জমি দুর্নীতি মামলায় বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যা সাইমা ওয়াজেদ পুতুল-সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
কোথাও ৪০০০ কোটি, কোথাও ৫০০ কোটি! হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে
Sheikh Hasina Corruption: অভিযোগ, মুজিব রহমানের শতবর্ষ উদযাপনে ৪০০০ কোটি টাকা অপব্যবহার করা হয়েছে। শেখ মুজিবের ১০ হাজরের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে অর্থ অপচয় ও ক্ষতিসাধনের অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় ৫৩ বছর। বাংলাদেশে একক দল হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী তথা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় ১৬ বছর। চতুর্থবারের জন্য সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে গত ৫ অগাস্ট, ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের জেরে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্ষমতাগ্রহণের একদম শুরুতে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেলেও, মানুষের মন রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল হাসিনা সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তিস্তা প্রকল্প, কোটা বিরোধী আন্দোলন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পেনশন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অভিযোগ উঠেছিল। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছে। এরপর থেকে হাসিনার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতি এবং অপরাধের অভিযোগ মামলা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন অবৈধ সম্পদের খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে। এমনকী, হাসিনার পরিবারের বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধেও একের পর এক অভিযোগ সামনে আসছে।
শেখ হাসিনা
২০০৭ সালে, বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই তৎকালীন রাজনীতিতে 'মাইনাস টু' ফর্মুলার কথা শোনা যেতে থাকে। এই 'মাইনাস টু' ফর্মুলা হলো দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা ও বিএনপি-র খালেদা জিয়া) নেত্রীদের সরিয়ে রেখে দল পুনরায় গঠনের চেষ্টা। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে একটানা ১১ মাস কারাগারেও বন্দি ছিলেন হাসিনা। বাংলাদেশের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চাঁদাবাজির এক মামলার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল হাসিনাকে। অভিযোগ ছিল, শেখ হাসিনা এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিম ২ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। এখন গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশে হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো-কে বাংলাদেশের আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মুখ্য সরকারি আইনজীবী মহম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, হাসিনার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে, 'গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা' ও 'সরকার উৎখাত' ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাসিনা-সহ ৭৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- ব্রিটেনের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ! মাসি শেখ হাসিনার সঙ্গে দুর্নীতিতে যুক্ত টিউলিপ সিদ্দিকও?
সাইমা ওয়াজেদ পুতুল
জমি দুর্নীতি মামলায় বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যা সাইমা ওয়াজেদ পুতুল-সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। চলতি জানুয়ারি মাসেই হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা রুজু করেছিল। এবার আদালতে এই মামলার চার্জশিট জমা দিয়েছে। রাজধানীর আদালতেই সেই মামলা চলছিল। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, ঢাকার উপকণ্ঠে আবাসিক জমি কৌশলে এবং প্রতারণামূলক পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। অভিযোগ, কন্যা পুতুলের অনুরোধেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কাজ করিয়েছেন। এই ঘটনায় সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিকরাও যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। রাষ্ট্র পোষিত সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজুক) মাধ্যমে এই জমি আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
দুদকের আইনজীবী আহমেদ সালাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই মামলার তদন্তের রিপোর্ট আগামী ৪মে জমা দিতে হবে আদালতে। অভিযুক্তরা পলাতক বলেই তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। চার্টশিটে দাবি করা হয়েছে, হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অসৎ উপায়ে পুতুল ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য বায়না করেন। তাঁদের পারিবারিক জমি থাকা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে ওই জমি দখল করা হয়। অভিযোগ এও উঠছে যে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজুক) কিছু না জানিয়েই সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে জমি আত্মসাৎ করা হয়। উল্লেখ্য, হাসিনার কন্যা পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক ডিরেক্টর। কর্মসূত্রে তিনি নয়াদিল্লিতেই থাকেন। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে তিনি এই সংস্থায় কর্মরত।
টিউলিপ সিদ্দিক
বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছিল। অভিযোগ, এই প্রকল্পকে ঘিরে হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার করছেন। শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ভাগ্নী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছেন তাঁরা। এই অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিবিসি-তে লেখা হয়েছে, এই অর্থ মালেশিয়ায় বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাচার করা হয়েছে। অভিযোগ, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করা হয়েছিল, সেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল।
৪০০ কোটি পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগে ছিল টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্য বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সেই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা। যুক্তরাজ্য এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে দুদক জানিয়েছিল, লেবার পার্টির সাংসদ টিউলিপ সিদ্দিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করার পর থেকে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছেন।
আরও পড়ুন- ১৮ লক্ষ কোটি টাকার দেনা চাপিয়ে গেছেন হাসিনা? যে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
সজীব ওয়াজেদ জয়
শেখ হাসিনার পুত্র তথা অন্যতম উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বিবিসি-তে লেখা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, ৩০ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন মার্কিন ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়েছে। হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক এবং লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন হাসিনা, জয়, রেহানা, সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছিল। অভিযোগ, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নয়টি প্রকল্প থেকে এসব দুর্নীতি করা হয়েছে।
শেখ রেহানা
গত বুধবার হাসিনার বিরুদ্ধে নতুন মামলায় তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। অভিযোগ, মুজিব রহমানের শতবর্ষ উদযাপনে ৪০০০ কোটি টাকা অপব্যবহার করা হয়েছে। শেখ মুজিবের ১০ হাজরের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ করে অর্থ অপচয় ও ক্ষতিসাধনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ওই মামলায় হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও এক প্রাক্তন সরকারি আধিকারিককেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। কমিশনের অভিযোগ ওই টাকা জাতীয় রাজকোষ থেকেই খরচ করা হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে মুজিব বর্ষের সময়কাল পরে বাড়ানো হয়েছিল। দুদকের পরিচালক আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, গত জানুয়ারি মাসে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছিল। সাত সদস্যের একটি কমিটি এই অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে হাসিনার বিরুদ্ধে দু'টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। তাঁর প্রত্যপর্ণ চেয়ে নয়াদিল্লিকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা। কিন্তু এখনও তার কোনও উত্তর দেওয়া আসেনি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এই দেশ থেকেই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে নানা সময়ে নানা বার্তাও দিয়েছেন হাসিনা।