বলতেই হবে জয় শ্রীরাম! ওড়িশা থেকে যেভাবে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন আশিক

Murshidabad migrant worker Ashik Mohammed: “হামলার শুরুটাই হয়েছিল একটি ধর্মীয় স্লোগান বলার দাবিকে কেন্দ্র করে,” ইনস্ক্রিপ্ট-কে জানান আশিক মহম্মদ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এখনও তাঁর গলা কেঁপে ওঠে।

ওড়িশায় কাজ করতে গিয়ে ২৪ ডিসেম্বর প্রাণ হারিয়েছেন মুর্শিদাবাদের ১৯ বছরের তরুণ জুয়েল রানা। কিন্তু সেই একই রাতে, একই রাস্তায়, একই হামলাকারীদের হাতে গুরুতর আহত হন জুয়েলের পরিচিত এবং মুর্শিদাবাদেরই আর এক পরিযায়ী শ্রমিক— আশিক মহম্মদ। জুয়েল আর ফেরেননি, আশিক ফিরেছেন ভাঙা বাঁ পা, যন্ত্রণায় কাঁপা শরীর আর আজীবনের আতঙ্ক নিয়ে।

ওড়িশার আইন্থাপল্লী থানার অন্তর্গত দানিপালি এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে আসা বাঙালি যুবক আশিক মহম্মদ সবজি কিনতে বেরিয়েছিলেন। তখনই হামলা হয় তাঁর উপর। জুয়েলের ঘর থেকে আশিকের ঘরের দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিট। কাজের জায়গাও প্রায় কাছাকাছি।

হামলার শুরুটাই হয়েছিল একটি ধর্মীয় স্লোগান বলার দাবিকে কেন্দ্র করে

ইনস্ক্রিপ্ট-কে জানান আশিক মহম্মদ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এখনও তাঁর গলা কেঁপে ওঠে। তিনি বলেন,

হঠাৎ করে কয়েকজন এসে আমাদের ঘিরে ধরে। ওরা প্রথমেই বলছিল ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে। আমি বলতে চাইনি। তখন ভাবলাম, আধার কার্ড দেখালে হয়ত ছাড়বে।

আশিক দ্রুত পার্স থেকে আধার কার্ড বের করে দেখান। কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলেনি।

আধার দেখিয়েও মার থামেনি। তারপরও মারছিল

বলেন আশিক।

আরও পড়ুন

এক মাসে তিন রাজ্যে তিন পরিযায়ী শ্রমিকের উপর হামলা! গোটা দেশে যে ভাবে কোনঠাসা জুয়েলের মতো বাঙালি মুসলিমরা

আশিকের কথায়, হামলাকারীরা ছিল মোট ছ’জন। তারা তিনটি বাইকে করে এসেছিল। সকলের কপালে ছিল লাল টিকা।

ওদের হাতে মোটা, বড় লোহার রড ছিল। ওই রড দিয়েই আমাকে মারে

জানান তিনি।

সে দিন রাতে প্রথমে জুয়েলের উপর আক্রমণ করা হয়। আশিক তখন কিছুটা দূরে। মুহূর্তের মধ্যেই আক্রমণ নেমে আসে তাঁর উপরেও।

হাত-পা ধরে মারছিল। আমি চিৎকার করছিলাম। কিন্তু কেউ ছাড়েনি। রডের কোপেই বাঁ পা ভেঙে যায়

বলেন আশিক।

মাথায় আঘাতের যন্ত্রণা এখনও কমেনি। শরীরের একাধিক জায়গায় কালশিটে। কিন্তু সবচেয়ে গভীর ক্ষতটা পড়েছে মনে। আশিকের দাবি, জুয়েলকে মারধর করে হত্যার পরেই হামলাকারীরা তাঁর দিকে আসে। তিনি বলেন, 

জুয়েলকে মেরে ফেরার পরই ওরা আমাকে মারে

এই বক্তব্য নতুন করে প্রশ্ন তুলছে— এটি কি নিছক উত্তেজনায় ঘটে যাওয়া ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত আক্রমণ?

বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি আশিক মহম্মদ

আশিক মহম্মদ পেশায় রাজমিস্ত্রি। মাত্র আড়াই মাস আগে কাজের খোঁজে ওড়িশায় যান তিনি। সংসারের দায়, জীবিকার তাগিদ— সব মিলিয়েই ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়া। কিন্তু সেই কাজই আজ তাঁর কাছে আতঙ্ক।

আর যাব না বাইরে কাজ করতে। মুর্শিদাবাদেই কাজ করব

স্পষ্ট বলেন আশিক।

ঘটনার পরদিনই আশিক-সহ মোট ১২ জন শ্রমিক একসঙ্গে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। তাঁদের অনেকেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তাঁরাও ওই এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতেন বলে জানান আশিক। মুর্শিদাবাদের সুতি থানায় আশিকের ঘটনায় একটি এফআইআর রুজু হয়েছে।

তবে প্রশ্ন উঠছে, কেন আশিককে নিয়ে নীরবতা? জুয়েল রানার মৃত্যু নিয়ে কিছুটা হলেও আলোচনায় এসেছে ঘটনা। কিন্তু যেভাবে জুয়েল, আশিকদের ঘটনা রাজনৈতিক মঞ্চে বা মিডিয়ার প্রাইমটাইমে উঠে আসা উচিত ছিল তা হয়নি। প্রশ্ন উঠছে, কেন জুয়েল, আশিকদের যন্ত্রণা অদৃশ্য?

হামলার সময় আশিককে ‘বাংলাদেশি’ বলে সন্দেহ করা হয়। 'জয় শ্রীরাম' বলাতে চাওয়া থেকে শুরু হয় বচসা, যা দ্রুত রূপ নেয় ভয়াবহ হিংসায়। এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন বাংলাদেশি’ ও ‘রোহিঙ্গা’ চিহ্নিত করার নামে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতার প্রেক্ষাপটে দেশে এক নতুন সামাজিক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, যার সরাসরি শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী মুসলমানরা। প্রশাসনিক নজরদারি ও যাচাইয়ের নামে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, আর সেই সন্দেহই একের পর এক জায়গায় রূপ নিচ্ছে গণহিংসায়। আর তার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকরা, যাঁরা কাজের খোঁজে রাজ্য ছাড়েন, কিন্তু সুরক্ষার কোনো নিশ্চয়তা পান না।

আরও পড়ুন

ফের যেভাবে ওড়িশার ১৪ জনকে বাংলদেশে ঠেলে দেওয়া হলো

ডিসেম্বর মাসেই ভারতের একাধিক রাজ্যে এই প্রবণতার ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি আলাদা রাজ্যে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিচয়, ভাষা কিংবা ধর্ম— এইগুলিই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

ওড়িশার এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২৪ সালেই ওড়িশায় কাজ করতে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসেন মুর্শিদাবাদের তিন পরিযায়ী শ্রমিক— সইরুদ্দিন মোমিন, রকিবউদ্দিন মোমিন ও মনজরুল শেখ। অভিযোগ, ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে তাঁদের উপর হামলা চালানো হয়েছিল। আহত অবস্থায় রাজ্যে ফিরে এসে চিকিৎসা নিতে হয় তাঁদের। ২০২৫ সালে একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন সুজন সরকার। প্লাস্টিকের সামগ্রী ফেরি করার কাজ নিয়ে ওড়িশায় গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানেও ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহ তুলে তাঁকে পুশব্যাক করা হয়। এখন জুয়েল রানা, আশিক মহম্মদের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটল।

সম্প্রতি আবার ওড়িশার ১৪ জনকে বাংলদেশে ঠেলে দেওয়া হলো। অভিযোগ, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ নারী, পুরুষ ও শিশু-সহ মোট ১৪ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁরা ভারতেরই নাগরিক তবুও তাদের ছাড়া হয়নি।

আশিকের প্রশ্ন,

আমি তো ভারতের নাগরিক। আধার দেখিয়েও কেন মার খেলাম?

এটিই আজ সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

More Articles