আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ এত তৎপর কেন? মুখ্যমন্ত্রীকে শতাব্দী দাশের খোলা চিঠি

R.G. Kar Protest : আমাদের দুর্ভাগ্য যে আপনার স্বৈরাচারের কারণেই হয়তো একদিন এই রাজ্য ফ্যাসিবাদীদের হাতে চলে যাবে। তারাই নাকি ‘বিকল্প’।

SD

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী,

সংবিধান অনুসারে বিধানসভায় আপনি নাগরিকের প্রতিনিধি। রাজার সঙ্গে প্রজার যে-সম্পর্ক, গণতান্ত্রিক দেশে তেমন সম্পর্ক আমাদের নয়। সমষ্টির সঙ্গে সমষ্টির প্রতিনিধির যে-সম্পর্ক, তার ভিত্তিতে এই খোলা চিঠি লেখা সমীচীন মনে হল। সরকার ও নাগরিকের সম্পর্কের প্রকৃতি-বিষয়ে পূর্বোক্ত কথাগুলি স্মরণ করিয়ে দিতে হল, কারণ ইদানীং রাজ্যটাকে রাজ্য সরকারের জমিদারি মনে হয় ৷ একসঙ্গে এত দপ্তর কীভাবে সামলান, তা অধমের জানা-বোঝার বাইরে। আইনরক্ষকের ভূমিকার উপর নির্ভর করে রাজ্যের ভালোমন্দ, নাগরিকের সুরক্ষা। মুখ্যমন্ত্রীত্বের পাশাপাশি একটা গোটা পুলিশমন্ত্রক চালানো, রাজ্যের আইনরক্ষার লাগাম ধরে থাকা, কম কথা নয়। অন্যদিকে, শিক্ষার মতো স্বাস্থ্য-পরিষেবাও নাগরিকের অধিকার, ব্যক্তির জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত একটি ব্যাপার। এই ত্রিমন্ত্রিত্বের অন্তত একটা সুফল বোঝা গেল এতদিনে, তা হল এই যে, একজন মাত্র ব্যক্তিকে একটি মাত্র খোলা চিঠি লিখলেই চলে।

আরও পড়ুন-

মণিপুর থেকে মুর্শিদাবাদ: মেয়েদের লাঞ্ছনাতেই উগ্রবাদীদের জয়?

এক বছর হয়ে গেল অভয়াকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা জানি, এ-সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি একটাই উত্তর দেন, ‘সিবিআই দেখছে’। এইটা যে রক্ষাকবচ, তা আমরা বুঝি। কিন্তু সিবিআই-এর কাজ যেমন তদন্ত, তেমন পুলিশমন্ত্রক, স্বাস্থ্যমন্ত্রক ইত্যাদিরও নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকা থাকে। কর্তব্য থাকে। তাই প্রথমে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কয়েকটি প্রশ্ন করা যায়। ধর্ষণ ধামাচাপা দেওয়ায় মূল অভিযুক্ত সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সারা শহর যখন ক্ষোভে ফুটছে, তখন হে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আপনি সামান্য সাসপেনশনটুকু করতে রাজি ছিলেন না ততদিন, যতদিন না সিবিআই সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করে ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তিনি বরখাস্ত হন। আঁতাত কি এমন করে প্রকাশ্য করতে আছে?

অভয়াকাণ্ডে পর সাধারণ মানুষের রাতদখল

সেমিনাররুমে অর্থাৎ অকুস্থলে ৯ অগাস্ট সকালে আপনারই স্বাস্থ্যদপ্তরের যে কর্মীদের, অর্থাৎ যে ডাক্তারদের ভিড় করতে দেখা গিয়েছিল, যারা এসেছিল পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্ত থেকে, তাদের কি আপনি শোকজ করেছিলেন ?বরখাস্ত দূরস্থান। আপনার মন্ত্রকের অধীনস্থ হাসপাতালে আপনার কর্মীরা রহস্যজনকভাবে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে চলে এল ধর্ষণের অব্যবহিত পর, তা যদি ধামাচাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়, তাহলে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য-পরিষেবায় তাদের উপস্থিতি অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতাকে ডেকে আনবে না তো?

জাল ওষুধ, সিন্ডিকেট, মেডিক্যাল কাউন্সিলের ভোটের প্রহসন, ভেজাল স্যালাইনে মাতৃমৃত্যু… স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আসলে আমাদের অনেকগুলি প্রশ্ন করার আছে। কিন্তু আজ থাক। আজ বিষয় হোক শুধু মৃত মেয়েটি, সংবিধান-মতে যার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। শিয়ালদা কোর্টের রায়ে স্পষ্ট লেখা, বক্ষ বিভাগের চিকিৎসক সুমিত রায় তপাদার জানিয়েছেন যে, তিনি তৎকালীন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষকে অভয়ার মৃত্যুর কথা জানালে সন্দীপ ঘোষ সেই মুহূর্তেই মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে দিতে বলেন। আপনাকে প্রশ্ন করছি, প্রথমে পোস্টমর্টেম এড়িয়ে যেতে চাওয়া হল কেন? সন্দীপ ঘোষের কাছ থেকে এই জবাবদিহি চেয়েছেন, হে স্বাস্থ্যমন্ত্রী? সুচরিতা নামের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার কেন অভয়ার মা বাবাকে আত্মহত্যার কথা বলেছিল, সে-ব্যাপারেও কি তার কাছে জবাবদিহি চেয়েছেন? এরা সবাই আপনার মন্ত্রকের অধীনস্থ হাসপাতালের কর্মী যে!

আরও পড়ুন-

মণিপুর থেকে মুর্শিদাবাদ: মেয়েদের লাঞ্ছনাতেই উগ্রবাদীদের জয়?

এই যে সুপ্রিম কোর্ট বলল, পোস্টমর্টেম-এ অস্বাভাবিক দেরি দেখা যাচ্ছে, মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী জানাবেন, কেন এই দেরি? হাসপাতালে মৃত্যু ঘটল, আপনার হাসপাতালে… পরদিনও সারাদিন ময়নাতদন্ত হল না। তারপর ‘অসাধারণ মামলা’ হিসেবে সূর্যাস্তের পর পোস্টমর্টেম করা হল। কেন এই অসংগতি? অন্যদিকে, দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম করার সুযোগ না-দিয়ে তড়িঘড়ি অভয়ার শবদেহকে দাহ করা হল। ধর্ষণের সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ নির্যাতিতার দেহ। সেটাকে নষ্ট করা হল কেন? পরের প্রশ্নটা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করব না পুলিশমন্ত্রীকে, সেটাই বুঝতে পারছি না। ভাগ্যিস একঅঙ্গে এত রূপ, তাই এক জায়গায় প্রশ্ন করলেই চলছে। অভয়ার বাবা-মা আর জি কর মেডিকেল কলেজের সেই কুখ্যাত সেমিনাররুমে পৌঁছানোর পরেও, বহুক্ষণ তাঁদের মেয়েকে নাকি দেখতে পাননি। শেষ পর্যন্ত নাকি দেখতে পেয়েছিলেন বেলা তিনটের পর। কেন পুলিশ ঢুকতে দেয়নি তাঁদের? নাকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ-ই ঢুকতে দেয়নি? দুটোই তো আপনার মন্ত্রক! কী উত্তর দেবেন আপনি? পুলিশকে হাতে রাখা যে সরকারি স্বেচ্ছাচারের প্রাকশর্ত, সে-শিক্ষা কি পূর্বতন সরকারের থেকে পেয়েছিলেন? সিপিআইএম কালের রিজাওয়ানুর কাণ্ডে জড়িত ও নিন্দিত পুলিশ অফিসারটি, শোনা যায় এখন আপনার প্রিয়জন।

