হিন্দিও এক 'বাংলাদেশি' ভাষা
Bangladeshi: আসলে খাদ্য, বস্ত্র, অর্থনীতি, লোকাচার, সংস্কৃতি, স্থাননাম ভারতীয় জনজীবনের সর্বত্র আরবি ফারসির সহজাত ভাবেই ঢুকেছে। বাংলা হোক বা হিন্দি, ভাষাকাঠামোকে সমৃ্দ্ধ করেছে।
নুন খাই তাই গুণ গাই। কাজেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন দিল্লি পুলিশ যখন বাংলাদেশি ভাষা নামক জুজু আমদানি করছে, বাংলাভাষী নিম্নবিত্ত মুসলিম মজুরদের যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে, বিজেপি নেতাদের মুখে কুলুপ, অথবা তাঁরা চেষ্টা করছেন যুক্তি সাজাতে। কিন্তু এই সমস্তই হচ্ছে, মিডিয়াবান্ধব পরিবেশে, সান্ধ্য হইহল্লার মধ্যে। যে মানুষ এই আলোকবৃত্ত থেকে দূরে, সে কী জানবে? যে 'তথ্য' আগে আসে চা দোকানে তা-ই হয়ে যাবে পরম সত্য? আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কি ভাষার বহতা সম্পর্কে জানার বোঝার কোনো পথ খোলা রয়েছে?
থাকলে নিশ্চয়ই জানা যেত, বাংলা বলে কোনো ভাষা নেই এমনটা যিনি বলছেন, তাকে সপাট সমুচিত বক্তব্যে জানান দেওয়া যেত আসলে হিন্দি বলেই কোনো ভাষা নেই। এই ভাষা কাঠামো তৈরি হয়েছে ঋণশব্দে ভর করে। হিন্দি শব্দকোষের ২৫ ভাগই হল আরবি। সাধারণ ভাবেই রোজের কথাবার্তায় ব্যবহৃত হয় এইসব আরবি শব্দ। ওয়াক্ত, কলম, করিব, আমির, গরিব, দুনিয়া, কিল্লা, আখবারা, কুর্সি, শরবত, জরুরি, কবুল, খাস, তকলিফ, দিমাক, আদাব, ইন্তেজার, মসুর, ইজাজতস, আশিক, মজদুর, ইশক, মুরাব্বা, খাস, সুলতানাত, ইন্তেজার, সহি, গলত, কবুল এমন কত উদাহরণ রয়েছে। হিন্দিতে বহু প্রশাসনিক শব্দ এসেছে আরবি থেকে। যেমন জিল্লা, তহশিল, পরগণা। আদালত চত্বরে, নথিতে বহু শব্দ যা আজও ব্যবহৃত হয়, তা আসলে আরবি থেকেই নেওয়া, যেমন ধরা যাক, ওকালত, ফরিয়াদ, মহাসির, হারজি।
ভূগোল বইয়ে পড়েছি ভারতের কৃষিপণ্যকে যে ফলনের সময় অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা খারিফ ও রবি শষ্য। এই শব্দদুটিও আরবি থেকেই নেওয়া।
শুধু আরবিই নয়, ফারসির থেকেও সমানভাবে ঋণী হিন্দি ভাষা। হামেশা, হরদম, সফেদ, দূর, পাস, শায়দ, খারাব, রদ্দি, খুশ, হুশয়ার, জাওয়ান, তন্দরুস্ত, গরম, বিমার, আসান, গন্দা, ইমান্দার এমন চালু শব্দগুলি কি অমিত মালব্যরা ব্যবহার করেন। করলে তাঁর লজ্জিত হওয়া উচিত। কারণ তাঁর মাতৃভাষা কোনো কৌমার্য্য নেই, এসব শব্দই সে গ্রহণ করেছে পারসি থেকে। এই যে বলছি লজ্জা, চালু হিন্দি লব্জে শরমিন্দা, এও একটি পারসি শব্দ।
আরও পড়ুন- বেছে বেছে বাঙালিকেই ঘাড়ধাক্কা! বিধানসভা ভোটে ‘কি ফ্যক্টর’ বাংলাদেশি জুজু?
ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জহরলাল নেহরু। 'জহর' শব্দটিই একটি আরবি শব্দ। সৌদি আরবের রাজা ফাদের স্ত্রী ছিলেন জওহিরা। জওহরলাল ১৯৬২ সালে চিন যুদ্ধের পর কেঁদে ফেলেছিলেন 'এ মেরি ওয়াতন কি লোগো' শব্দটি শুনে। সেই 'ওয়াতন' শব্দটিই আরবি। আরবি-ফারসি শব্দ শুধু উত্তর ভারতের লব্জেই মিশে যায়নি, নিশ্চুপে চলে গিয়েছে দক্ষিণেও। কেউ কেউ বলেন, কেরলা রাজ্যটিকে আরবি শব্দবিদরা খইর আল্লা— এভাবে ভাঙেন। এর অর্থ ইশ্বরের নিজস্ব তালুক।
'সিঙারা'কে হিন্দিতে বলে সামোসা। এই শব্দটিও ফারসি। আমিক খসরু. ইবন বতুতার লেখায় এই খাবারটির কথা আছে। আছে জিলিপির কথাও। নান, বিরিয়ানি, কাবাব, কোর্মা, নামে এবং স্বাদে কোনোটাই বিশুদ্ধ হিন্দুস্তানি নয়। আশা রাখা যায়, অমিত মালব্যরা এগুলি চেখে দেখেন না।
শুধু হিন্দিই নয়, ভারতের বহু আঞ্চলিক ভাষাতেও আরবি ফারসির প্রবল প্রভাব লক্ষ্যণীয়। নরেন্দ্র মোদির মাতৃভাষা গুজরাটিও বিশুদ্ধ শাকাহারি দেশি নয়। মূলত তিন ধরনের গুজরাটির ব্যবহার ছিল স্বাধীনতা পূর্ববর্তী গুজরাটে। হিন্দি গুজরাটি, পারসি গুজরাটি, এবং মহামেডান গুজরাটি। হিন্দি গুজরাটি ব্যবহারকারী ব্রাক্ষ্মণ ও শ্রেষ্ঠীরা নিজের মুখের ভাষাকে সামনে রেখে বাকি দুই ধরনকে ক্রমাগত চেপে দেওয়ার কাজটা সফল ভাবে করেছেন। হরফের ক্ষেত্রে গুজরাটে মূলত দেবনাগরীই ব্যবহৃত হয়। যদিও বেশ কিছু মুসলিম পরিবার এখনও আরবি হরফও ব্যবহার করেন। 'Lisan ud-Dawat' শব্দটির অর্থ জমায়েতের ভাষা। এখনও দাউদি বোহরা ও আলভি বোহরা গোষ্ঠীর মানুষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জমায়েতে যে ধরনের শব্দ সেতু হিসেবে ব্যবহার করে তার বেশিটাই আরবি ফারসি ঘেঁষা। এখান থেকেই বোঝা যায়, গুজরাটি যে পুরোটাই সংস্কৃত নির্ভর এই মিথটি ভ্রান্ত।
উত্তর ভারতে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রাকৃত ভেঙে অপভ্রংশ ভাষা তৈরি হয়। ১১০০ খ্রিস্টাব্দের আগে-পরে ভারতে সুলতানি শাসনের ক্রমপ্রসারণের ফলে ফারসি ও আরবি মিশতে থাকে স্থানীয় অপভ্রংশের সঙ্গে। এই শব্দের মিশ্রণ আরও বাড়ে মুঘল আমলে। যেহেতু আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারতেও সাম্রাজ্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাই দাক্ষিণাত্যেও এই ভাষার অলংকার ছড়িয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত, ১৮০০ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হলে অপভ্রংশের উত্তরসূরী হিসেবে তৈরি হতে থাকে খড়িবোলি। পূর্ব ভারতের তথাকথিত হিন্দু উচ্চশ্রেণি এই খড়িবোলি ব্যবহার করত। এরই সমান্তরালে আবার গড়ে ওঠে উর্দু। খড়িবোলির প্রমিত, সংকর রূপ হিন্দি (সংস্কৃত, আরবি, ফারসির সংমিশ্রণ)।
আরও পড়ুন- বাঙালির রক্তে স্বাধীন হওয়া ভারতে, আমরাই গণহত্যার দ্বারপ্রান্তে
গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষায় প্রায় সোয়া লাখ শব্দ আছে। এর মধ্যে ১০ হাজার আরবি-ফারসি, এক হাজার ইংরেজি ও ৪০০ তুর্কি শব্দ আছে। কারো কারো মতে, বাংলার ৩০ শতাংশ শব্দ হচ্ছে আরবি। মোটামুটি ভাবে বাংলায় আসা আরবি ফারসি শব্দকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- প্রশাসনিক ও আইন, ধর্ম সম্পর্কীয় শব্দ, শিক্ষা-সংক্রান্ত, সংস্কৃতি ও বিবিধবিষয়ক। বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আরবি ফারসি (উর্দু শব্দের অভিধানটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ড. মোহাম্মদ হারুন রশিদ, বাংলা একাডেমি ঢাকা)।
আসলে খাদ্য, বস্ত্র, অর্থনীতি, লোকাচার, সংস্কৃতি, স্থাননাম ভারতীয় জনজীবনের সর্বত্র আরবি ফারসির সহজাত ভাবেই ঢুকেছে। বাংলা হোক বা হিন্দি, ভাষাকাঠামোকে সমৃ্দ্ধ করেছে। হিন্দুস্তানের তোতা বলা হতো আমির খসরুকে। তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে পারসি আর আদি হিন্দি মিলেমিশে একাকার। আসলে ভাষার শতফুল এভাবেই বিকশিত হয়। ভাষা নামক নদী এভাবেই উৎস থেকে অজস্র ছোট বড় প্রবাহকে ধারণ করে নিজেকে মেলে ধরে। মির্জা গালিব, কাজী নজরুলের শব্দ-বাক্য ব্যবহার সেই সমৃদ্ধির চূড়ান্ত প্রদর্শন।
এসব কথা অমিত মালব্যরা মানবেন না। কারণ যুক্তি আর হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির দূরত্ব বিস্তর। কিন্তু আপনি-আমি? এক ভাষা-ছাদে দাঁড়ানো মানুষের দিকে হাত বাড়ানোর দায়িত্ব কার?

Whatsapp
