ঠিক কোন কোন অভিযোগে শেখ হাসিনা মৃত্যুদণ্ড পেলেন
PM Sheikh Hasina: আশুলিয়ায় জীবিত একজন-সহ ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগও ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়। এই ভয়াবহ অপরাধে নেতৃত্বদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দীর্ঘ তদন্ত, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং আইনি প্রক্রিয়ার পর পাঁচটি অভিযোগেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছে তিন সদস্যের এই বেঞ্চ। ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ, শেখ হাসিনা পদ্ধতিগত ও ভয়াবহ মাত্রায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘মাস্টারমাইন্ড’, ‘হুকুমদাতা’ এবং ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না।
সোমবার দুপুরে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে বেঞ্চ রায় ঘোষণা শুরু করলে পুরো বিশ্বের দৃষ্টি যায় ট্রাইব্যুনালের দিকে। মোট ছয় অধ্যায়ে সাজানো ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় পাঠ শেষ হতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। এটিই পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের দেওয়া প্রথম রায় এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম আনুষ্ঠানিক বিচার। এই মামলায় শেখ হাসিনা-সহ মোট তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়— সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনাল জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে এবং সাজা ঘোষণা করা হয়েছে তিনটি প্রধান ভাগে।
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে প্রথম অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আর দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের নামে বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
৬ মাসেই পদত্যাগ! কেন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?
শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। তাঁরা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানান প্রসিকিউশন। অন্যদিকে, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনই ছিলেন এই মামলার একমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামি, যিনি পরে রাজসাক্ষী হয়ে ওঠেন। আইনজীবীরা জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে কোনো আসামির ‘অ্যাপ্রুভার’ হওয়ার আবেদন এই প্রথম। মামলার সত্য উদ্ঘাটনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় তাঁর সাজা হ্রাস করে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের পুনর্গঠন ও মামলার সূচনা
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠনের পরই জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মিস কেস (মূল মামলার আগে করা একটি প্রাথমিক আবেদন বা নথি) গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
প্রথম অভিযোগ: উসকানি ও সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি
প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের 'রাজাকারের বাচ্চা' এবং 'রাজাকারের নাতি-পুতি' বলে উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এই বক্তব্যের পরপরই তাঁর প্ররোচনা এবং তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যুক্ত— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি মামুন এবং শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীরা’ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর ব্যাপক হামলা চালায়। ট্রাইব্যুনাল এটিকে পরিকল্পিত, পদ্ধতিগত এবং রাষ্ট্রীয় নির্দেশে পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে দেওয়া হয় ‘ইমপ্রিসনমেন্ট টিল ন্যাচারাল ডেথ’ অর্থাৎ আমৃত্যু কারাদণ্ড।
দ্বিতীয় অভিযোগ: হত্যার নির্দেশ, হেলিকপ্টার-ড্রোন ব্যবহার
ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা ও হত্যার নির্দেশ দেন। এই অপরাধকে গণহত্যার পর্যায়ে বিবেচনা করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তৃতীয় অভিযোগ: আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ট্রাইব্যুনালের মতে, আসামিরা এই ঘটনার ব্যাপারে জানতেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে এমন হত্যার নির্দেশ, উসকানি ও সহায়তা দিয়েছেন। পরিকল্পনা করে এই অমানবিক কাজটি করা হয়েছে। তাই এ অভিযোগটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
চতুর্থ অভিযোগ: চাঁনখারপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি চাঁনখারপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জন নিহত হন। আদালতের মতে, এই হত্যাকাণ্ড ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও পরিকল্পিত দমন পীড়নের অংশ। শেখ হাসিনা এই অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড পান।
পঞ্চম অভিযোগ: আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা
আশুলিয়ায় জীবিত একজন-সহ ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগও ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়। এই ভয়াবহ অপরাধে নেতৃত্বদাতা হিসেবে আবারও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন
কোথাও ৪০০০ কোটি, কোথাও ৫০০ কোটি! হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাজা
চাঁনখারপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার দু'টি অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি পলাতক থাকায় রায় অনুপস্থিতিতেই ঘোষণা করা হয়।
সাবেক আইজিপি মামুনের রাজসাক্ষী হওয়া
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ছিলেন একমাত্র আসামি যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত ১০ জুলাই তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে নিজের দোষ স্বীকার করেন এবং ‘অ্যাপ্রুভার’ হতে চান বলে জানান। ট্রাইব্যুনাল তাঁর দেওয়া পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও সত্য উদ্ঘাটনে সহায়তাকে গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির পরিবর্তে ন্যূনতম সাজা— পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, “তিনি তাঁর দোষ স্বীকার করেছেন এবং জুলাই-অগাস্টের সব অপরাধে রাষ্ট্রকে সহায়তা করেছেন।”
বিচারপ্রক্রিয়ার সময়রেখা
১ জুন: প্রসিকিউশন অভিযোগ দাখিল করে। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
১৬ জুন: বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ
২৪ জুন: তাঁরা হাজির না হওয়ায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে আমির হোসেনকে নিয়োগ
১ জুলাই: অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু
১০ জুলাই: পাঁচটি অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু
এতে উল্লেখ ছিল— ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়, হত্যা এবং পদ্ধতিগত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত।
পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, বিচারিক ও মানবাধিকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দমন-পীড়নের অভিযোগে প্রথম কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন কঠোর শাস্তি ঘোষণা করল আদালত।

Whatsapp
