প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার ৯! হামলা আটকানো গেল না কেন?
Bangladesh media attack: হামলার কয়েক দিন পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ঢাকা-সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দুই দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারসহ দু'টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা কেবল গণমাধ্যমের নিরাপত্তা নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়েই বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ঘটনার কয়েক দিন পর একের পর এক গ্রেফতার হলেও, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, যে হামলা এতটা প্রকাশ্য ও দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে, তা কেন আগে আটকানো গেল না?
ঘটনার দিন প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে উঠে এসেছে, হামলাকারীরা যখন ভবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখনই সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় কোনো কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় ভূমিকা নেয়নি, এমন অভিযোগও রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্রযন্ত্র কি আদৌ তখন সক্রিয় ছিল, নাকি নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল?
এই হামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ঘটনার সময় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিও। তার মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হামলাকারীদের প্রতিরোধে সরাসরি না গিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। ভবনের ভেতরে আটকে পড়া সাংবাদিকদের নিরাপদে বের করে আনার জন্য তিনি প্রায় ২০ মিনিট সময় চাইছেন। এই দৃশ্য একদিকে যেমন প্রাণরক্ষা প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় শক্তির দৃঢ়তার অভাবও স্পষ্ট করে তোলে।
আরও পড়ুন
কেন ঢাকায় ফের তলব ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় বর্মাকে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি কার্যকর সরকার থাকলে সংবাদমাধ্যমে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে এত দীর্ঘ সময় লাগার কথা নয়। তাঁরা মনে করছেন, এই দেরি কেবল প্রশাসনিক অদক্ষতার ফল নয়; বরং এর পেছনে রাজনৈতিক ও কাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়টি স্পষ্ট। অনেকের আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেই এমন শক্তি রয়েছে যারা এই ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটতে দিতে চেয়েছে, অথবা অন্তত থামাতে আগ্রহ দেখায়নি।
এই প্রেক্ষাপটে সম্পাদক পরিষদ ও নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত যৌথ প্রতিবাদ সভায় দেওয়া বক্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিতর্কে। সেখানে বক্তারা দাবি করেন, হামলাকারীরা কিছু রাজনৈতিক স্লোগান ব্যবহার করে আক্রমণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। একইসঙ্গে অভিযোগ তোলা হয়, সরকারের ভেতরের একটি অংশ এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারে। এই বক্তব্য সরকারের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্নকে আরও গভীর করেছে।
হামলার কয়েক দিন পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ঢাকা-সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে এবং বাকি দু'জনের পরিচয় যাচাই চলছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাতজন হলেন— মো. কাশেম ফারুক, মো. সাইদুর রহমান, রাকিব হোসেন, মো. নাইম, ফয়সাল আহমেদ প্রান্ত, মো. সোহেল রানা এবং মো. শফিকুল ইসলাম। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা শাখা জানায়, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আরও অন্তত ৩১ জনকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা সক্ষমতা যে ছিল, তা এখন প্রমাণিত কিন্তু সেই সক্ষমতা আগেই কেন কাজে লাগানো হলো না, সেটিই মূল প্রশ্ন।
গ্রেফতারদের মধ্যে ৩ জনকে সরাসরি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়েছেন বলে ভিডিওতে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি পোস্ট করা হয়েছে, আবার কেউ লুটের অর্থ দিয়ে ইলেকট্রনিক পণ্য কেনার কথাও স্বীকার করেছেন। এদের কারও বিরুদ্ধে আগে থেকেই একাধিক মামলা থাকার তথ্যও সামনে এসেছে।
গ্রেফতার করা কাশেম ফারুক বগুড়ার আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র এবং ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা। মো. সাইদুর রহমান ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নোয়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। শেরপুর জেলার বাসিন্দা গ্রেফতারকৃত রাকিব হোসেন প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার-এ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত হয়েছে। তার আইডি থেকে ধ্বংসস্তূপের ছবি তুলে পোস্ট করা হয়। তিনি ফেসবুকে তার আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্টও করেন।
ঢাকার তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. নাইমকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এ ঘটনায় লুট হওয়া ৫০,০০০ টাকা-সহ গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাইম স্বীকার করেছেন যে সে মোট ১,২৩,০০০ (এক লক্ষ তেইশ হাজার) টাকা লুট করেছে। লুট করা টাকা দিয়ে সে মোহাম্মদপুর থেকে একটি টিভি ও একটি ফ্রিজ কিনেছিল, যা ইতোমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকার কারওয়ান বাজার রেললাইন এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত মো. সোহেল রানার বিরুদ্ধে মাদক-সহ অন্যান্য আইনে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা রয়েছে। একই এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত মো. শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অতীতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, হামলাকারীদের একটি অংশ পরিচিত অপরাধী, যাদের উপর নজরদারি আরও আগেই জোরদার করা যেত।
আরও পড়ুন
শিলিগুড়ি-আগরতলা-দিল্লি: যেভাবে বিক্ষোভের জেরে ব্যাহত বাংলাদেশের কনস্যুলার পরিষেবা
শুধু রাজধানী নয়, চট্টগ্রামেও ভারতের সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবনের আশপাশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টার ঘটনায় কয়েকজনকে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। এই তথ্য প্রমাণ করে, সহিংসতা ছিল বিচ্ছিন্ন নয়; বরং একই সময় দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছিল।
এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ‘ট্রানজিশনাল প্রসেস’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এই সময়েই কিছু গোষ্ঠী ভয়ংকরভাবে সেই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র করছে। তাঁর মতে, চলমান অস্থিরতা কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং রাজনৈতিক রূপান্তরের পথকে জটিল করে তোলার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি সরকার জানত যে দেশ একটি সংবেদনশীল রূপান্তরকাল অতিক্রম করছে, তাহলে কেন আগাম সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হয়নি? কেন হামলার পর গ্রেফতার সম্ভব হলো, অথচ হামলার আগমুহূর্তে তা ঠেকানো গেল না?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি— সব মিলিয়েই একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই শূন্যতাতেই সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়েছে।সংবাদমাধ্যমের উপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের পরীক্ষাও বটে। গ্রেফতার দেখিয়ে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও, মূল প্রশ্নের উত্তর না মিললে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে।
অতএব, এই হামলা শুধু অপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন নয়, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্ব, সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার এক কঠিন পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষায় সরকার এখনও উত্তীর্ণ হয়েছে কি না, সে রায় দিচ্ছে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজই।

Whatsapp
