গোধরা থেকে মুর্শিদাবাদ — যে মডেলে হিংসা ছড়াচ্ছে সমকালীন ভারতবর্ষে

Murshidabad: ইতিহাস বলছে— বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে সাম্প্রদায়িক হিংসায় মদত দিয়েছে বেশি, ক্ষমতায় এসে খুব বেশি নয়।

“ওয়সে ভি তুম কওন সে মুসলমান হো
—ইতনা তো হু কি মারা জা সকুঁ।”
(মান্টো, নন্দিতা দাস)

পরিচালক-অভিনেতা নন্দিতা দাসের ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘মান্টো’। দেশভাগের সাম্প্রদায়িক হিংসার মধ্যে সাদাত হোসাইন মান্টো যখন দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর বন্ধু, অভিনেতা শ্যাম চাড্ডার সঙ্গে কথোপকথনে আলোচ্য উক্তিটি করছেন। মান্টোর জীবন কেটেছে দেশভাগের অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে। একদিকে দেশের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে জীবনে নেমে আসা দেশভাগের বাস্তবতা; দুইয়েরই টানাপড়েনে তিনি আক্রান্ত। লিখছেন একের পর এক গল্প— বিষয় হয়েছে দেশভাগ, দাঙ্গা, নারী জীবন, যৌনতা, মানসিক সংকট ইত্যাদি। বাস্তবে তিনি দেশভাগ, হিংসা মেনে নিতে পারেননি। ট্রমা, মানসিক অবসাদের মধ্যে কেটেছে তাঁর বাকি জীবন। ‘সন্তান’, ‘ঠান্ডা গোস্ত’, ‘খোল দো’ প্রভৃতি গল্পের পটভূমি আসলে সেই সবের স্পষ্ট উদাহরণ।

মনে পড়ে ‘ঠান্ডা গোস্ত’-এর সেই সর্দার ঈশ্বর সিংয়ের কথা— যার কাজ ছিল সকাল হলে মানুষ মারতে যাওয়া, নিজের ভাইবোনকে মারতে যাওয়া, ধর্মকে জেতাতে যাওয়া— যে কুলবন্তের কাছে ফিরে এসেছিল নপুংসক হয়ে। সঙ্গমের চরমতম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সর্দার আর ‘তাসের কার্ড’ ছুঁড়তে পারছে না। কারণ, সেই সর্দার খানিক আগে ধর্ষণ করে এসেছে এক মৃত ঠান্ডা শরীরকে।

কৃষণ চন্দর তাঁর ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ গল্পে স্পষ্ট করেছেন মানুষ মারার খেলা। ধর্মের জিগির তুলে শুরু হয় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক হিংসা। খানিক পরে গল্পের কথক ট্রেন— হিসাব করে মৃতের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে। এক পক্ষ চারশ মানুষ মারলে অপর পক্ষকে অন্ততপক্ষে চারশ তো মারতেই হবে। এ আখ্যান তো সবারই জানা।

আরও পড়ুন-ভারতে গণহিংসার সম্ভাবনা ঠিক কতটা, কেন সিঁদুরে মেঘ দেখছে আন্তর্জাতিক মহল?

২০১৪ সালের পর থেকে এরকম অনেক ঘটনাই ঘটেছে ভারতবর্ষের বুকে, আজ যা ঘটছে মুর্শিদাবাদে। এই মুহূর্তে মুর্শিদাবাদ জ্বলছে, বছর কতক আগে সমগ্র ভারত জ্বলছিল। ২০০২-এর গোধরায় ট্রেন পোড়ানোর ঘটনা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার মিলিয়ে হিংসার সমকালীন ইতিহাস দেখলে মডেলটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে, যে মডেলের শিকার আজ পশ্চিমবঙ্গ। ইতিহাস বলছে— বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে সাম্প্রদায়িক হিংসায় মদত দিয়েছে বেশি, ক্ষমতায় এসে খুব বেশি নয়।

