বেগম খালেদা জিয়া: গণতন্ত্রের এক নিঃসঙ্গ শেরপা

Khaleda Zia: ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে পদে পদে খালেদা জিয়াকে অপমান করার চেষ্টা করা হয়। তাঁর নামে কুৎসা রটানো হয়। স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়।

দলমত নির্বিশেষে সকলের, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখেও তাঁর আরোগ্যলাভের জন্য প্রার্থনা। তাঁর প্রয়াণে শোকাহত সারা বাংলাদেশ। পৃথিবীর এই কোণে, যেখানে রাজনৈতিক আচরণ সচরাচর পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে দাঁড়ায় না, সেখানে এই দৃশ্য কতটা বিরল তা সচেতন পাঠকরা ঠিকই ধরতে পারবেন। লোকে তাঁকে ডাকে আপসহীন নেত্রী বলে, নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধাভরে বলেন— ম্যাডাম, মাদার অব ডেমোক্রেসি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন মানুষ খুব কমই আছেন, যাদের নাম উচ্চারণ করলেই পুরো একটা সময়, এক বিশাল সংগ্রাম, এক অমোঘ দৃঢ়তা—একসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী, নিপীড়নের মুখেও অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী। আজ তিনি নেই—কিন্তু তিনি বাংলাদেশে রেখে গেছেন এমন এক রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, যা শুধু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামক একটি দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের মেরুদণ্ডে গাথা হয়ে আছে।

১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের দিনাজপুরে তাঁর জন্ম। অতি স্বাভাবিক, সাদামাটা, অভিজাত-গৃহবধূর জীবনই তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল। কিন্তু, ১৯৮১ সালের ৩০ মে তাঁর স্বামী বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর একটি বিদ্রোহী দলের হাতে শহিদ হলেন এবং খালেদা জিয়াকে ঘরের বাইরে এসে ধরতে হলো দলের হাল। তখন তাঁর রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা ছিল না, ভাবতেনও না রাজনীতি নিয়ে—কিন্তু দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁকে টেনে নিয়ে গেল এক দীর্ঘ, অস্থির, তীব্র সংঘর্ষে ভরা পথে। তিনি রাজি হলেন দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে। তাঁকে লড়াই করতে হয়েছিল সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে, যাকে লোকে ডাকত 'বিশ্ববেহায়া' বলে।

আরও পড়ুন- প্রয়াত বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া

এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন বেগম জিয়া। ১৯৮৬ সালের অবৈধ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও খালেদা জিয়া আন্দোলন চালিয়ে যান। সেই থেকে হাসিনার নাম হয় জাতীয় বেইমান, আর খালেদা জিয়ার নাম হয় আপসহীন নেত্রী।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ৭ বছরের মাথায় তাঁকে ৭ বার আটক করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাস, স্থিরতা কোনোদিনও নড়েনি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া পূর্ণতা পেত না। সেই থেকে তিনি পেলেন 'আপসহীন' তকমা, মার্জিত এই নারী হয়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

স্বৈরশাসনের পর বাংলাদেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি, প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান—সবকিছু আবার দাঁড় করানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। ভুলত্রুটি তাঁর ছিল—কে না করে? কিন্তু তাঁর আমলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, মর্যাদা কখনও প্রশ্নের মুখে পড়েনি। বাংলাদেশ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে, কিন্তু কখনও ঝুঁকিতে পড়েনি।

বাংলাদেশের ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনে ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলগুলো দাবি করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তখন খালেদা জিয়া বলেছিলেন,

পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।

এরপর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরোধী দলের কঠোর আন্দোলনে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু হয়।

২০০১ সালে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। শুরু থেকেই বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নানাভাবে অসহযোগিতা শুরু করে। দুর্নীতির অভিযোগ, জঙ্গি হামলা ও অন্যান্য ইস্যুতে বেশ চাপে পড়ে জোট সরকার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার মতো ঘটনায় প্রবলভাবে বিতর্কিত হয় সরকার। সঙ্গে জুড়ে যায় পাঁচবারের মতো দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মতো মিসলিডিং তকমা, যা পরবর্তীকালে নানাভাবে প্রোপাগান্ডায় ব্যবহৃত হয়েছিল। 

গণতন্ত্র খালেদা জিয়ার কাছে শুধু একটি রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না; এটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ব্যক্তিগত নৈতিকতা। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি—

“বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। বাংলাদেশই আমার শেষ ও একমাত্র ঠিকানা।”

এটা কেবল তাঁর কথার কথা নয়, এটা তাঁর জীবনদর্শন।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে পদে পদে খালেদা জিয়াকে অপমান করার চেষ্টা করা হয়। তাঁর নামে কুৎসা রটানো হয়। স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। নিঃসঙ্গ কারাবাস দেওয়া হয়। খালেদা জিয়াকে একটি জেলে একা রাখা হয়, যার পরিবেশ ছিল ভয়াবহ। সেখানে চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে নানা ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়। জেলের ভেতরে তাঁর মৃত্যুর ভয়ে করোনার সময় তাঁকে জামিন দেওয়া হয়। ২০২১ সালে তিনি আইসিইউতে, চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু শেখ হাসিনা বলেছিলেন-

খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি নয়?

আরও পড়ুন- ১৯৮৩ থেকে ২০১৮: কেন বারবার আটক খালেদা জিয়া?

পরবর্তীকালে এ-ও অভিযোগ উঠেছে যে, কারাগারের মধ্যে স্লো পয়জন করে তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়া জানতেন, তাঁর ভাগ্যে কী আছে। উনি মেনে নিয়েছিলেন, উনি দেশ ও জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তিনি নীলকণ্ঠের মতো বিষ পান করেছিলেন দেশের জন্য। তিনি পালিয়ে যাননি, তিনি হার মানেননি, তিনি ভেঙে পড়েননি, তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন বটগাছের মতো এক অসীম আত্মপ্রত্যয় নিয়ে। এক সন্তানকে হারিয়েছেন তিনি, আরেক সন্তান বিদেশে নির্বাসিত। তিনি যদি চাইতেন—সমঝোতা করতেন, নিরাপত্তা নিতেন, বিদেশে চলে যেতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন কঠিন পথ। কারণ তিনি বাংলাদেশের জন্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

তিনি এতটাই উদার ছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা পুরস্কার পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল তাঁর আমলে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এই সম্মান দেখানো কতটা বিরল!

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার শাস্তি বাতিল করে। তারপরও তাঁর আইনজীবীরা আপিল শুনানি চান। কেন? কারণ সেখানে ক্ষমার কথা আছে। খালেদা জিয়া অপরাধ করেননি। তিনি ক্ষমাও চাননি। তাই এটা আইনিভাবে মোকাবিলা করতে আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এখান থেকেই তাঁর আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি চলে গেলেন। নিপীড়ন তাঁকে ভাঙতে পারেনি, অপমান তাঁকে নত করতে পারেনি, শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা তাঁকে উইপোকার মতো খেতে পারেনি। অবশেষে মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেল।

বাংলাদেশ একটি যুগ হারালো। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর হারালো।

তাঁকে বিদায় জানাতে গিয়ে মনে পড়ে যায়—বাংলাদেশের জনগণ তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি, ইতিহাস ঠিকই দেবে। কারণ সময়ই সর্বশেষ বিচারক। এবং সময়ের আদালতে খালেদা জিয়া চিরকাল অটল দাঁড়িয়ে থাকবেন একজন আপসহীন নেত্রী হিসেবে।

More Articles