নিষিদ্ধ জন্মের অভিজ্ঞতাভূমিতে মিশে যান ঋতুপর্ণ ও চপল ভাদুড়ী
Rituparno Ghosh: 'চিত্রাঙ্গদা’ ছাড়াও, বাকি দু'টি ছবিতে যে ঋতুপর্ণ অভিনয় করেছিলেন, তার একটি সহজ কারণ এই যে, ছবি দু'টির মূল ভিত্তিকে তিনি বিশ্বাস করতেন।
তিনটি ছবি। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’। এই তিনটি ছবিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণ। ভিন্ন যৌনতাকে ঘিরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং পর্যবেক্ষণ, এই তিনটি ছবির মধ্যেকার এক প্রধান বিষয় ঐক্য। এর বাইরেও, ছবি তিনটি যদি পরপর দেখা যায়, তাহলে ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালক-মন যে শিল্পের আকাশ নির্মাণ করতে চেয়েছিল, তার পেছনের চিন্তা-সিঁড়িগুলিও যেন দেখতে পাওয়া যায়।
কেউ বলতেই পারেন, বাকি দু'টি ছবি তো ভিন্ন পরিচালকের তৈরি করা! কথাটি ঠিক। কিন্তু এখানে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব, কারও একার নয়, বরং এক যৌথ শিল্পচেষ্টায় গড়ে ওঠে সিনেমা। পরিচালক ছবিটির বিষয়-দর্শনের সঙ্গে যেমন সংযুক্ত, ঠিক তেমনভাবেই ছবিটির অভিনেতাও সে-ছবির অন্তর্গত সত্যকে প্রতি মুহূর্তে নিজের সত্য করে তোলার প্রক্রিয়ায় নিজেকে জারি রাখেন। ফলে, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছাড়াও, বাকি দু'টি ছবিতে যে ঋতুপর্ণ অভিনয় করেছিলেন, তার একটি সহজ কারণ এই যে, ছবি দু'টির মূল ভিত্তিকে তিনি বিশ্বাস করতেন।
‘চিত্রাঙ্গদা’-য় একটি চিন্তাবাক্য বিশেষভাবে ছবিটির পথ নির্দেশ করে দেয়। বাক্যটি কী? ‘চিত্রাঙ্গদা একটা ইচ্ছের গল্প, দ্যাট ইউ ক্যান চুজ ইওর জেন্ডার’। এখান থেকে আমরা ‘ইচ্ছে’ শব্দটিকে তুলে নিয়ে ফিরে তাকাব ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর প্রারম্ভ-অংশে। ছবিতে, চপল ভাদুড়ীর উপর তথ্যচিত্রের শুটিং শুরু হচ্ছে। তার আগে, আয়নার সামনে বসে মেকআপ করছেন চপল। তথ্যচিত্রটির পরিচালক অভিরূপ সেন (যে-চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ) এসে সেই মেক-আপ তুলতে শুরু করে।
আরও পড়ুন- ঋতুপর্ণের ‘আবহমান’: শিল্পীর মুহূর্ত, শিল্পের সত্য
অভিরূপ সেন, এক নারীসুলভ মানুষ। চপল ভাদুড়ীও তাই। ছবিতে, মেকআপরুমে ওই দু'টি চরিত্রের কথোপকথন অংশটি এমন:
চপল।। এ তো সব তুলে দিলেন?
অভিরূপ।। চুপ করো।
চপল।। চোখটা থাক!
অভিরূপ।। চপলদা, চুপ করো। নোড়ো না।
চপল।। (অভিরূপের মুখের দিকে আলতোভাবে তাকিয়ে) নিজে তো বেশ কাজল পরা হয়েছে?