বস্তুত, এই হিংসার স্লো-পয়জনিং নতুন করে শুরু হয়েছে আবারও এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। একের পর এক পক্ষপাতদুষ্ট নির্ণয় আজকের হিংসার কারণ। সমানভাবে মদত দিয়েছে বাংলার ক্ষমতাসীন বৃহত্তর তৃণমূল। ওয়াকফ বিল এক উপলক্ষ্য মাত্র। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসলে যে ক্ষমতার অপব্যবহার— আজ মানুষকে তা বুঝতে হবে। বিরোধী-শূন্য বিধান তো বিধির বিধান নয়, হতেই পারে না। এখন মানুষের ধর্ম নিয়ে এত মাথাব্যথা, অথচ সনাতন হিন্দুরা নিজের ধর্মকে ভুলে গেল কী করে? মহাভারত সাক্ষী আছে—কোনওদিন একজন ক্ষমতার আধার হতেই পারে না। কর্ণ, অর্জুন, ভীম যেমন এক প্রজন্মের নিদর্শন, তেমনই ভীষ্ম, গুরু দ্রোণরাও আগের প্রজন্মের কিন্তু ক্ষমতার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোথাও স্পষ্ট দেখা যায়নি।

ভারতবর্ষ জুড়ে ‘রামনাম’ জপ করার খেসারত আজ বাংলাকে দিতে হচ্ছে। বহিরাগত সংস্কৃতির পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মাথাচাড়া দেওয়া, বস্তুত এই হিংসার কারণ। ডাকাতের বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ সোনার দামী দামী গহনা পরে যাওয়া আসলে তো বাড়িতে ডাকাত ডাকারই নামান্তর। দোষ দু'পক্ষের কারওই নয়, একপক্ষ বলবে— “আছে, তাই পরছি”। অপর পক্ষ বলবে— “আমাকে দেখিয়ে জানান দিচ্ছে, যে আমার আছে, এটা চোখ টাটানো ছাড়া আর কিছুই না।”

অপবাদ ঢাকতে ঘরে আগুন লাগানোর এই খেলা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। দুর্নীতির ফলে চাকরি যাওয়ার অপবাদ ভোলাতেই কি এই হিংসা? প্রশ্ন যাই হোক, এই হিংসার বীজ অনেক দিনের, আর পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তা ক্রমেই অঙ্কুরিত হয়েছে। ঘাই দেখে জাল ছুঁড়েছে দু'পক্ষই। পরিস্থিতি এমন যে, এখানে আদতে লাভ দু'পক্ষেরই। সবচেয়ে বেশি লাভ ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের। কিন্তু বঙ্গ-বিজেপির মনে রাখতে হবে— বেশি লাভের আশা করতে গিয়ে মাটিই হারিয়ে যেন না যায়!

আরও পড়ুন-ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতির বাড়বাড়ন্তে আতঙ্কিত বাংলার ফকিররা

আজ থেকে ঠিক প্রায় একশ বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। ১৯২১ সাল, বাংলার বুকে জন্ম নিলেন এক কবি, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ —বিদ্রোহী নজরুল। ৩/৪ তালতলা লেনের মুজফ্ফর আহমেদের ঘরে বসে সারারাত ধরে টানা লিখে গেলেন, জন্ম নিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই একটি কবিতাই এক কবির জীবন বদলে দিল। কবিতার নামে কবির পরিচিতি নির্মাণ হলো। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’-র তখন জয়জয়কার। শুরু হলো — মোহিতলাল বনাম নজরুল দ্বন্দ্ব। গুরু-শিষ্যের এই দ্বন্দ্ব প্রায় সবার জানা।

গুরু-শিষ্যের এই দ্বন্দ্ব এই মুহূর্তে ঘটে থাকলে নিঃসন্দেহে তা দাগিয়ে দেওয়া যেত ধর্মীয় ‘দাঙ্গা’ হিসাবে। কারণ, দু'পক্ষের অনুগামীই খুব একটা কম ছিল না। ধর্মের জিগির তুলে শুরু হওয়া দাঙ্গায় মানুষ সবচেয়ে বেশি পিছনে ফেলে আসে ধর্মকেই। বস্তুত, ধর্মীয় প্রজ্ঞাপনের থেকে দাঙ্গার হিংস্রতা বেশি সংক্রামক। ভয়াবহ হিংসায় মানুষ খুশি হয় মানুষ মেরে, প্রতিশোধ নিয়ে। ধর্মীয় হিংসায় ধর্ম নয়, হিংসাই জয়ী হয়। আমি আছি, ধর্মও আছে। তাই নাজিম হিকমতের কবিতা দিয়ে বলা যায়—

“জীবন বড় সুন্দর ব্রাদার,
একে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও না।”

 
 
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের গবেষক
 
 
 

More Articles