অভয়ার ঘটনায় ফিরে আসি। ডিসি নর্থ অভিষেক গুপ্তা অভয়ার মা-বাবাকে টাকা দিতে চেয়েছিলেন কার নির্দেশে ও কেন? এত টাকা তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আপনি কিছু জানেন? ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় প্রেস কনফারেন্সে ড. অভীক দে-কে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি তো তা নন! কেন এবং কার নির্দেশে তিনি মিথ্যে বললেন? মিথ্যে বলার জন্য তাঁরও কি শো কজ হয়েছে? অভয়া মামলার তদন্ত ভুল-পথে চালনা করার অভিযোগে সিবিআই টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে। আদালতে সিবিআই দাবি করে, ধর্ষণ ও হত্যার পিছনে যে বড়োসড়ো চক্রান্ত চলছে, তার সঙ্গে তিনি যুক্ত। কলকাতা পুলিশের একাধিক থানার ওসি ও ট্রাফিক গার্ড তাঁদের প্রোফাইল ছবি কালো করে ফেলেন সেদিন। তাঁরা কি তার অপরাধকে সমর্থন করছিলেন নাকি তাকে বলির পাঁঠা বানানোর প্রতিবাদ করছিলেন? আপনার পুলিশ কেন অভয়ার বাবা-মার অনুমতি ছাড়া শবদেহ নিয়ে তাঁদের বাড়ি চলে গেল এবং ন্যূনতম সময় সেখানে রেখে দেহ নিয়ে শ্মশান ঘাটে উপস্থিত হল?

অভয়াকাণ্ডের প্রতিবাদে গণআন্দোলন

পুলিশ নাকি অপরাধস্থল থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা, পিউবিক কম্বিং এবং ভিকটিমের পরিধেয় বস্ত্র, সংগ্রহে ব্যর্থ হয়? এই দুটি নমুনা তারা অনেক পরে, অগাস্টের ১২ তারিখ ড. অপূর্ব বিশ্বাসের (যিনি ময়নাতদন্তকারী ফরেনসিক দলের সদস্য ছিলেন) থেকে সংগ্রহ করে। কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে, 'লেবেলিং ত্রুটি', যা সংশোধন করতে নাকি দু'দিন সময় লেগেছে। এই ‘ত্রুটির’ দায় ডাক্তারের হোক বা পুলিশের, দু-জনেই তো আপনার মন্ত্রকের অধীনে কাজ করেন! সেদিন রাতে চেস্ট ডিপার্টমেন্টে কারা ডিউটিতে ছিল? বলা হচ্ছে, তাদের নাকি পুলিশ জেরা করেনি! অভয়ার সঙ্গে এদেরই শেষবার দেখা হয়েছিল এবং এদের সঙ্গে অভয়া শেষবারের জন্য জোমাটো থেকে অর্ডার করা খাবার খেয়েছিলেন বলে জানা যায়। খাবারের অবশিষ্টাংশ, প্যাকেট কি সংগ্রহ করে করেছিল কলকাতা পুলিশ? জোমাটোর সেই ডেলিভারি বয়কে ডেকেছিল? প্রশ্ন আরও অনেক!

পুলিশমন্ত্রীকে শেষ প্রশ্ন, আপনার পুলিশ আন্দোলনকারীদের থামাতে অতি-তৎপর কেন? ‘রাতদখলের’ ইনডোর ওয়ার্কশপেও তারা কেন আসে? কেন এখনও বারবার ড. কিঞ্জল নন্দ, ড. অনিন্দ্য মন্ডল আর সিনিয়র ড. কৌশিক চাকিকে থানায় ডেকে হেনস্থা করা হয়? তাছাড়া, তৃণমূল দলের প্রধান হিসেবে কি আপনি জানেন, অভয়ার মা-বাবা-সহ পরিবারের এতজন লোক থাকা সত্ত্বেও ঘাট সার্টিফিকেটে স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জীব মুখার্জির স্বাক্ষর কেন রয়েছে? কোন অধিকারে সঞ্জীববাবু তড়িঘড়ি করে অভয়ার সৎকার করান? দাহ-তে তাড়াহুড়ো করার ব্যাপারে কেন আরও আসছে তৃণমূলের নেতা ও বিধায়ক নির্মল ঘোষের নাম?