অভিরূপ।। আমি তো রোজ পরি! তুমি পরো? (হেসে)
হ্যাঁ, এ-কথা ঠিক যে, চপলের মেকআপ নিজে হাতে তুলে দিয়েছিল অভিরূপ। কারণ, সেটা তাঁর তথ্যচিত্রের কাছে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু মেকআপ, বা কাজল— এগুলি কেবল শৃঙ্গারবস্তু নয় চপলের কাছে। বছরের পর বছর এগুলির আন্তরিক সাহয্যেই নিজের পুরুষ শরীর থেকে তিনি খুঁজে বার করেছেন, একজন নারীকে। ফলে, কাজল বা অন্যান্য প্রসাধন, ব্যক্তি চপলের জীবনের গুরুত্বময় অংশ।
এই দৃশ্যটির পরে, হোটেলের ঘরে, এক ছায়া-অন্ধকারের মধ্যে, অভিরূপ তাঁর সঙ্গী বাসুকে একটি প্রশ্ন করে। প্রশ্নটি এমন:
অভিরূপ।। Basu, why can’t Chapal da wear kohl in the film?
বাসু।। What?
অভিরূপ।। Poor thing! Must have craved it all his life. Let him wear kohl, hm?
বাসু।। In the film? What about continuity, babes?
অভিরূপ।। How does it matter, Basu? What is more important, tell me? The way we actually live our lives? Or the way we want to?
এই শেষ বাক্যটি কী বলছে আমাদের? বলছে, ‘What is more important, tell me? The way we actually live our lives? Or the way we want to?’ এর ঠিক পাশেই, আমরা উল্লেখ করতে চাইব ‘চিত্রাঙ্গদা’-র সেই চিন্তামনকে, ‘চিত্রাঙ্গদা একটা ইচ্ছের গল্প, দ্যাট ইউ ক্যান চুজ ইওর জেন্ডার’। খেয়াল করলে হয়তো বোঝা যাবে, ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় বর্ণিত ‘ইচ্ছে’-র দর্শনের সঙ্গে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর এই সংলাপটির এক নিবিড় আত্মীয়তা রয়েছে। ভিন্ন যৌনতা সম্পর্কে সেই ভাবনার সাদৃশ্য-সূত্র ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এও খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু এখানে বৈসাদৃশ্যের দরজা খুলে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, এই তিনটি ছবিতে ঋতুপর্ণ ঘোষের অভিনয়-পথ। মনে রাখা উচিত, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এ ঋতুপর্ণ ঘোষ দু'টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এক, অভিরূপ সেন। দুই, অতীতের চপল ভাদুড়ী।
অভিরূপ সেন দিল্লিবাসী। তথ্যচিত্র নির্মাতা। সে নিজের ভিন্ন যৌনতার পরিচয়কে প্রকাশ্যে উদযাপন করে। তাঁর পোশাক, ব্যবহার সেই উদযাপনের সহযোগী। এখানে ‘উদযাপন’ কথাটিকে বিশেষ অর্থে আমি ব্যবহার করতে চাইছি। কারণ, অভিরূপের ব্যক্তিত্ব, তাঁর ব্যক্তি ‘আমি’-কে এই উদযাপনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে যেমন চায় না, তেমনই কখনও কখনও তা এক ধরনের প্রতিবাদের বা প্রতিরোধের পতাকাও হয়ে দাঁড়ায়। ছবিতে, উদয় অভিরূপকে বলে যে, অভিরূপের চুলের ভঙ্গিমা তাঁর অপছন্দ এবং এও জানায় যে আরোপিত কিছু না করতে, সে যেমন, তেমন থাকতে— তখন নিঃশব্দে অভিরূপ তা মেনে নেয়। এই সংলাপটি থেকে অভিরূপের মানসিক গঠন কিছুটা বুঝতে পারি আমরা।
