অভয়াকাণ্ডের ঠিক পরেই কী কী ঘটেছিল আর জি কর হাসপাতালে?
RG Kar Medical College and Hospital : এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার জায়গা যেমন আছে, ঠিক সেইরকম আন্দোলনের প্রাপ্তির জায়গাও আছে। এবং সেই প্রাপ্তি এক অনন্য নজির গড়ে ছিল।
অভয়া আন্দোলনের প্রতি,
অভয়া আন্দোলন সম্পর্কে সবার প্রথম বলতে হয়, এই আন্দোলনটা আজকে যে ব্যাপ্তি বা প্রসারতা অর্জন করেছে, তার শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল? ঘটনাটি যখন আমি জানতে পারি, তখন প্রায় সকাল ৯ টার কাছাকাছি। আগের দিন আমার নাইট ডিউটি ছিল। শোনার পর, একটাই প্রশ্নটা মনের মধ্যে এসেছিল যে, একটা হসপিটাল ক্যাম্পাসের ভিতরে এইরকমের নারকীয় ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? এর পিছনে উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে? প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, একটা মেডিক্যাল কলেজের অভ্যন্তরে একজন ফিমেল চিকিৎসক পড়ুয়ার সঙ্গে এ-ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে! তারপর ঘটনাটা যখন বিভিন্নভাবে প্রকাশ্যে আসতে থাকে, বিভিন্ন সিস্টারদের মুখে শুনতে থাকি, প্যারামেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে শুনতে থাকি, সবার মুখে যখন কথাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করি। সেটা হচ্ছে যে নার্সিং পড়ুয়া, আমার মহিলা সহকর্মীরা, যাদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করি, যারা ছাত্রী, তাদের সবার চোখেই রয়েছে একটা অদ্ভুত চাহনি, যেন একটা অদ্ভুত অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত হসপিটাল ক্যাম্পাসটা জুড়ে।
আরও পড়ুন-
রাত দখল শুধু শহুরে মেয়েদের? আজও ডাইনি সন্দেহে খুন হওয়া মহিলাদের কথা বলবে কে?
আন্দোলন কীভাবে শুরু হল? শুরুর দিনের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জায়গাটা প্রথমে মনে আছে, সেটা হলো যে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে জুডিশিয়াল ইনকোয়েস্ট এবং পোস্টমর্টেম দাবি করা। এই দাবি যদি আমরা না করতাম, তাহলে অভয়ার ঘটনাকে রেপ-মার্ডারের বদলে কেবল এক আত্মহত্যার ঘটনা হিসেবেই সকলে জানতেন। এ-কথার প্রমাণ, বিষয়টির ক্ষেত্রে শিয়ালদহ কোর্টের বিচারক ১৭৭ পাতার জাজমেন্টে জুনিয়র ডাক্তারদের সাহসী ভূমিকার কথা লিখেছেন। প্রথম দিনের, প্রথম মুহূর্তের কথা যদি মনে করতে হয়, তাহলে এই কথাই মনে আসে। ম্যাজিস্ট্রেট ইনকোয়েস্টের দাবি কেন করেছিলাম? আমরা দেখলাম যে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থার ওপর উপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। সন্দীপ ঘোষের জামানাত সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই অবগত ছিলাম। দ্বিতীয়ত, কলকাতা পুলিশের দিক থেকে কোনো সদুত্তর আমরা পাচ্ছিলাম না। এই সমস্ত জায়গা থেকে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল।

আরজিকর মেদিকেল কলেজ
দ্বিতীয়ত, যখন পোস্টমর্টেম হয়, বডি চলে যায়, সেই নিয়ে নানান বিতর্ক আপনারা সবাই সংবাদমাধ্যমে দেখতে পেয়েছেন। যখন ৯ তারিখের পর, ১০ তারিখের কর্মবিরতি আমরা ঘোষণা করলাম, এরপর আমরা কী দাবি রাখব, সেই দাবি-দাওয়া নিয়ে যখন জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে নানান আলোচনা হচ্ছে, সেখানেই প্রথম ঠিক হয় যে একটা মঞ্চ তৈরি করা প্রয়োজন। কিন্তু মঞ্চ তৈরি করতে গেলে আর জি করের ভিতরে সন্দীপবাহিনীর যে থ্রেট কালচার, সেই থ্রেট কালচারকে অতিক্রম করতে হবে। এখানে বিশেষভাবে বলতে হয়, সে-সময়ের নার্সিং পড়ুয়ারা ইমার্জেন্সি গেটের সামনে এসে আমাদের পিজিটিদের খুবই সহায়তা করেন এবং সবাই মিলে আমরা বিক্ষোভ শুরু করি। থ্রেট কালচারের চোখে চোখ রাঙিয়ে, তাঁরা ওখানে আন্দোলন চালিয়ে গেলেন, এ জন্য নার্সিং পড়ুয়াদের কাছে সত্যিই একজন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
আরও পড়ুন-
সঞ্জয়ের শাস্তিতেই মামলা শেষ নয়! আরজি কর কাণ্ডে আরও তদন্ত করবে সিবিআই?
