ব) আহত হতে পারে সে। লিজি যখন পালানোর চিন্তায় মগ্ন, তখনই ভিনসন এলিজাবেথকে তার ফোন দেখায় ও সঙ্গে সঙ্গেই এলিজাবেথ বুঝে নেয়, সেই বন্দিদশা থেকে তার মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?
সেদিন রাত্রে ভিনসন ঘুমোনোর পর লিজি চুপ করে তার মায়ের ফোন নম্বরে একটি এসএমএস পাঠায়, যে, সে বেঁচে আছে ও কোথায় তাকে ভিনসন আটকে রেখেছে। পরের দিন সকালে, অর্থাৎ, নয় দিনের মাথায় এলিজাবেথের মা এসএমএস পায় ও সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানায়, জানতে পেরে যায় মিডিয়া। খবরে এলিজাবেথের এসএমএসের খবর দেখতে পায় ভিনসনও, সে রেগে লিজির কাছে জানতে চায়, এইসবের মানে কী? সঙ্গে সঙ্গে এলিজাবেথ মিথ্যে বলে। সে ভিনসনকে বলে, সে যেন পালিয়ে যায়। নাহলে পুলিশ তাকে ধরে নেবে। বাঙ্কার থেকে ভিনসনকে সরানো লিজির জন্য খুব দরকার ছিল। না হলে সে বাইরে আসতে পারবে না। ভাগ্যবশত এলিজাবেথের কথা শুনে ভিনসনও পালিয়ে যায়। অবশেষে এলিজাবেথও পালাতে সক্ষম হয়। বাঙ্কার থেকে বেরতে গিয়ে এলিজাবেথ উদ্ধারকারী দলের সম্মুখীন হয় ও সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ৯দিন বদ্ধ বাঙ্কারে থাকা এলিজাবেথ সেদিন বুঝেছিল, মুক্তির স্বাদ।
৯দিন ধরে এলিজাবেথের এই ঘটনার টানাপোড়েন চমকে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। ১৭ তারিখে ধরা পড়ে ভিনসন। এরপর কেস কোর্টে উঠবে যেদিন, সেদিন এক সাক্ষাৎকারে ভিনসন সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, লিজি স্বেচ্ছায় তাঁর কাছে ছিল। কিন্তু এসব বক্তব্য ধোপে টেকে না। বিচারক ভিনসনকে ৪৭১ দিনের সশ্রম কারাবাস দেয়। জয় হয়েছিল এলিজাবেথের। সে পেয়েছিল দুর্যোগের সময় মাথা নত না করার দাম। এরপর ২০২১ সালে ভিনসন কারাবাসেই মৃত্যু গ্রহণ করে।
এলিজাবেথের এই ঘটনা নিয়ে অনেক ছোট-বড় তথ্যচিত্র হয়েছে। বর্তমানে ত্রিশ বছর বয়সি এলিজাবেথ শফ একজন মা, সঙ্গে ডেন্টাল ফার্মে কাজ করে সে। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। হয়তো আজ তার এই জীবন সম্ভব ছিল না, যদি ওই সময় সে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলত। ১৪ বছর বয়সি এলিজাবেথ যে সাহস দেখিয়েছিল, তা সত্যি কুর্নিশযোগ্য। ইংরাজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘help yourself, god will help you’, অর্থাৎ, নিজেকে নিজে সাহায্য করলে ভগবান ঠিক সহায় হয়। আর তারই প্রমাণ এলিজাবেথ নিজে।