জুলাই বিপ্লবে জন্ম, ভোটের আগেই ভেঙে টুকরো টুকরো হবে এনসিপি?

Bangladesh NCP crisis: একদিকে নীতিগত অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে প্রার্থী বাছাই ও জোট রাজনীতির কৌশল নিয়ে অসন্তোষ— এই দুই মিলেই এনসিপিকে একটি দ্বিমুখী সংকটে ফেলেছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের আবেগ আর প্রত্যাশাই জন্ম দিয়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই আড়াআড়ি ভাঙনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই দলই৷ নেপথ্যে আদর্শগত সংঘাত। অস্তিত্ব রক্ষার্থে দলের একটা অংশ জামাতের সঙ্গে আসন সমঝোতার কথা ভাবছে, অন্য অংশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইতোমধ্যেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

তরুণ নেতৃত্ব, নতুন রাজনৈতিক ভাষা, সংস্কারের প্রতিশ্রুতি— সব মিলিয়ে এনসিপিকে ঘিরে প্রত্যাশার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু  সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্ভাব্য রাজনৈতিক জোট বা আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই এনসিপির ভেতরে মতভেদ প্রকাশ্যে আসে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০ জন সদস্য আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে নীতিগত আপত্তি জানান। স্মারকলিপিতে তাঁরা স্পষ্ট লেখেন, জামায়াতের অতীত রাজনৈতিক ভূমিকা, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অবস্থান, গণহত্যায় সহযোগিতা এবং সে সময় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ এনসিপির ঘোষিত মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁদের মতে, এমন একটি দলের সঙ্গে কোনো ধরনের জোট এনসিপির নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দলটির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

আরওপড়ুন

ক্ষমতায় থাকতে আসিনি, দায়িত্বপালন করে চলে যাব : শফিকুল আলম

এই স্মারকলিপি এনসিপির ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ ও সংশয়েরও বহিঃপ্রকাশ সামনে এনেছে। স্মারকলিপিতে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠনের বিভাজনমূলক তৎপরতা, রাজনৈতিক স্যাবোটাজ, অনলাইন অপপ্রচার এবং বিশেষ করে নারী নেতাদের চরিত্রহননের প্রবণতা নিয়ে। এমন অভিযোগ প্রকাশ্যে আসা মানেই দলের ভেতরের আস্থার সংকট আর গোপন নেই।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই দলের সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণা এনসিপির সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। ঢাকা-৯ আসন থেকে স্বতন্ত্রভাবে লড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি কার্যত দলীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে দাঁড়ালেন। তাঁর কথায় যেমন ব্যক্তিগত হতাশার কথা আছে, তেমনি বাস্তব রাজনৈতিক বাধার কথাও উঠে এসেছে। দলীয় প্রার্থী না হলে সংগঠন, প্রশাসন বা নিরাপত্তার সহায়তা না পাওয়ার কথা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়; এতে এনসিপির সংগঠনের দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়।

তাসনিম জারার সিদ্ধান্তের পর দলের ভেতরের প্রতিক্রিয়াও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এনসিপির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, এই সিদ্ধান্ত দলগত ভাবে নেওয়া হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েই ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় দলের শৃঙ্খলা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। এর আগেও একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দল ছেড়েছেন। জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকেই মনোমালিন্য আরও বাড়ছে।

তবে সামান্তা শারমিন ও নাহিদ ইসলামের সোস্যাল মিডিয়ার পোস্ট একসঙ্গে পড়লে বোঝা যায়, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সন্দেহ ও আপত্তি এনসিপির ভেতরে শুধু আলাদা কিছু নেতার নয়, বরং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেও রয়েছে। সামান্তা শারমিনের বক্তব্যে স্পষ্ট, জামায়াতকে তিনি ‘নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক মিত্র’ হিসেবে দেখেন না। তাঁর মতে, এনসিপির শুরুতেই যে তিনটি অঙ্গীকার ছিল— বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন, এগুলি মানলেই কেবল কোনো রাজনৈতিক জোট সম্ভব। এর বাইরে গিয়ে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা মানে এনসিপির ঘোষিত নীতির থেকে সরে আসা। একই সঙ্গে তিনি স্পষ্ট করেন, জামায়াতের সমালোচনা মানেই বিএনপির পক্ষে অবস্থান নয়, বরং এটি এনসিপির নিজস্ব আদর্শ রক্ষার প্রশ্ন।

