অভয়াকাণ্ডের ১ বছর! নিরাপত্তা পেল রাজ্যের মেয়েরা?
Wset Bengal : অথচ পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের কোনো মিল নেই। গত এক বছরের রাজ্যে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
আরজিকরের ভয়াবহ ঘটনার ১ বছর পার হলো। ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পর অভয়ার সঙ্গে ঘটে যায় বর্বরোচিত ঘটনা। এক বছর আগে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী পড়ুয়া- চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। তবে কলকাতাকে অন্যান্য শহরের তুলনায় নিরাপদ বলেই মনে করা হতো। কিন্তু বারবার কলকাতায় মেয়েদের হেনস্তা এবং যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাজ্যের নিরাপত্তা। প্রশ্ন উঠছে, মেয়েদের জন্য কতটা নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গ?
নারীদের নিরাপত্তার দাবিতে এক বছর আগে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য। গত বছর ৯ অগাস্ট আরজি করের ধর্ষনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর প্রশ্নের মুখে পড়েছিল রাজ্যের নারী নিরাপত্তা। নিহত চিকিৎসকের ন্যায়বিচার এবং মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন রাজ্যবাসী। ডাক দেওয়া হয় 'রাত দখলের কর্মসূচি'-র। রাস্তায় নামেন লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু ও প্রবীণ সকলে। বহুদিন চলেছিল এই আন্দোলন।
কয়েক মাস ধরে চলা সেই প্রতিবাদের 'আঁচ' এড়িয়ে যেতে পারেনি রাজ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও। অন্যদিকে আবার মুখ্যমন্ত্রীও মহিলা। প্রশ্ন উঠেছিল, কেন কর্মক্ষেত্র এবং অন্যত্র নারীরা সুরক্ষিত হবেন না? রাজ্য সরকার বলেছিল, নারীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব রকম ব্যবস্থা নেবে তারা। বলা হয়েছিল, রাস্তায় নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। তখন নারী পুলিসের টহল বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়। কর্মক্ষেত্রে রাতেও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল রাজ্য সরকার। দেখা যাক নারী নিরাপত্তা কতটা এগলো রাজ্য।
আরও পড়ুন- অভয়ার জন্য খোলা চিঠি যে-লড়াই শুরু হয়েছিল তা এখনও থামেনি জানিস
পরিসংখ্যানে একাধিকবার উঠে এসেছে, ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় কলকাতা সবচেয়ে নিরাপদ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্টে টানা তিন বছর সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় ছিল কলকাতা।
২০২২ সালের ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের যে শহরগুলিতে ২০ লক্ষের বেশি মানুষের বাস, তার মধ্যে কলকাতাতেই সবচেয়ে কম সংখ্যক অপরাধের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রায়ই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়ে বুক বাজান।
ওই রিপোর্টে প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় ৮৬.৫টি অপরাধের ঘটনার রেকর্ড করা হয়েছিল কলকাতায়। এই হিসেব অনুযায়ী, কলকাতার পরেই ছিল মহারাষ্ট্রের পুনে (২৮০.৭) এবং তারপর তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদ (২৯৯.২)। রিপোর্ট অনুযায়ী, অপরাধের সংখ্যা কমেছে কলকাতায়। ২০২১ সালে কলকাতায় প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১০৩.৫টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে ১৫৯.৬টি অপরাধের ঘটনা ছিল।
অথচ পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের কোনো মিল নেই। গত এক বছরের রাজ্যে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
কসবা ল কলেজে
বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই ফের কসবার ল কলেজে ধর্ষণের ঘটনা সামনে এসেছিল। কসবা ল কলেজে একের পর এক যৌন হেনস্থার স্বীকার হওয়া ছাত্রীরা বিচার পায়নি। সম্প্রতি ওই ছাত্রী প্রকাশ্যে এসে অভিযোগ দায়ের করার পর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে।
ছাত্রীদের যৌন হেনস্থা
