ফিরিয়েছিলেন ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব, আইনস্টাইনের যে সিদ্ধান্ত ঘিরে বিতর্কের শেষ নেই আজও

Albert Einstein: কার্যত ইজরায়েলের ইতিহাসের এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণে এই প্রস্তাব এসে পৌঁছেছিল আইনস্টাইনের কাছে। সে সময় ইজরায়েলে ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিগন।

সেটা ১৯৪৫ সালের অগস্ট মাস। জাপানের ছোট্ট দু'টো শহরে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর দু'টো পরমাণু বোমা। যে বোমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সভ্যতার বুকে ছেড়ে গিয়েছিল অভিশপ্ত দু'টো কালো দাগ। সেই অভিশাপ,সেই ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। যাঁর সূত্র বা অংশগ্রহণ ছাড়া পরমাণু বোমার অস্তিত্বই আবিষ্কার করা যেত কিনা সন্দেহ, তিনি খোদ আপ্রাণ চেয়েছিলেন এই প্রলয় বন্ধ করতে। নতুনকে খোঁজার নেশায় তিনি যে সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন, তার মধ্যে ধ্বংসের ভয়াবহ সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে, তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি। তবে সেই শক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হোক, এমনটা চাননি আইনস্টাইন। তবে শেষপর্যন্ত তেমনটাই হল। আমেরিকাকে শক্তিপ্রদর্শন ও যুদ্ধবাজ রণনীতির কাছে হেরে গিয়েছিল সেদিন এক সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানী-মন সেদিন। তিনি বিজ্ঞানের সাধক। সেই বিজ্ঞানের কাছে নতজানু হয়ে বসে যে সমস্ত ক্ষমতার মোহ-মায়া-লোভ ত্যাগ করা যায়, দেখিয়ে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। এমনকী গোটা একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগও এসেছিল তাঁর কাছে। তবে সেই প্রস্তাব শোনামাত্র খারিজ করে দেন আইনস্টাইন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীর হাতে অকল্পনীয় ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন ইহুদিরা। সে-ও ইতিহাসের কম কালিমালিপ্ত অধ্যায় নয়। প্রায় ৫০ লক্ষ ইহুদি শেষ হয়ে গিয়েছেন হিটলারের একটি অঙ্গুলিহেলনে। বন্দিশিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের উপর চলেছে অকথ্য অত্যাচার। অবশেষে থামল রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে নতুন ইজরায়েল প্রতিষ্ঠা হল। তবে সেই পথেও ছিল নানা কাঁটা। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সেই তখন থেকে ভূমিখণ্ডের লড়াই, নাকবার ঘটনা, সমস্ত উত্থান-পতন পেরিয়ে এক আশ্চর্য উত্থানের সম্মুখীন হল ইজরায়েল। ১৯৫২ সালে ইজরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট চেইম ওয়েইজম্যান আইনস্টাইনকে 'দ্য গ্রেটেস্ট জিউ অ্যালাইভ'-এর আখ্যা দিলেন। অর্থাৎ কিনা সর্বশ্রেষ্ঠ ইহুদি।

আরও পড়ুন: সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…

জন্মসূত্রে ইহুদি হলেও জার্মানিতেই জন্ম হয়েছিল আইনস্টাইনের। ১৯৩৩ সালে তিনি যখন আমেরিকা সফরে, সে সময়ে জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে হিটলার। ইহুদি হওয়ার কারণে তিনি আর জার্মানিতে ফিরে যাননি। বরং থিতু হন আমেরিকাতেই, ১৯৪০ সালে সেখানে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে জার্মান পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচীর ব্যাপারে সতর্ক করেন তিনি। আমেরিকাকেও একই ধরনের গবেষণা শুরুর তাগিদ দেন। তার এই চিঠির মাধ্যমেই ম্যানহাটন প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়। মিত্রবাহিনীকে সমর্থন করলেও যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে জোট বেঁধে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদের কথা তুলে ধরেছিলেন তাঁরা একটি ইস্তেহারে। তবে ততদিনে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে আমেরিকা। 

