‘বেটি বাঁচাও, বেটি পাড়াও ’, ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’! সরকারী অনুদান দেখিয়ে টাকা নিয়েছিল বিজেপিই?
Beti Bachao Beti Padhao, Swachh Bharat Mission: অরবিন্দাক্ষণের অভিযোগ, এটিকে নিছক ভুল বোঝাবুঝি বলা যাবে না। কারণ, সরকারি প্রকল্পের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল অনুদান নিলে তা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার শামিল।
২০২১-২২ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অফিসিয়াল নমো (NaMo) অ্যাপ এবং নরেন্দ্রমোদি.ইন (narendramodi.in)-এ অনুদান অভিযান চালানো হয়। সেই অভিযানের লক্ষ্য ছিল ‘micro-donation’ সংগ্রহ করা, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে ছোট ছোট পরিমাণে দান করতে উৎসাহিত করা। প্রচারে বলা হচ্ছিল, যে কেউ চাইলে দেশের তিনটি বড় সরকারি প্রকল্প— স্বচ্ছ ভারত অভিযান (Swachh Bharat Mission), বেটি বাঁচাও বেটি পাড়াও (Beti Bachao Beti Padhao) এবং কৃষক সেবা (Kisan Seva) বেছে নিয়ে দান করতে পারবেন। চাইলে 'পার্টি ফান্ড' নামে বিজেপির তহবিলেও দান করা যাবে। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যেই তৈরি হচ্ছিল একটি বড় বিভ্রান্তি।
মানুষ যখন অ্যাপ বা ওয়েবসাইট খুলতেন, সেখানে সরকারি প্রকল্পগুলোর নাম এমনভাবে সাজানো ছিল, যেন সত্যিই তারা সরকারের অনুমোদিত কোনো কল্যাণমূলক স্কিমে দান করছেন। অনেকেই স্বচ্ছ ভারত অভিযান (Swachh Bharat Mission), বেটি বাঁচাও বেটি পাড়াও (Beti Bachao Beti Padhao)-এ দান করেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন, তাঁদের দেওয়া অর্থ বাস্তবেই শৌচলয় নির্মাণ, নারীর শিক্ষা-সহ সামাজিক উন্নয়নের কাজে ব্যবহার হবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই তিনটি সরকারি প্রকল্পের কোনোটিই বিজেপিকে তাদের নামে দান সংগ্রহের অনুমতি দেয়নি। এবং দান করা সেই টাকাও সরকারের কাছে যায়নি, সবই গিয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় পার্টি অ্যাকাউন্টে।
এই তথ্য সামনে আসে সাংবাদিক বি. আর. অরবিন্দাক্ষণের দাখিল করা একটি আরটিআই (RTI)-এর মাধ্যমে। তিনি একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রক বিশেষ করে পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন মন্ত্রক (Ministry of Drinking Water and Sanitation) এবং মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের কাছে জানতে চান, সরকারি প্রকল্পগুলোর নামে কি বিজেপি কোনো অনুমতি নিয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছে? দুই মন্ত্রণালয়ই লিখিত ভাবে স্পষ্ট জানায়, সরকারের কোনো প্রকল্পের নামে দান সংগ্রহের অনুমতি বিজেপিকে দেওয়া হয়নি। নমো অ্যাপ বা নরেন্দ্রমোদি.ইন-এর মতো ব্যক্তিগত বা দলীয় প্ল্যাটফর্মকে এমন ক্ষমতা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের গাইডলাইনও খতিয়ে দেখা হয়, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল এই প্রকল্পের নামে দান গ্রহণ করতে পারে, এমন কোনো বিধান নেই।
আরও পড়ুন
ইলেক্টোরাল বন্ডের গোপন কোড কেন সংগ্রহ করেছিল SBI?