অন্যদিকে, দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য আরও এক ধাপ এগিয়ে জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশলকে সরাসরি ‘প্রতারণা’ ও ‘সাবোটাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাঁর মতে, সংস্কার ও প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের প্রশ্নকে জামায়াত কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেছে নিজেদের দলীয় স্বার্থে, প্রকৃত রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে নয়। এই দুই অবস্থান মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়, এনসিপির ভেতরে সংকট কেবল নেতৃত্বের নয়, বরং আদর্শ বনাম রাজনীতির সংঘর্ষ। প্রশ্ন হলো, দলটি কি নিজের ঘোষিত নীতিতে অটল থাকবে, নাকি আপসের রাজনীতিতে গিয়ে সেই ভিত্তিকেই দুর্বল করবে?

একদিকে নীতিগত অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে প্রার্থী বাছাই ও জোট রাজনীতির কৌশল নিয়ে অসন্তোষ— এই দুই মিলেই এনসিপিকে একটি দ্বিমুখী সংকটে ফেলেছে। যাঁরা দল ছাড়ছেন, তাঁদের বক্তব্যে একটি সাধারণ সুর শোনা যাচ্ছে— দল তাঁর ঘোষিত আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছে। এই অভিযোগ যদি সত্যিই দলের বড় অংশের অনুভূতি হয়, তবে এনসিপির জন্য এটি নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত।

আরওপড়ুন

আসিফ, মাহফুজদের পদত্যাগ: বিএনপির দিকে ঝুঁকছেন তরুণ নেতারা?

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, নির্বাচনী কৌশল হিসেবে জোট রাজনীতি কি এনসিপির জন্য অপরিহার্য ছিল? ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা, বিপুল সংখ্যক মনোনয়নপত্র বিক্রি, তারপর প্রার্থী সংখ্যা কমিয়ে আনা— এই পুরো প্রক্রিয়াকেই দলের অন্দরের একটি অংশ ‘রাজনৈতিক অসংগতি’ হিসেবে দেখছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত অল্প কয়েকটি আসনের জন্য আপসহীনতার কথা বলা দলটির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে।

জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেওয়া একটি দলের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন। তারা চেয়েছিল পুরনো রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু ভোটের আগে জোট, আসন সমঝোতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল— এই পরিচিত চিত্রই কি আবার ফিরে আসছে? যদি তাই হয়, তবে এনসিপি কি খুব দ্রুতই সেই ‘নতুনত্বের’ মোড়ক হারাচ্ছে?

তবে এটাও সত্য, নতুন দল মানেই অভিজ্ঞতার অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সিদ্ধান্তগত ভুলের ঝুঁকি। এনসিপির বর্তমান সংকটকে কেউ কেউ সেই স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার সমস্যা হিসেবেও দেখছেন। প্রশ্ন হলো, দলীয় নেতৃত্ব কি এই সংকেতগুলো বুঝতে পারছেন? ভিন্নমতকে কি তাঁরা শত্রুতা না ভেবে আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসেবে নেবে?

ভোট যত ঘনিয়ে আসছে, এনসিপির সামনে সময় ততই কমে আসছে। এই মুহূর্তে দলটি যদি স্পষ্ট নীতিগত অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ ঐক্য গড়ে তুলতে না পারে, তবে নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, দলটির ভবিষ্যৎ অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। আড়াআড়ি ভাঙন কি রোধ করা যাবে, নাকি জুলাই বিপ্লবের আবেগে জন্ম নেওয়া এই দল ভোটের আগেই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে— এর উত্তর খুব শিগগিরই রাজনীতির ময়দানেই পাওয়া যাবে।

More Articles