অভয়ার ন্যায় বিচারের জায়গা থেকে আমি কৃতজ্ঞ আমাদের আর জি কর মেডিকেল কলেজের পিজিটি আরিফ'দা, আসফাক, রক্তিম, লহরী, প্রিয়া লাকরা, শিবম, সৌরভ, হাসান'দা, অতনু, দেবল, পারমিতা, এইরকম অগণিত মানুষের কাছে। আমরা সবাই মিলে একটা জায়গায় সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা এই লড়াই লড়ব, এই আন্দলনের অবস্থানকে এগিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু আশ্চর্যের সমাপতন বলা যায়, ১০ তারিখের জিবি-র ভিতরে বিভিন্ন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দিক থেকে উঠে আসা দাবিগুলিকে। তাঁরা বলেন, “প্রিন্সিপালের পদত্যাগ আমরা চাইছি না কেন? এমএসবিবি-র পদত্যাগ আমরা চাইছি না কেন? অ্যাকাউন্টেবিলিটির প্রশ্নে প্রিন্সিপাল-এমএসবিপিকে আমরা সরানোর কথা বলছি না কেন?” খুবই যৌক্তিক ও গুরুত্বপূর্ণ এইসব প্রশ্ন। আজকের এই চিঠি লেখার সময়, এঁদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই ভোলা যায় না। দ্বিতীয়ত, আরজিকরের ওই সময়ের প্রিন্সিপাল, এমএসবিপি-র ডিন, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার এবং এইচ ও ডি রেস্পিরেটরি মেডিসিন, এঁরা যাতে কোনোরকম কোনো পদে না থাকতে পারে, কোনো-না-কোনো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পোস্ট হোল্ড না করতে পারে, সেই দাবি আমাদের ছিল এবং সেই দাবি সম্পূর্ণভাবেই পূরণ হয়েছিল। এই গেল অ্যাকাউন্টেবিলিটির প্রশ্ন, দায়ভারের প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, কলকাতা পুলিশের ভূমিকা, টালা থানার ভূমিকা, সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা। এঁরা কেউই কোনও সদর্থক ভূমিকা পালন করেনি। এমনকি সিবিআই-এর মতো তদন্তকারী সংস্থাও তাঁদের ভূমিকা ঠিকভাবে পালন করেনি। হিসেবে তাদের ভূমিকা যে তারা নেয়নি, সেই ভূমিকা স্পষ্ট। চতুর্থত, এ-আন্দোলনের মধ্যে দিয়েও, অভয়ার মৃত্যু আমাদের কাছে যে শিখিয়ে গেছে যে শিরদাঁড়া সোজা রাখতে হবে, অন্যায়কে 'অন্যায়' বলতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সেই জায়গা থেকেই বলতে হয় যে এই যে পোস্টিং বিতর্ক, জাল ওষুধ, ভেজাল ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে জুনিয়র ডাক্তারদের যে সাহসী এবং চোখে চোখ রাখাই লড়াই, সেই লড়াই কিন্তু এই আন্দোলনই আমাদেরকে শিখিয়েছে।

অভয়াকাণ্ডে রাস্তায় অবস্থানকারী পড়ুয়ারা
পঞ্চম প্রাপ্তির কথা যদি বলতে হয়, আজ সন্দীপ ঘোষ জেলে, আশিষ পান্ডে জেলে, তার সহযোগীরাও আজকে জেলে। কীসের দাবিতে? স্বাস্থ্য-দুর্নীতির দাবিতে। তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা ঠিক কেমন ছিল? কোন জায়গায় ছিল? কোন কাঠগড়াতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে? সেই জায়গাটা আজ দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই স্বাস্থ্যদুর্নীতিকে কেন্দ্র করে এক অসম লড়াই আমরা লড়েছি। ষষ্ঠ কথা হল, এ-আন্দোলনের অন্যতম প্রাপ্তি নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ, কল্যাণী মেডিকেল কলেজ, বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজ, বর্ধমান মেডিকেল কলেজ, মালদা মেডিকেল কলেজ, আর জি কর মেডিকেল কলেজ, এন আর এস মেডিকেল কলেজ, সাগরদত্ত মেডিকেল কলেজ, সমস্ত মেডিকেল, জে এন এম কল্যাণী, সমস্ত মেডিকেল কলেজের যে থ্রেট কালচার ছিল, সেই থ্রেট কালচারকে সারা বাংলার সামনে প্রকাশ করে দেওয়া।
আমাদের আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় অভয়ার ন্যায় বিচারের যে দাবি আমরা করেছিলাম, সেখানে আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে এই ঘটনায় জড়িয়ে আছে একাধিক ব্যক্তি। সেই দাবি আমরা প্রমাণ করতে পারিনি। কিন্তু লড়াই এখনও চলছে। দ্বিতীয়ত, সাপ্লিমেন্টারি চার্জ সিট দেওয়ার প্রশ্ন রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে, সিবিআই এখনও সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেয়নি। সেই দাবিতে আমাদের লড়াই চলছে। তৃতীয়ত, থ্রেট কালচারকে সম্পূর্ণরূপে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মুছে ফেলার জন্য আমরা বলেছিলাম যে ছাত্র সংসদ-এর নির্বাচন প্রয়োজন। কিন্তু হ্যাঁ, আমরা এখনও ছাত্র সংসদ নির্বাচন মেডিকেল কলেজগুলোতে, ক্যাম্পাসগুলোতে, করে তুলতে পারিনি।
এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার জায়গা যেমন আছে, ঠিক সেইরকম আন্দোলনের প্রাপ্তির জায়গাও আছে। এবং সেই প্রাপ্তি এক অনন্য নজির গড়েছিল। অভয়াকে কেন্দ্র করে সারা বাংলার যে আন্দোলন, তা এক সুসংহত গণআন্দোলনের রূপ নেয়, বাংলার গণআন্দোলনের ইতিহাসে যা এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা!
ইতি,
অনিকেত মাহাতো
Whatsapp
