কে কেড়ে নিল আমাদের সবকিছু? অভয়ার মা-বাবার খোলা চিঠি
RG Kar : সিবিআই যথাযথ তদন্ত করুক, দোষীদের সামনে আনুক এটাই আমরা চাইব। আমরা এর বাইরে আর কী বা বলব?
রাজ্যবাসীর প্রতি,
আমার মেয়ে একটা সুরক্ষিত জায়গায় রাজ্য সরকারের অধীনেই কর্মরত ছিল। সেদিন রাতেও তাঁর ডিউটি ছিল। সবাই শুধু বলছে, ও খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ল। আরজিকরে দু’বছর ধরে কর্মরত। আমি তো কোনোদিন শুনিনি যে রাত আড়াইটে-তিনটের সময় ও খাচ্ছে। যেদিন চাপ থাকত, বলে দিত, ‘মা, আমি এখন খাচ্ছি’। এরকমও দিন গেছে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ কী এমন হল? কী ঘটেছিল সেদিন যে ১২ টায় খাচ্ছি বলে ১:৩০ টায় খেয়েছে। কেউ বলছে, তারপরে আমরা জ্যাবলিং থ্রোও দেখছি। আদৌ কি আমার মেয়ে সেমিনার হলে ছিল? কোথায় ছিল আমার মেয়ে সেদিন? আমরা এখনও সেটা জানতেই পারলাম না।
৮ তারিখ সকালে ৮:১৫-তে আমার মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। সমস্ত কষ্ট এখন লুকিয়ে রাখি। আমাদের কষ্টটা আর কাউকে দেখানোর নেই। দেখাতে চাইও না। কারণ, আমার মেয়েটা আর ‘মা-বাবা' বলবে না। আদৌ কি আমাদের মেয়ে সেমিনার হলে ছিল? আমাদের সন্দেহ সবার উপর। গভীর চক্রান্ত করা হয়েছিল। ছ’মাস ধরে আমাদের মেয়ে চক্রান্তের শিকার। কিন্তু কারা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিল? কারা মেয়েকে ফিরে আসতে দিল না? কীসের রহস্য? এটা জানতেই এই লড়াই। আর যেন কোনো বাবা-মায়ের এই ৯ তারিখ দেখতে না হয়।
আমাদের মেয়ের এমডি গোল্ড মেডেলের ইচ্ছে ছিল। সেদিন রাতেও সে লিখে গিয়েছিল। তার জন্য ওর থেকে ১৫ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছিল। প্রিন্সিপাল চেয়েছিলেন। সন্দীপ ঘোষ চেয়েছিলেন। ওদের ভিসি চেয়েছিলেন। সব বলে গিয়েছিল। আমাদের পুরো সেলস ডিপার্টমেন্টের উপরেই সন্দেহ। সবার বিরুদ্ধেই আমার অভিযোগ।ডিপার্টমেন্টাল তদন্ত হলে সব রহস্য বেরিয়ে আসবে।
আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডে বিচারের দাবি, দেবীপক্ষেও প্রতিবাদের যে ঢেউ উঠল মহানগরে
সেদিন হসপিটালে বিনীত গোয়েল, সোফিয়া মল্লিক, মুরলীধর শর্মা, বড়ো-বড়ো পুলিশ আইপিএস লেভেলের অধিকর্তারা সবাই ছিলেন। আমরা দেখিনি, শুনেছি। আমরা সেমিনার হলে অনেক লোককে দেখেছি। ডিসি ইন্দিরা মুখার্জি, ফরেন্সিক এক্সপার্ট, এই এক্সপার্ট, সেই এক্সপার্ট– সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু পরে জানতে পেরেছি, তাদের সঙ্গে আর জি করের আদৌ কোনো যোগাযোগই নেই। অভীক দে, বিরুপাক্ষ বিশ্বাস, সোমনাথ দে– নাকি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। প্রসূন চট্টোপাধ্যায়– যে আমার মেয়ের মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে সব এভিডেন্স নষ্ট করেছে তাঁকে ক্রাইম সিনে দেখা গেছে। প্রশ্ন হল, তাহলে পুলিশ ওখানে কি করছিল? ক্রাইম সিনে যাঁরা জড়িত তাঁদের কি কোনো তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে? সেই রাতে যাঁরা ডিউটিতে ছিলেন তাঁদের মধ্যে চারজন আমার মেয়ের সিনিয়র ছিল আর চারজন জুনিয়র ছিল। তাঁদের কে কি এখনও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে? হয়নি। কেন আনা হয়নি তাঁরা ডাক্তার বলে? আমার মেয়েও তো ওখানের ডাক্তার ছিল। এর জন্যই বলছি, রহস্য রয়েছে অনেক।

ছবি: ফেসবুক
প্রথমে বলা হচ্ছিল, কলকাতা পুলিশ তথ্য-প্রমাণ লোপাট করেছে, তাই সিবিআই কিছু পায়নি। কিন্তু সিবিআই কোথাও লেখেওনি যে, কলকাতা পুলিশ তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে। ৭ অগাস্ট আমরা সিবিআই ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করি। এখনও বলা হচ্ছে, পুলিশ চারদিন কাজ করার পর আমরা তদন্ত করছি। তাঁরা দাবি করছেন, ডেড বডিটাও তো ছিল না যে আমরা সেকেন্ড পোস্টমর্টেম করাব। আমরা বললাম, কেন তাহলে আপনারা সেটাই বলছেন না? কেন সেটা লিখেই চার্জশিট দিচ্ছেন না যে পুলিশ সব তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছে? তখন তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ কী তথ্য প্রমাণ নষ্ট করেছে, সে তো আমরা জানি না। তাই আমরা এই নিয়ে কিছু লিখছি না। আমরা বললাম, আমরা তো এখানে আপনাদের তদন্ত শেখাতে আসিনি। ওই দিন ঘটনাস্থলে যাঁরা ছিল তাঁদের নাম বলছি, তাঁদের ধরুন। আমরা তো প্রমাণ তুলে দিতে পারব না। আমরা ক্লু তুলে দিতে পারি। আমাদের কাছে প্রমাণ থাকলে, আমরাই ধরে ফেলতাম। তাহলে আপনাদের থেকে আমরা আর কী সাহায্য নেব, এই বলে আমরা বেরিয়ে এসেছি।
কালকে আমি সিবিআইকে বলেছি সরাসরি যে, দেখুন, আসল খুনিরা এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের এখন কোর্টের লড়াই হচ্ছে সিবিআই ভার্সেস আমরা। তাঁরা বললেন, 'না না, এরকম বলছেন কেন? আমরা থেকে দিল্লি দৌড়ে এসেছি কেন? আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে'। এই যে এখানে কথা বলছি, আমাদের একটা কথাও আপনারা মানছেন না। এটা কি লড়াই নয়, এটাই তো লড়াই। কোর্টেও এটাই হচ্ছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে লড়াই করছি, আর বাকি যারা আসল অপরাধী তারা সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে কলকাতা পুলিশ যেটুকু করেছিল, সিবিআই তার বাইরে শুধু প্রিন্সিপালকে অ্যারেস্ট করেছিল, এবং টালা থানার ওসিকে অ্যারেস্ট করেছিল। কিন্তু দু’জনকেই ৯০ দিন যাওয়ার পরেও চার্জশিট দিতে পারেনি। কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছে যে আমরা চার্জশিট দেব না, আপনারা কী করবেন করুন। ছেড়ে দিয়েছে ওদের। একজন বেলে বাইরে আছে, একজন দুর্নীতি মামলায় জেলে আছে। আমাদের মামলায় এরা দুজন অভিযুক্ত নয় এখন আর। তাহলে কি এদের কোনো প্রমাণই না পেয়ে ধরে রেখেছিল ৯০ দিন?
