কেন তারেক রহমানের বাংলাদেশ ফেরা তাৎপর্যপূর্ণ?
Tarique Rahman’s Return: রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করছেন, তারেক রহমানকে ঘিরে অতীতের স্মৃতি এখনও ভোটারদের মনে রয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদিন ধরেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন? দীর্ঘ অপেক্ষা, নানা জল্পনা-কল্পনা এবং রাজনৈতিক পালাবদলের পর অবশেষে সেই প্রশ্নের একটি নির্দিষ্ট উত্তর সামনে এসেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঢাকা প্রত্যাবর্তন ঘিরে দলীয় রাজনীতি যেমন চাঙা হয়ে উঠেছে, তেমনই নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় পা রাখবেন তারেক রহমান। তাঁর ফেরাকে কেন্দ্র করে রাজধানী-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি চোখে পড়ছে। বিএনপি এই প্রত্যাবর্তনকে শুধুই একজন নেতার দেশে ফেরা হিসেবে দেখছে না; বরং এটি তাদের কাছে একটি রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের মুহূর্ত। সেই কারণেই তারেক রহমানকে অভ্যর্থনা জানাতে বড় পরিসরের কর্মসূচির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এই কর্মসূচিকে ঘিরে রেলপথে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ রেল মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১০টি রুটে বিশেষ ট্রেন চালানো হবে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এসব ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে। রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং রাষ্ট্রীয় পরিবহণ ব্যবস্থার এই সমন্বয় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আরও পড়ুন
২৬ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছেন তারেক রহমান! ক্ষমতার কুর্সি অপেক্ষমান?
তারেক রহমান দেশে ফেরার পরপরই রাজনৈতিক কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত হওয়ার ইঙ্গিতও মিলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, শনিবার তিনি ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হবেন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর এই তথ্য জানানো হয়। এটি স্পষ্ট যে, তারেক রহমান শুধু প্রতীকীভাবে দেশে ফিরছেন না, বরং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
এই প্রস্তুতিরই একটি অংশ হিসেবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় তারেক রহমানের নাম রয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তিনি বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এই আসনের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল বলে দাবি করছে বিএনপি।
২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি ও বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়ে প্রায় ১৮ মাস কারাবাসের পর তিনি চিকিৎসার অজুহাতে দেশ ছাড়েন। এরপর রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘ সময় যুক্তরাজ্যে থাকেন। বিদেশে বসেই তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিএনপির নীতি-নির্ধারণ ও সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দিয়ে আসেন।
এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির মধ্যেও দলীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব কমেনি। বিশেষ করে ২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর তারেক রহমান কার্যত দলের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। যদিও শারীরিকভাবে তিনি দেশে ছিলেন না, তবু সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনিই।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রত্যাবর্তন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গত বছরের জুলাই আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসে। সেই সময় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন নির্বাসিত থাকা একজন প্রধান রাজনৈতিক নেতার ফিরে আসা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
বিএনপির ভেতরে এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে নানা ধরনের মূল্যায়ন রয়েছে। দলটির একাংশ মনে করছে, তারেক রহমানের সরাসরি উপস্থিতি নির্বাচনী মাঠে একটি বড় ধরনের গতি এনে দেবে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের হতাশা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হবে। একই সঙ্গে, মনোনয়ন নিয়ে যে বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে সব বিশ্লেষণ যে একমুখী, তা নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করছেন, তারেক রহমানকে ঘিরে অতীতের স্মৃতি এখনও ভোটারদের মনে রয়ে গিয়েছে। বিএনপির শাসনামলের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ‘হাওয়া ভবন’ সংশ্লিষ্ট অভিযোগ এবং প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ— এসব বিষয় সহজে মুছে যাওয়ার নয়। ফলে শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক আবেগ দিয়ে নির্বাচন জেতা কঠিন হতে পারে।
আরও পড়ুন
প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার ৯! হামলা আটকানো গেল না কেন?
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংসদীয় কাঠামোর হওয়ায় এখানে জাতীয় পর্যায়ের নেতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিটি আসনের স্থানীয় প্রার্থী ও তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও বড় ভূমিকা রাখে। প্রতিটি আসনের প্রার্থীর নিজস্ব রাজনৈতিক ইমেজ, স্থানীয় সংগঠন এবং জনসংযোগ নির্বাচনের ফল নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে অনেকেই মনে করছেন, তারেক রহমানের ফেরা এককভাবে নির্বাচনী ফল ঘুরিয়ে দেবে— এমন ধারণা অতিরঞ্জিতও হতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আশঙ্কার কথাও উঠে আসছে বিভিন্ন মহলে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা নেতা-কর্মীদের মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কিংবা নিয়ন্ত্রণহীন আচরণ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। অতীতে নির্বাচনী সময়ের সহিংসতার ইতিহাস সামনে রেখে এই শঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী মহল, সিভিল সোসাইটি কিংবা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিএনপির প্রতি নতুন করে ঝোঁক তৈরি হতে পারে বলেও আলোচনা চলছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা। এই পরিবর্তনগুলো তারেক রহমান কী ভাবে সামাল দেবেন, সেটাই হবে বড় পরীক্ষা। দলের অন্দরের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা ছিল তাঁর প্রত্যাবর্তনের। তাঁদের কাছে তারেক রহমান শুধু একজন নেতা নন, বরং দলের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার প্রতীক। দলীয় কর্মসূচি, সাংগঠনিক নির্দেশনা এমনকি সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণাতেও তাঁর ছবি ও নাম বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এটি বিএনপির জন্য যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও কম নয়। অতীতের ছায়া কাটিয়ে বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তিনি কতটা কার্যকর নেতৃত্ব দিতে পারেন, সেই উত্তরই নির্ধারণ করবে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং দেশের নির্বাচনী রাজনীতির গতিপথ।

Whatsapp
