কেন ঢাকায় ফের তলব ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় বর্মাকে?
Bangladesh has summoned Indian High Commissioner Pranay Verma: ভিসা পরিষেবা বন্ধ, পাল্টা তলব, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ— সব মিলিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
ঢাকায় আবারও তলব করা হয়েছে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় বর্মাকে। মঙ্গলবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয় তাঁকে। কারণ একটাই,ভারতের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলির নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ। সাম্প্রতিক কয়েক দিনে একের পর এক বিক্ষোভ, উত্তেজনা ও ভাঙচুরের ঘটনার পর বাংলাদেশ মনে করছে, তাদের মিশন ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তা আর নিশ্চিত নেই।
নয়াদিল্লি, কলকাতা, আগরতলা ও শিলিগুড়ির মতো জায়গায় বাংলাদেশের হাইকমিশন বা সহকারী কনস্যুলেটের সামনে প্রতিবাদ, স্লোগান এবং কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলার ছবি সামনে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে হালকা ভাবে নিতে নারাজ। তাই সরাসরি কূটনৈতিক পথে উদ্বেগ জানানো হয়েছে ভারত সরকারকে।
পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে স্পষ্ট করে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট দেশের দায়িত্ব। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো দেশই অন্য দেশের দূতাবাস বা কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অভিযোগ, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি সেই দায়িত্ব পালনে ঘাটতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আরও পড়ুন
এক রাতের সহিংসতায় যে ভয়াবহতা দেখল বাংলাদেশ
এই ঘটনার প্রভাব শুধু কূটনৈতিক স্তরেই সীমাবদ্ধ নেই। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের জেরে ইতোমধ্যেই ভারতের কয়েকটি শহরে বাংলাদেশ মিশনের কনসুলার পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে ভিসা, পাসপোর্ট বা নাগরিক পরিষেবা নিতে এসে সমস্যায় পড়ছেন সাধারণ মানুষ। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগেও তার প্রভাব পড়ছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই নিয়ে চলতি মাসেই দ্বিতীয়বার প্রণয় বর্মাকে তলব করল ঢাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হওয়া এক ধরনের টানাপড়েনের লক্ষণ। কূটনৈতিক মহলের একাংশ এও মনে করছেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনার রেশ সরাসরি প্রভাব ফেলছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে বাংলাদেশ মিশনগুলিকে ঘিরে যে বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে কেবল কূটনৈতিক কারণ নয়, রাজনৈতিক আবেগ, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা তথ্য-ভিত্তিক বা ভ্রান্ত প্রচারেরও ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কারণ যাই হোক না কেন, তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্ককে।
বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট করেছে, তারা সংঘাত নয়, সমাধান চায়। তলবের উদ্দেশ্য কোনো হুমকি দেওয়া নয়, বরং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেই নিশ্চয়তা চাওয়া। ঢাকার বক্তব্য, দুই দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক এই ধরনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়।
ভারতের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, বিষয়টি তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কূটনৈতিক স্থাপনাগুলির নিরাপত্তা জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত সরকারও চায়, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার পথ খোলা থাকুক।
তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, এই মুহূর্তে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। ভিসা পরিষেবা বন্ধ, পাল্টা তলব, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ— সব মিলিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের জন্য যা মোটেই স্বস্তির নয়।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনীতিতে আসা ওসমান হাদি কে?
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সংযম, দায়িত্বশীল বক্তব্য এবং দুই দেশের সরকারের মধ্যে নিয়মিত ও খোলামেলা আলোচনা। কারণ ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক কেবল কাগজে-কলমের কূটনীতি নয়, এই সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সীমান্ত, বাণিজ্য, নদী, অভিবাসন এবং কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন।
ঢাকায় প্রণয় বর্মাকে তলব করার ঘটনা সেই বাস্তবতাকেই আবার মনে করিয়ে দিল। এটি স্পষ্ট করে দিল যে, কূটনৈতিক নিরাপত্তা কোনো ছোট বিষয় নয় এবং এর সঙ্গে আপস করার জায়গা নেই। একই সঙ্গে এই ঘটনাই দেখিয়ে দিল, দুই দেশের সম্পর্ক এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সামান্য অসাবধানতাও বড় কূটনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, এই তলবের পর ভারত ও বাংলাদেশ কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়। উত্তেজনা কমিয়ে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, নাকি অনাস্থার দেওয়াল আরও উঁচু হয়।

Whatsapp
