কেন গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আগ্রহ ট্রাম্পের?

Greenland: দ্বীপটিতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বিরল খনিজ, যেমন রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস, ইউরেনিয়াম, লোহা, জিঙ্ক ও তেলের সম্ভাব্য মজুত।

গ্রিনল্যান্ড— বরফে ঢাকা, জনসংখ্যায় অল্প, কিন্তু ভূরাজনীতিতে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এক ভূখণ্ড। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই দ্বীপটি বহুদিন ধরেই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির নজরে থাকলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে গ্রিনল্যান্ড নতুন করে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছে। ট্রাম্প একাধিকবার প্রকাশ্যে গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, প্রথমে অনেকের কাছে রসিকতা বা খেয়ালখুশির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হলেও, বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক হিসাব।

গ্রিনল্যান্ড বর্তমানে ডেনমার্কের অধীন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। যদিও এর নিজস্ব সরকার রয়েছে, তবুও পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির নিয়ন্ত্রণ ডেনমার্কের হাতেই। ট্রাম্প ২০১৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিলে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী সেটিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। এর জবাবে ট্রাম্প ডেনমার্ক সফর বাতিল করেন। এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়, বিষয়টি কেবল কৌতূহল নয়; বরং ট্রাম্প প্রশাসন গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছিল।

গ্রিনল্যান্ডের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রহের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। উত্তর আটলান্টিক ও আর্কটিক অঞ্চলের মাঝামাঝি অবস্থানের কারণে গ্রিনল্যান্ড এমন একটি জায়গায় রয়েছে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও রাশিয়ার দিকে সহজেই নজর রাখা যায়। এই ভৌগোলিক অবস্থান গ্রিনল্যান্ডকে স্বাভাবিকভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্রের মতো করে তুলেছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এখানে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। গ্রিনল্যান্ডের থুলে, যা এখন পিটুফিক নামে পরিচিত, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্পেস ঘাঁটি রয়েছে। এই ঘাঁটি থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হলে আগেভাগেই তা শনাক্ত করা যায়, তাই এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়া ও চিনের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তার প্রেক্ষিতে গ্রিনল্যান্ডের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

আরও পড়ুন

‘বর্জ্যের উপনিবেশবাদ’! আমেরিকার ই-বর্জ্যে ডুবে যাচ্ছে এশিয়া

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন গ্রিনল্যান্ডকে নতুন করে বিশ্ব শক্তির মানচিত্রে তুলে ধরেছে। বরফ গলতে শুরু করায় সেখানে নতুন সমুদ্রপথ খুলে যাচ্ছে, যা বাণিজ্য ও সামরিক চলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্কটিক অঞ্চলের এই নতুন নৌপথ ভবিষ্যতে সুয়েজ বা পানামা খালের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে এটি পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ— যুক্তরাষ্ট্র চায়, এই নতুন পথের উপর তার সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ থাকুক।

তৃতীয় এবং সবচেয়ে লোভনীয় কারণ হলো গ্রিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ। দ্বীপটিতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বিরল খনিজ, যেমন রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস, ইউরেনিয়াম, লোহা, জিঙ্ক ও তেলের সম্ভাব্য মজুত। আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে ইলেকট্রিক গাড়ি, স্মার্টফোন ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে রেয়ার আর্থ ধাতুর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে এই খাতে চিনের আধিপত্য রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য চিনের উপর এই নির্ভরতা কমানো। সেই কারণে গ্রিনল্যান্ডকে তারা একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প উৎস হিসেবে দেখেছে।

চিনের উপস্থিতি ট্রাম্পের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তোলে। গত এক দশকে চিন গ্রিনল্যান্ডের পরিকাঠামো উন্নয়ন, খনি প্রকল্প ও গবেষণায় আগ্রহ দেখিয়েছে। যদিও ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে সেই প্রস্তাব আটকে দিয়েছে, তবুও বেইজিংয়ের আগ্রহ ও প্রভাব ওয়াশিংটনের কৌশলবিদদের চোখে স্পষ্ট। ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে আর্কটিকে চিনের প্রবেশ কার্যত রুদ্ধ করা সম্ভব হত— এমনটাই বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা।

ট্রাম্পের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিও এই আগ্রহের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তিনি রাজনীতিকে প্রায়ই রিয়েল এস্টেট ডিলের মতো দেখতেন। ইতিহাসেও উদাহরণ রয়েছে— ১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনেছিল, যাকে তখন অনেকেই ‘সেওয়ার্ডস ফলি’ বলে বিদ্রূপ করেছিলেন, কিন্তু পরে সেটিই যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়। ট্রাম্প নিজেকে সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন বলেই অনেক বিশ্লেষকের মত।

তবে গ্রিনল্যান্ডের মানুষ এই ধারণা মোটেই স্বাগত জানায়নি। গ্রিনল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতারা স্পষ্ট করে বলেছেন, দ্বীপটি বিক্রির জন্য নয়। বরং তাঁরা ভবিষ্যতে ডেনমার্ক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ট্রাম্পের মন্তব্য অনেক গ্রিনল্যান্ডবাসীর কাছে তাঁদের আত্মসম্মান ও স্বায়ত্তশাসনের উপর আঘাত বলে মনে হয়েছে। এই দিকটি ট্রাম্পের প্রস্তাবে প্রায় সম্পূর্ণ উপেক্ষিত ছিল।

আরও পড়ুন

কার স্বার্থে বিপন্ন আরাবল্লী?

আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও এই প্রস্তাব অস্বস্তিকর। আধুনিক বিশ্বে একটি ভূখণ্ড ‘কেনাবেচা’ করার ধারণা ঔপনিবেশিক যুগের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। ইউরোপীয় দেশগুলো বিশেষ করে ডেনমার্ক এটিকে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন হিসেবে দেখেছে। ট্রাম্পের প্রস্তাব তাই কেবল কূটনৈতিক বিতর্কই নয়, নৈতিক প্রশ্নও তুলে দেয়।

তবু এটাও সত্য যে, ট্রাম্পের এই আগ্রহ গ্রিনল্যান্ড ও আর্কটিক অঞ্চলের গুরুত্ব বিশ্ববাসীর সামনে নতুন করে তুলে ধরেছে। তাঁর বক্তব্যের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। নতুন কনস্যুলেট খোলা হয়েছে, বিনিয়োগ ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সরাসরি কেনার প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হলেও, ট্রাম্পের আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের আর্কটিক কৌশলকে আরও আক্রমণাত্মক করেছে।

সব মিলিয়ে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহকে কেবল অদ্ভুত বা হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া ভুল হবে। এর পেছনে কাজ করছে বিশ্ব রাজনীতির হিসাব, প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে টানাপোড়েন, চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন পরিস্থিতি। ট্রাম্প হয়ত প্রকাশ্যেই গ্রিনল্যান্ড নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে এই দ্বীপ নিয়ে যে লড়াই শুরু হয়েছে, তা আগামী কয়েক দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

More Articles