১৭ জুলাই উত্তর ২৪ পরগনার একটি বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। শিক্ষকের নাম সুদীপ্ত মৈত্র। পুলিশ ওই শিক্ষককে গ্রেফতার করে। পকসো আইনে মামলাও রুজু করা হয়।
চিকিৎসাকেন্দ্রে মা ও মেয়ের যৌন হেনস্থা
২০ জুন বারাসাতের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে মা ও মেয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হন দুজনেই। নামী চিকিৎসকের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ, চিকিৎসাকেন্দ্রের আধিকারিকদের কাছে মা ও মেয়ে অভিযোগ জানালেও কোনো সাহায্য করা হয়নি তাঁদের। পরে বারাসত থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়।
নার্সের গোপন ভিডিয়ো রেকর্ড
পুরুলিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালের তরুণী নার্স হাসপাতাল সংলগ্ন মহিলা হস্টেলে থাকতেন। গত ১৪ জুন হস্টেল থেকে তাঁর স্মার্ট ফোন চুরি হয়। এরপর বর্ধমান থানায় অভিযোগ করেন তিনি। ফোন চুরি হওয়ার পর দিন থেকে সমাজমাধ্যমে এক যুবক ওই তরুণীকে অশ্লীল বার্তা পাঠায়। শুধু তাই নয়, গোপনে স্নান করার ভিডিয়ো রেকর্ড করে তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ। এর পর থেকেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেল। তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে সাইবার সেল তদন্ত করে। অভিযুক্তকে আটক করতে গুগল ও মেটার কাছে চিঠি লেখা হয়। ইন্টারনেট প্রোটোকল ডিটেলস এর সাহায্যে অভিযুক্তর সন্ধান মেলে। পুলিসের জেরায় সব দোষ স্বীকার করে অভিযুক্ত। তাকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু জেলা আদালতে ধৃতকে হাজির করা হলে ধৃতের পক্ষে এবং বিপক্ষের দুই আইনজীবীর মধ্যে সওয়াল জবাব হওয়ার পর অবশেষে শর্তসাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর হয় ধৃতের। প্রশ্ন হলো, কেন গুরুতর অভিযোগের পরও পুলিসি হেফাজত থেকে জামিন পেল অভিযুক্ত?
বর্ধমানে গণধর্ষণ
২০২৪ সালের ৭ অগস্ট, বর্ধমান-নবদ্বীপ রোডের একটি জায়গায় এক বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে যান তরুণী।অভিযোগ, তাঁদের ঘিরে ধরে টাকা চায় তিনজন। তা না দেওয়ায় তিন জন মিলে তরুণীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ।
আরও পড়ুন- অভয়াকাণ্ডের ঠিক পরেই কী কী ঘটেছিল আর জি কর হাসপাতালে?
কুলতলির ধর্ষণকাণ্ড
২০২৪ সালের ২০ অগাস্ট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলিতে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে লাগাতার ধর্ষণের অভিযোগ প্রতিবেশী দাদুর বিরুদ্ধে। কিশোরীর অভিযোগ, প্রতিবেশী এক বৃদ্ধ নাবালিকাকে একাধিক বার ধর্ষণ করেছে।
স্বামীর সামনে ‘গণধর্ষণ’ স্ত্রীকে
২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর স্বামীর সামনে স্ত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল কল্যাণীতে। স্বামী-স্ত্রী মিলে কল্যাণীর কাঁচরাপাড়া রেলসেতু দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় কয়েকজন মহিলাকে টেনেহিঁচড়ে সেতুর নীচে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।
নাবালিকাকে গণধর্ষণ
২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক নাবালিকাকে রবীন্দ্র সরোবরের একটি হোটেলে নিয়ে গিয়ে বছর ষোলোর নাবালিকাকে মদ্যপান করিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযুক্ত আরিয়ান মিশ্র এবং ঋষি আগরওয়াল নামে দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। এক নাবালকেও আটক করেছিল পুলিস।
বাড়ি থেকে ডেকে ধর্ষণ
২৯ জুন, কল্যাণীর ঘটনা। গভীর রাতে এক তরুণীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে উঠেছিল প্রতিবেশী যুবকের বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন হলো, কেন আগে থেকেই নিরাপত্তার কথা ভাবা হয় না? তাহলে অন্য রাজ্যের সঙ্গে তফাৎ কোথায়? হাসপাতালেও নিরাপত্তা নেই, বিদ্যালয়েও নিরাপত্তা নেই, কলেজেও নিরাপত্তা নেই তাহলে আর কোথায় নিরাপত্তার কথা ভাববে মানুষ? সরকার কি নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ?
নারী নিরাপত্তার জন্য কী প্রয়োজন এবং কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

Whatsapp