এর ঠিক বিপরীত দিকে চপল ভাদুড়ীর অবস্থান। পুরুষ শরীরে নারীত্বের উদযাপন সেখানেও আছে কিন্তু অন্যভাবে। এই দু'টি চরিত্রের মধ্যে এক সূক্ষ্ম বিভাজনরেখা নিজের অভিনয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, "চপলদা নিজে নিজেকে একটা ভিক্টিম অফ সার্কামস্টান্সেস বলেন সব সময়। আমি অভিরূপটাকে চেয়েছিলাম যে, এই মানুষটা তার এগজিসটেন্সটাকে সেলিব্রেট করে।"
আরও পড়ুন- ভিন্ন যৌনতার সহজাত একত্রবাস: ঋতুপর্ণের ‘বাড়িওয়ালি’
এখানে চলে আসে ঋতুপর্ণ ঘোষের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ যখন বেরোয় তখন অভিরূপ সেন চরিত্রটি সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই চরিত্রটির মধ্যে কি ঋতুপর্ণ ঘোষের ছায়া আছে? সব ক্ষেত্রেই ঋতুপর্ণ একটিই উত্তর দিয়েছেন, না। অভিরূপের অত্যন্ত নারীসুলভ আচরণ, ইচ্ছে করেই এই চরিত্রটির মধ্যে এনেছিলেন ঋতুপর্ণ। শুধু তাই নয়, তার পোশাকের মধ্যেও এনেছিলেন এক প্রকারের অ্যান্ড্রজিনির বর্ণভঙ্গিমা! হ্যাঁ, যদি ব্যক্তিগত কিছু থেকেই থাকে তা হলো নিজের মনের প্রতিবেশী আরেকটি মনকে নিবিড়ভাবে দেখতে পাওয়ার আনন্দ। ‘প্রতিবেশী মন’ বলছি তার কারণ, যৌনতা সম্পর্কে অভিরূপের ভাবনার সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষের ভাবনার ভূমি অনেকটাই এক। আবার ‘প্রতিবেশী’ শব্দটি আমাদের একথাও জানিয়ে যায় যে, সে আমার মনের বাসস্থানের কাছে থাকলেও, সে আমার বাসস্থান নয়। কিছু পার্থক্য সেখানে আছে।
অভিরূপ সেন চরিত্রটি সম্পর্কে ঋতুপর্ণ নিজেই বলেছেন,
"আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পেতাম অভিরূপের ইমম্যাচিওরিটিটা এবং আমি এটা বেশ এঞ্জয় করতাম। এবং একটা পয়েন্টে যখন ছবিটা শেষ হয়ে গেল, আমার মনে হলো অভিরূপকে আর আমি কোনওদিন গাইড করতে পারব না। ও দিল্লি চলে যাওয়ার পর।"
শুধু তাই নয়, ওঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়— ছবিতে, অভিরূপ সেন যেমন তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন চপল ভাদুড়ীর ওপর, ব্যক্তিগত জীবনে কি এমন একটি তথ্যচিত্র বানানোর ইচ্ছে ঋতুপর্ণ ঘোষের রয়েছে? তখনও ঋতুপর্ণ উত্তর স্পষ্ট করে দেন অভিরূপ আর ব্যক্তি ঋতুপর্ণর মধ্যেকার পার্থক্যকে। ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, "না এই বিষয় নিয়ে আমি ছবি বানাতাম না। হয়তো একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারতাম কিন্তু ছবি বানানোর ইচ্ছে হতো না।"
এই উত্তর প্রসঙ্গেই ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, তথ্যচিত্রর থেকে ফিচার ফিল্ম তাঁর কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কারণ হিসেবে সামনে রেখেছিলেন এই যুক্তি, "আমার একটা ইম্যাজিন ট্রুথ অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং লাগে। যে কারণে অভিরূপ চপলের জীবনটাকে যে একটা ইম্যাজিন ট্রুথ হিসেবে দ্যাখে— এটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। আমাকে চপলদাকে নকল করতে হয়নি। চপলদার একটা ইন্টারপ্রিটেশন আমি আমার অভিনয়তে আনতে পেরেছিলাম।"