এই ঘটনাগুলি সামনে আসতেই প্রমাণিত হলো মানুষ স্বচ্ছ ভারত অভিযান বা বেটি বাঁচাও বেটি পাড়াও-এর নামে দান করেছিলেন, তারা আসলে ভেবেছিলেন সরকারি কাজের জন্য দিচ্ছেন। অথচ তাঁরা বুঝতেই পারেননি, সেই টাকা সরাসরি বিজেপির পার্টি ফান্ডে চলে যাচ্ছে। অনেক দাতা তাঁদের রসিদও দেখিয়েছেন সেখানে স্পষ্ট ভাবে সরকারি প্রকল্পের নাম উল্লেখ ছিল।
অরবিন্দাক্ষণের অভিযোগ, এটিকে নিছক ভুল বোঝাবুঝি বলা যাবে না। কারণ, সরকারি প্রকল্পের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল অনুদান নিলে তা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার শামিল। যদি কেউ জানতেন যে টাকা আসলে রাজনৈতিক তহবিলে যাচ্ছে, তাহলে হয়ত অনেকে দান করতেন না। দান নেওয়ার সময় স্বচ্ছতা থাকা জরুরি কিন্তু এই ক্ষেত্রে সেই স্বচ্ছতা ছিল না বলেই তাঁর অভিযোগ। তিনি সরাসরি এটিকে 'misrepresentation', অর্থাৎ ভুল তথ্য দিয়ে অর্থ সংগ্রহ বলে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তাঁর অভিযোগ, মানুষের বিশ্বাসকে ব্যবহার করে সংগৃহীত এই অর্থ রাজনৈতিক দলের পক্ষে একধরনের অনৈতিক সুবিধা তৈরি করেছে। পরে তিনি পুলিশের কাছে এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই (CBI)-র কাছেও তদন্তের আবেদন জানান।
আরও বড় প্রশ্ন উঠেছে এ কারণে যে, যখন সরকারি প্রকল্পের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, তখন সেটি কি আইনগত দিক থেকেও সমস্যার নয়? সরকার নিজে যখন স্বীকার করছে যে তারা কোনো অনুমতি দেয়নি, তখন এই ধরনের তহবিল সংগ্রহ স্পষ্টতই বিধি লঙ্ঘন বলে অনেকে মনে করছেন। তবে বিজেপি এই নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট অবস্থান জানায়নি। তারা ব্যাখ্যা করেনি কেন সরকারি প্রকল্পগুলোর নাম, দানের বিকল্প হিসেবে অ্যাপে দেখানো হয়েছিল। এই দান প্রকৃতপক্ষে কোন খাতে গিয়েছে, বা সে টাকা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কেও এখনও কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
ঘটনার পর রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই বলছেন, সরকারি প্রকল্পের নাম ব্যবহার করা হলে মানুষ স্বভাবতই মনে করেন এটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। একটি রাজনৈতিক দল যদি সরকারের কাজের মতো করে নিজেদের তহবিল সংগ্রহ করতে চায়, তাহলে তা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। স্বচ্ছ ভারত অভিযান, বেটি বাঁচাও বেটি পাড়াও-র মতো প্রকল্প মানুষের কাছে অত্যন্ত সংবেদনশীল; বিশেষ করে নারীর শিক্ষা, স্যানিটেশন, সামাজিক উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রগুলিতে দানের বিষয়টি মানুষের মনে একধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতার অনুভূতি তৈরি করে। আর সেই আবেগকে ব্যবহার করে যদি রাজনৈতিক দল নিজের সুবিধা নেয়, তবে তা নৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ।
আরও পড়ুন
সবার টাকা বিজেপির ঘরে! ইলেক্টোরাল বন্ডের যে তথ্যে তোলপাড়
ঘটনাটি সামনে আসার পর অনেক দাতা প্রকাশ্যে বলেছেন, তারা সত্যিই ভেবেছিলেন সরকারি প্রকল্পে দান করছেন। কেউ কেউ রসিদের স্ক্রিনশট দেখিয়েছেন, যেখানে প্রকল্পের নাম স্পষ্ট ছিল। তাঁদের মতে, দানের সময় যদি স্পষ্টভাবে জানানো হতো যে টাকা পার্টি ফান্ডে যাচ্ছে, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিতেন ভেবে-চিন্তে। সুতরাং এই পুরো প্রক্রিয়াটাকেই তারা 'অস্বচ্ছ' এবং 'বিভ্রান্তিকর' হিসেবে দেখছেন।
এই সমস্ত অভিযোগ মিলিয়ে এখন তদন্তের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, দল কি ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারি প্রকল্পের নাম ব্যবহার করেছে, নাকি এটি প্রযুক্তিগত ভুল? যদি ভুল হয়ে থাকে, সেটি কেন দীর্ঘদিন ধরে সংশোধন করা হয়নি? আর যদি ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে, তাহলে এটি রাজনৈতিক অর্থসংগ্রহের ক্ষেত্রে এক নতুন সংকট তৈরি করছে।
এই ঘটনাটি শুধু একটি আরটিআই-এর তথ্য নয়; এটি বৃহত্তর নৈতিকতা, রাজনীতির স্বচ্ছতা এবং জনমানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। মানুষ সরকারকে বিশ্বাস করে দান করেন কিন্তু সেই বিশ্বাস যদি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুতর প্রশ্ন তোলে। এখন দেখার, এই অভিযোগ তদন্তে কী উঠে আসে, এবং বিজেপি এই বিতর্কের জবাব কীভাবে দেয়।

Whatsapp
