বিস্ফোরণের পর কীভাবে কাজ করেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা?

Lal Quila blast: বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জায়গাটির ছবি তোলেন এবং তার একটা স্কেচ তৈরি করেন, যা বিশ্লেষণের বিভিন্ন পর্যায়ে গাইডলাইনের কাজ করে। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করেন বিভিন্ন পোড়া টুকরো।

১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের সাক্ষী থেকেছে আমাদের রাজধানী। লালকেল্লা চত্বরের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একটি আই-২০ গাড়ি, যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত; মুহূর্তেই ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে আশেপাশের কয়েকটি গাড়ি, বাস ও তার মধ্যে থাকা মানুষজন। বিস্ফোরণের অভিঘাতে উড়ে গেছে জন দশেক মানুষের দেহাংশ। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে লাল কেল্লা চত্বর। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে আধঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন দিল্লি ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির এক্সপ্লোসিভ বিভাগের বিশেষজ্ঞরা, যার পোশাকি নাম ক্রাইম সিন ভিজিট বা প্লেস অফ অকারেন্স ভিজিট।

যে কোনো অপরাধ বা দুর্ঘটনা হলে, অকুস্থল পরিদর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা কী করেন সেখানে গিয়ে ? তাঁরা কি অপরাধী ধরতে যান, নাকি যান তদন্ত করতে ? না। বিশেষজ্ঞরা আসামী ধরতে যান না, এমনকি বিচারের রায় নিয়েও তাঁরা ভাবিত নন। অপঘটনা যা ঘটার, তা তো ইতিমধ্যে ঘটেই গেছে, তাঁদের কাজ হচ্ছে অকুস্থল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করা। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত পরীক্ষাগারে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, যাতে করে দুর্ঘটনার কিনারা করা যায়, বা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব‍্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতিতে যাচাই করা যায়। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, প্রায়শই বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা পড়ি বা শুনি যে অকুস্থল থেকে ফরেন্সিক সদস্যরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন, এটা আংশিক সত‍্য; যে কোনো দক্ষ ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের কাছে অকুস্থল যেন এক তথ্যের খনি। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে শুধু অকুস্থল পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেই অপরাধের কিনারা করা সম্ভব হয়েছে। 

তবে আর পাঁচটা দুর্ঘটনা থেকে বিস্ফোরণ কিছুটা আলাদা; এখানে মুহূর্তেই সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে প্রচুর পরিমাণে চাপ ও তাপের সৃষ্টি হয়, যাতে ঘটনাস্থলের সবকিছু জ্বলে পুড়ে যায়, সেজন্য বিশেষজ্ঞদের কাজ করা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। তবু নিরাশার মাঝে আশার আলো দেখার চেষ্টা ছাড়েন না তাঁরা, কারণ ফরেন্সিকের জগতে বিখ্যাত 'লোকার্ড প্রিন্সিপাল' (অপরাধী অকুস্থলে কিছু না কিছু ফেলে আসবেই এবং আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসবে; দু'টোই ফরেন্সিকে প্রমাণ হিসাবে সমান গুরুত্বপূর্ণ) অনুযায়ী ঘটনাস্থলের সঙ্গে সন্দেহভাজন ব্যক্তির সংযোগকারী কোনো নমুনা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, যেখান থেকে অনুমান করা সম্ভব হবে বিস্ফোরণের তীব্রতা, উৎস, কী জাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে— এই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। 

আরও পড়ুন- ১৯৯৬ থেকে ২০২৫: দিল্লির বিস্ফোরণের ইতিহাস এক নজরে

বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জায়গাটির ছবি তোলেন এবং তার একটা স্কেচ তৈরি করেন, যা বিশ্লেষণের বিভিন্ন পর্যায়ে গাইডলাইনের কাজ করে। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করেন বিভিন্ন পোড়া টুকরো (যাকে বিশেষজ্ঞরা ডেবরিস বলেন), গাড়ির ভাঙা যন্ত্রাংশ, কার্বন গুঁড়ো ইত্যাদি। বিস্ফোরণের ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা খোঁজার চেষ্টা করেন বিস্ফোরকের টুকরো, ডিটোনেটর ইত্যাদি। যেগুলো পরবর্তীতে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষাগারে, 'স্পেকট্রোস্কোপিক' এবং 'ক্রোমাটোগ্রাফিক' কৌশল ব্যবহার করে, বিস্ফোরক অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেন, কী ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে। অকুস্থল পরিদর্শনের সময় খোঁজ করা দরকার কোনো ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের টুকরোর সন্ধান মিলল কিনা, কারণ দূরনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে যেসব বিস্ফোরণগুলো হয়, সেখানে সাধারণত 'অটো-টাইমার বেস্ট অ‍্যাক্টিভেশন টেকনিক' ব্যবহার করা হয়। যদিও দিল্লির ঘটনায় কোনো টাইমার বা ইলেকট্রনিক সার্কিটের সন্ধান এখনো মেলেনি। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পর অনেক সময় তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয় না অপরাধের ধরণ, সে সময় তাঁরা ক্রাইম সিন পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেন, যাতে করে বিস্ফোরণের সময়ের ছবি আরও ভালোভাবে ফুটে ওঠে।