শেষে, হে মুখ্যমন্ত্রী, আপনাকেও কিছু বলার থাকে! ‘নারীরাও পিতৃতন্ত্রের ধারক’—এ-কথা বোঝাতে আপনার উদাহরণ আজকাল ব্যবহার করা হয়, এ কি আপনি জানেন? সুজেট সম্পর্কে ‘রেটে পোষায়নি’ তত্ত্ব, হাঁসখালি সম্পর্কে ‘ওদের রিলেশন ছিল’ তত্ত্ব আপনি দিয়েছিলেন। এসব ভিক্টিম ব্লেমিং আমরা আগের সরকারের আমলেও দেখেছি। কিন্তু কেউ-কেউ আশা করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী 'মহিলা' হলে চিত্র পালটাবে। দেখা গেল, চিত্রটা ভয়ানকতর হল! আপনার কাছে সংবেদনশীল আচরণ তাই আশা করা হয়নি অভয়ার ক্ষেত্রেও। আশা করা হয়েছিল অন্তত মুখরক্ষার খাতিরে প্রিয় শাগরেদদের আপনি বলি দেবেন। ক্ষমতার দর্পে সেটুকুও করেননি। লোক-ঠকানো ‘অপরাজিতা বিল’ এনেছেন তার বদলে। ধর্ষকের শাস্তি তীব্র করে লাভ কী হবে? ধর্ষক জানে, দলের ছত্রছায়া মাথায় থাকলে তাকে দল বাঁচানোরই চেষ্টা করবে। দশজনের মধ্যে ন’জন যদি বেকসুর খালাস পায় আর একজন যদি কঠোরতম শাস্তিও পায়, তাহলেও ধর্ষণ আদৌ কমবে? না, না কমবে না৷

আমি ‘রাতদখল ঐক্যমঞ্চের’ একজন কর্মী। ‘রাতদখলের’ অন্যতম আহ্বায়ক। ‘রাতদখল ঐক্যমঞ্চ’ আপনার পদত্যাগ নিয়ে গলা ফাটায়নি। শুধু কৈফিয়ত চেয়েছিল নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে। কিছু দাবি পেশ করেছিল, যা পূরণ হলে হয়তো নারী, ট্রান্স ও ক্যুয়ার মানুষদের উপর অত্যাচার কমত। আপনার পুলিশ সমস্ত প্রক্রিয়াটাই বানচাল করতে চেয়েছিল। আদালতে আপনার সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র আমাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, যাতে দাবির মিছিল আটকানো যায়। একটা ধর্ষণ ঘটল, হত্যা ঘটল, অথচ যাদের সঙ্গে রোজ যৌননির্যাতন ঘটে, সেই মেয়ে, ট্রান্স আর ক্যুয়ার মানুষদের আপনি স্টেকহোল্ডারই মানেননি। আমরা শেষপর্যন্ত দাবি সনদ জমা দিয়েছিলাম। পুলিশ-ই কোর্টের অর্ডার অনুযায়ী আমাদের নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল আইন দপ্তরে। সে-দাবি কি ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন, হে মুখ্যমন্ত্রী? সে-দাবিগুলো মানা হলে, আইসিসি সক্রিয় হত। আর সেসব হলে কসবার কলেজে ফের ধর্ষণ ঘটত না। ফের আপনার মুখ পুড়ত না।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে আপনার স্বৈরাচারের কারণেই হয়তো একদিন এই রাজ্য ফ্যাসিবাদীদের হাতে চলে যাবে। তারাই নাকি ‘বিকল্প’। তবে প্রতিরোধের যে-অভ্যাস বর্তমান স্বৈরাচার তৈরি করেছে, বিশেষত বিগত এক বছর ধরে, তা আমাদের সেই সময়েও কণ্ঠ ছাড়তে সাহায্য করবে। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন নাগরিক স্পর্ধাকে অবধারিত করে তোলার জন্য৷

ইতি,
একজন মেয়ে নাগরিক।

More Articles