মুখ্যমন্ত্রী আমাদের বাড়ি এসে বলেছিলেন, ‘আসল অপরাধী তো ধরেই ফেলেছি আমরা।’ আমরা তখন ওঁনাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলেছিলাম, ‘দিদি, যাঁকে আপনারা ধরেছেন। তাঁকে আসল অপরাধী বলে মনে করি না। কারণ একটা জনবহুল হসপিটাল, সেখানে আমার মেয়ে একটা সুরক্ষিত জায়গায় ডিউটিতে ছিল। সেখানে একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার এসে মেরে গেল। ভেতরের কেউ কিছু জানল না, এটা আমরা মানি না। এরকম একটা হসপিটালে খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় একা কেউ জড়িত থাকতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রীও আমার মেয়ের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নেমে বলেছিলেন, ‘দোষীদের সাজা হোক’। উনিও কিন্তু শুধু 'দোষী' বলেননি, বলেছিলেন দোষীদের। উনিও মনে করেছিলেন এই ঘটনায় একা কেউ জড়িত নন।
আরও পড়ুন- বিচার করবে কে? পশ্চিমবঙ্গের ২৫জন বিধায়কই যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত: রিপোর্ট
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আমাদের বাড়ির সামনে থেকেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অপরাধীদের কঠোর শাস্তি চাই আমি। আরও বলেছিলেন, নির্যাতিতাদের ফাঁসি চাই। ঘটনার ১০-১২ দিনের মধ্যে উনি নিজেই যখন মিছিল করলেন, তার হোর্ডিং-এও লেখা ছিল, অপরাধীদের শাস্তি চাই। কিন্তু পরবর্তীকালে সে-ই একজনই অপরাধী হয়ে গেল কী করে? সিবিআই সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসিকে অ্যারেস্ট করেও চার্জশিট দিল না কেন? সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন?

ছবি: ফেসবুক
সমাজকে বলতে চাই, আমাদের পশ্চিমবঙ্গটা ডুবে গেছে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে জল যাচ্ছে। এখন সাঁতার কাটতেই হবে। সব লোককেই জিনিসটা বুঝতে হবে, আজকে আমার সঙ্গে ঘটেছে, আগামীদিনে যে অন্য কারো সঙ্গে এই ঘটনা ঘটবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। যেমন আর জি কর-এর পর কসবা ল কলেজের ঘটনা। তামান্না বাড়ির সামনে উঠোনের মধ্যে খেলা করছিল, তাঁকে বোমা মেরে, মেরে ফেলা হল। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী অপরাধীদের প্রশ্রয় দেন। আর অপরাধীদের প্রশ্রয় দিয়ে অপরাধীদের দ্বারা ভোট করিয়ে, ক্ষমতায় থাকেন। উনি তো আর রোজগার করে মানুষকে দেন না। লক্ষ্মীভাণ্ডার তো উনি দিচ্ছেন না। আমাদের করের টাকা, আমাদের দিচ্ছেন। এই যে পুজো কমিটিগুলোকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিচ্ছেন, সবই মানুষের করের টাকা। এগুলো কি এইভাবে দেওয়া যায়? এগুলো মানুষকেই বিচার করতে হবে।
সিবিআই যথাযথ তদন্ত করুক, দোষীদের সামনে আনুক এটাই আমরা চাইব। আমরা এর বাইরে আর কী বা বলব? সিবিআই যে তদন্ত খেলা খেলছে, সেটা না করে প্রকৃত তদন্ত করুক। সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশ্যে বলার, সুপ্রিম কোর্ট কোনো স্বার্থে সুও-মোটো নিয়েছিল? তদন্ত প্রক্রিয়া চালানোর জন্যে কী গাইডলাইন দিয়েছে সিবিআই? সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে যে স্ট্যাটাস রিপোর্ট দিয়েছে, তার প্রতিফলনই বা কী? সুও-মোটো কী স্বার্থে নিল? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে বলার, কেন উনি অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন?

Whatsapp