ঠিক এখান থেকে আমরা প্রবেশ করতে চাইব ঋতুপর্ণ ঘোষের চপল ভাদুড়ীর চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে। পোশাক হিসেবে ঋতুপর্ণ এখানে পরেছিলেন ঢলা পাজামা, ফতুয়া। প্রায়শই নারী আবরণে তাঁর বক্ষে ছিল একটা গামছা। খেয়াল করলে বোঝা যায়, এই পোশাকচিত্রটি ঠিক নারীর পোশাক নয়। আবার তথাকথিত পুরুষের পোশাক হলেও তার মধ্যে থেকে নারীত্বের আবহাওয়া খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে, এই সমস্ত কিছুর মধ্যেও কিন্তু একটা অ্যান্ড্রজিনি রয়েছে।
আরও পড়ুন- প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’
অভিরূপ সেনের যে দৃঢ়তা, তা প্রথম দিকে চপল চরিত্রটির মধ্যেও ছিল। ছিল, যতক্ষণ চপলের অর্থ, নাম, যৌবন পার করছিল তার উজ্জ্বলময় সময়। তারপর সেই দৃঢ়তাও নিস্তেজ হয়ে পড়ে আশ্রয়ের পায়ে। অভিরূপ সেন, সেই আশ্রয়কে কাছ থেকে দেখেছে, তার সঙ্গে তর্ক করেছে। মাঝেমাঝে দুর্বলও হয়েছে তার প্রতি কিন্তু নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেনি। চপল করেছেন। ঋতুপর্ণ গলায় আওয়াজ, কথার স্বরের পার্থক্যে সহজেই দু'জনের সূক্ষ্ম বিভাজনকে দু'টি চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলছিলেন।
'আরেকটি প্রেমের গল্প’-র সূচনায় চপল ভাদুড়ী ও অভিরূপের মধ্যেকার একটি সংলাপের উল্লেখ এই লেখায় করেছিলেম। ছবিটির শেষের দিকেও, তাদের মধ্যেকার একটি সংলাপ দু'টি চরিত্রের মনোগত পার্থক্যকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়।
অভিরূপ সেন।। আচ্ছা, তুমি কি সত্যি সত্যি নিজেকে মেয়ে মনে করো চপলদা?
চপল ভাদুড়ী।। ওমা! ব্যাটাছেলে বলে যদি ভাবতুম, তাহলে তো ল্যাটা চুকেই যেত! কেন তুমি ভাবো না?
অভিরূপ সেন।। না!
চপল ভাদুড়ী।। ভাবো না? যে ঠাকুর তোমাকে মেয়ে গড়তে গড়তে ছেলে করে ফেলেছে?
অভিরূপ সেন।। না ভাবি না। আমি ভাবি, মেয়েরা আলাদা। ছেলেরা আলাদা। আমরা আলাদা।
সংলাপের শেষ বাক্যটি খেয়াল করতে অনুরোধ করব। "আমি ভাবি, মেয়েরা আলাদা। ছেলেরা আলাদা। আমরা আলাদা।" এই চিন্তাই কিন্তু আলাদা করে দেয় চপল থেকে অভিরূপকে। দেয় দৃঢ়তা। একা হাঁটবার সাহস। ঋতুপর্ণ গোটা ছবিতে এই দু'টি চরিত্রের বিভাজনকে যেমন দেখিয়েছেন, তেমনই কোথাও কোথাও তাঁদের যন্ত্রণার-স্বরকে একাকার করে দিয়েছেন একই নিষিদ্ধ জন্মের অভিজ্ঞতাভূমিতে! অভিনয়কে কত গভীরভাবে জানলে এই বিভাজন ও সম্মিলনের খেলা নিরন্তর একজন অভিনেতা একটি ছবির মধ্যে এমনভাবে করতে পারেন, তা দেখে অবাক হই! এবং এরই সঙ্গে, এ-কথা বিস্ময়ের ছাপ রেখে যায় আমাদের মনে যে, একটি চরিত্রকে সামান্য ছোট করে আরেকটিকে বড় করে নয়, দু'টি চরিত্রের মধ্যেই কিন্তু ঋতুপর্ণ তাদের সত্য-বক্তব্যকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। অভিনয়ের সুরকে সমান রেখেই একইসঙ্গে জাগিয়ে তুলেছিলেন দর্শকের সামনে অভিরূপ ও চপলের নিজস্ব জগতকে, যা নিঃসন্দেহেই অভাবনীয়!