বিস্ফোরণের প্রকৃতি বোঝার জন্য ঠিক কী ধরণের পরীক্ষা করা হয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে?

সেজন্য বিশেষজ্ঞরা 'ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কোপি (FTIR) ও 'অ্যাটেনিউটেড টোটাল রিফ্লেক্ট্যান্স'-FTIR (ATR-FTIR) ব্যবহার করেন। অকুস্থল থেকে পাওয়া নমুনা মূলত ইনফ্রারেড আলোর সঙ্গে কী রকম মিথস্ক্রিয়া করে, আরও স্পষ্ট করে বললে ইনফ্রারেড আলো যখন নমুনার মধ্যে দিয়ে যায় তখন নির্দিষ্ট কিছু কম্পাঙ্কের আলো শোষিত হয়, সেই শোষিত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বিস্ফোরকের নমুনার হদিশ পান ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা তাপীয় বিশ্লেষণের সাহায্যে বিস্ফোরক সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, যেমন রাসায়নিক গতিবিধি, স্থিতিশীলতা এগুলো নির্ণয় করেন। যে কোনো বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে আগুন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, এই সমস্ত পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্যের উপর মোট ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে। সেজন্য বিশেষজ্ঞরা লেজার-ভিত্তিক দৃশ্য ম্যাপিং, ফ্ল্যাশ পয়েন্ট টেস্টিং ইত্যাদি ব্যবহার করে জানার চেষ্টা করেন আগুনের উৎস, কোন দাহ্য পদার্থের উপস্থিতিতে আগুন এত ছড়িয়ে পড়ল সেসব। সেই থেকে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ঘটনাটি দুর্ঘটনাজনিত ছিল নাকি ইচ্ছাকৃত।

আরও পড়ুন- ‘তিনবার মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম’! দিল্লির বিস্ফোরণ নিয়ে যা জানালেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

শুধুই কি বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের কাজ এখানে? দিল্লির বিস্ফোরণের ঘটনায় গাড়ির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কখন গাড়িটি সিগন্যালে এসে দাঁড়ায়? কেউ নেমেছে বা উঠেছে কিনা, সেসব জানার জন্য গাড়িটির সিসিটিভি ফুটেজ ভালো করে পরখ করা দরকার, যেখান থেকে আততায়ী সম্মন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এইসব কাজ করার জন্যে দরকার একজন সাইবার বিশেষজ্ঞের। আবার অভিজ্ঞতা বলছে যে কোনো দুর্ঘটনা, বিশেষত বিস্ফোরণের মতো সংগঠিত জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গাড়িগুলির ইঞ্জিন নাম্বার, চেসিস নাম্বার আগেভাগেই বদলে ফেলা হয়, সেজন্য 'তাপীয় রাসায়নিক পরীক্ষার’(Thermochemical examination) সাহায্যে বের করা দরকার গাড়িটির প্রকৃত ইঞ্জিন নাম্বার, চেসিস নাম্বার, যার পরিচিত নাম 'এচিং'। যে কোনো ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে এ কাজের দায়িত্ব পড়ে একজন পদার্থবিদ্যা বিশেষজ্ঞের। ঘটনাস্থলে, যে সব মৃতদেহের টুকরো মিলেছে, তাঁদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা আশু কর্তব্য, কারণ তাঁদের বাড়ির লোক প্রহর গুণছে। সুতরাং, যে কোনো বিস্ফোরণের ঘটনায় একাধিক বিভাগকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা দরকার, যাতে অপরাধের কিনারা করতে সুবিধা হয় তদন্তকারীদের, সেই সঙ্গে মহামান্য আদালতের সামনে হাজির করা যায় বিভিন্ন আলামতের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ।

More Articles