ওপেনহাইমার যেমন নিজের আবিষ্কার ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে সব কিছু জানার পরেও তা থেকে সরে দাঁড়াতে পারেননি। কার্যত চেষ্টাও করেননি। নিজের আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল দেখার মোহ তাঁকে ইতিহাসের বুকে কার্যত যেন 'শত্রু' হিসেবে দেগে দিল। কিন্তু সেই সংযম দেখাতে পেরেছিলেন আইনস্টাইন। শুধু পরমাণু বোমাই নয়, হেলায় তিনি ফিরিয়েছেন ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগটুকুও। ইজরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট চেইম ওয়েইজম্যানের মৃত্যুর পর ইজরায়েলের দূতাবাস থেকে তাঁর কাছে প্রস্তাব এসেছিল ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার। হবে না-ই বা কেন, তিনি যে সর্বকালের সেরা ইহুদি।

সে এক আশ্চর্য সময়। গোটা বিশ্ব তখন আইনস্টাইনের প্রজ্ঞায় মুগ্ধ। জার্মান বাহিনীর হাতে দলিত, নিপীড়িত একটি জাতি নতুন করে দেশ খুঁজে পেয়েছে। যে ম্যানহাটন প্রজেক্ট আসলে দাঁড়িয়েই রয়েছে আইনস্টাইন প্রবর্তিত সূত্রের উপর, যা না ঘটলে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়ু আরও দীর্ঘতর হত, সেই বিজ্ঞানীর কাছে যে ইজরায়েল নতজানু হবেই, তাতে আর নতুন কী! কার্যত ইজরায়েলের ইতিহাসের এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণে এই প্রস্তাব এসে পৌঁছেছিল আইনস্টাইনের কাছে। সে সময় ইজরায়েলে ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিগন। তিনি আইনস্টাইনের বুদ্ধি ও নৈতিক উচ্চতা দেখে মুগ্ধ। এমন মানুষের হাতেই তো থাকতে পারে নয়া দেশের রাশ। কিন্তু আইনস্টাইন সেই ক্ষমতায় কাছে মাথা নোয়ানোর মানুষ ছিলেন না কোনওদিনই।

ইজরায়েলের পক্ষ থেকে আইনস্টাইনকে দেওয়া সম্মান ফিরিয়ে দিলেন তিনি। প্রত্যাখ্যান করলেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার ডাকও। বেন গুরিয়নকে লেখা একটি চিঠিতে আইনস্টাইন জানিয়ে দিলেন, এই সম্মানের জন্য তাঁকে ভাবার জন্য তিনি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। একই সঙ্গে তিনি জানালেন, আদপে তিনি রাজনৈতিক ভাবে অনভিজ্ঞ এবং এ ব্যাপারে অযোগ্যও বটে। ফলে বাকি জীবনটা দেশ শাসন নয়, বরং সজ্ঞানে বিজ্ঞানের পথে থাকার ব্রতই তিনি আজীবন পালন করতে চাইলেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে, তিনি নাকি ওই চিঠিতে লিখেছিলেন, "মানুষের সঙ্গে সঠিকভাবে আচরণ করার জন্য আমার স্বাভাবিক যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা উভয়েরই অভাব রয়েছে।"

আরও পড়ুন: ইজরায়েল গাজা যুদ্ধে ভারত কী চায়? উত্তর লুকিয়ে ৭৩ বছর আগের এই ঘটনায়…

অথচ বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসে এমন অসংখ্য নাম রয়েছে, যারা ক্ষমতার সেই ডাক এড়াতে পারেননি। আমেরিকার ৩১তম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানী হার্বার্ট হুভার। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। পরে তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। ১৯৭৯ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রসায়নবিদ মার্গারেট থ্যাচার। ভারতীয় বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম ২০০২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন। জার্মানির প্রাক্তন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলও কিন্তু ছিলেন একজন কোয়ান্টাম রসায়ন বিজ্ঞানী। সম্প্রতি মেক্সিকোর প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ক্লডিয়া শিনবাউম পারডো। তিনিও কিন্তু একজন বিখ্যাত পদার্থবিদ। তাঁরা যা পারেননি, তা অত বছর আগে হাসতে হাসতে করে ফেলেছেন বিজ্ঞান-পাগল সেই মানুষটি।

আইনস্টাইনের এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক রাজনৈতিকদের মধ্যে সর্বদাই দ্বিধার জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞান সাধনার এই দীর্ঘপথে প্রেসিডেন্ট হওয়ার এই এক টুকরো সুযোগ হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের খাতায় আরও একটু সফলতা ঢেলে দিতে পারত। কিন্তু না, তিনি চাইলেন না। আত্মসচেতনতার মোড়কে তিনি সেদিন আসলে চিনিয়ে দিয়ে গেলেন এক আদর্শ বিজ্ঞানীরই স্বরূপ।

More Articles