জোহরান মামদানির জয় || এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনা
Zohran Mamdani’s New York Victory: ভোটাররা পুরনো অভিজাত প্রার্থীদের সরিয়ে ভোট দিয়েছেন এমন নেতাকে, যিনি মানুষের জীবন বোঝেন। এই জয় শুধু নিউইয়র্কের জন্য নয়, এটি নতুন রাজনৈতিক যুগের পূর্বাভাস।
২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা উত্তাপ, সংঘাত, এবং নির্বাচনী নাটকের মাঝেও একটি নাম আলোকিত হয়ে উঠেছে— জোহরান মামদানি। ৩৪ বছর বয়সি এই যুবক শুধু নিউইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র নয়, হয়ে উঠেছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্ষোভ, আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মামদানি প্রমাণ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে সাধারণ মানুষও পছন্দের নেতৃত্বকে বেছে নিতে পারে। ২০২৫ সালে বিশ্ব রাজনীতির সবেচেয়ে বড় চুম্বক ট্রাম্পের গড়ে মামদানির ওভারট্রাম্প।
মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র হয়েছেন। তাঁর উত্থান বোঝার জন্য শহরটির স্বরূপ জানা জরুরি। নিউইয়র্ক আয়তনে ভারতের এক পঞ্চমাংশের চেয়েও ছোট, কিন্তু জিডিপির পরিমাণে সে দেশের প্রায় অর্ধেকের সমান। নিউইয়র্কের ১২৩ জন বিলিয়নিয়ারের হাতে রয়েছে ৭৫৯ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। এই সম্পদ কেন্দ্রীকরণই— আকাশছোঁয়া চিকিৎসা খরচ, স্টুডেন্ট লোন, মাদক পাচার আর আকাশছোঁয়া দুর্নীতির উৎস। এর ঠিক উল্টোমেরুতে বাঁচেন আবাসন আর দ্রব্যমূল্যের সংকটে জর্জরিত সাধারণ নিউইয়র্কবাসীরা। তিন দশক আগে নিউইয়র্কে মধ্যবিত্তরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি কিনতে পারত, এখন তারা ভাড়াবাড়ির গোলকধাঁধায় জীবন কাটিয়ে দেয়। আর এই শহরের সাধারণ মানুষের সংকট দূর করার কথা বলেই মসনদে মামদানি।
উগান্ডায় জন্মগ্রহণ করা এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম যুবক ছোটবেলায় যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। পড়াশোনা শেষে যখন হাউজিং কাউন্সিলর হিসেবে কাজ শুরু করেন, তখনই তিনি বুঝতে পারেন, ঝকঝকে স্কাইস্ক্র্যাপারের আড়ালে হাজারো নিম্নবিত্ত মানুষের সংগ্রাম লুকিয়ে আছে। যারা মাসে মাসে ভাড়া দিতে না পারলে উচ্ছেদ হয়, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে যোগ দেন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অফ আমেরিকা (DSA), যাদের বিশ্বাস— খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান কারো দয়া নয়, মৌলিক অধিকার। সেই থেকেই শুরু হয় মামদানির নিজস্ব ভাষায় রাজনৈতিক লড়াই।
আরও পড়ুন
নেহরুর প্রতিধ্বনি নিউইয়র্কে! ঐতিহাসিক বিজয়ভাষণে মামদানি যা বললেন
মেয়র নির্বাচনে মামদানির প্রচারকৌশল ছিল অনন্য। তিনি ব্যয়বহুল মিডিয়া বা কর্পোরেট ম্যানেজারের উপর ভরসা করেননি। ছোট ভিডিও, রাস্তায়-রাস্তায় স্বেচ্ছাসেবকরা, ওলি-গলিতে দাঁড়িয়ে বার্তা পৌঁছে দেওয়া— এগুলিই ছিল তাঁর প্রচারের অস্ত্র। প্রতিটি বাঙালি, হিন্দি, উর্দুভাষী ভোটারের কাছে পৌঁছেছেন নিজের ভাষায়। নিজস্ব অপটু উচ্চারণ নিয়েও তিনি সংকোচ করেননি। মাটির গন্ধ মেশানো এই প্রচারকৌশলকে কোনো ধনকুবের বা কর্পোরেট ব্যক্তি প্রভাবিত করতে পারেননি। নিন্দামন্দে বিশেষ কাজ হয়নি। জরিপে উঠে এসেছে, শেষ পাঁচ মেয়রের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় তিনি।
এই অবস্থান অবশ্য নিউইয়র্কের বিত্তশালীদের কাছে বিপজ্জনক ছিল। কারণ এই এলিটরা হাইপার ক্যাপিটালিজম এবং জায়োনিস্ট ন্যারেটিভের মাধ্যমে নিজের সুবিধা নিশ্চিত করে রেখেছে। মামদানি দুই স্তম্ভকেই সরাসরি আক্রমণ করেছেন। মেয়র নির্বাচনের আগেই জনসমক্ষে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে গ্রেফতার করবেন। এই স্পষ্ট অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ মনে মামদানি নতুন আলো উদ্ভাসিত করেছেন। মানুষ বুঝেছে সবটাই অতি দক্ষিণপন্থীদের হাতে চলে যায়নি।
ভোটযুদ্ধে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন অ্যান্ড্রু কৌমো। ট্রাম্প নিজে প্রার্থী না হলেও কৌমোকে সমর্থন করেন, কারণ রিপাবলিকান প্রার্থী জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। ভোটের আগে ট্রাম্প বারবার আক্রমণ করে বলতে থাকেন, 'মামদানি কমিউনিস্ট', “নিউইয়র্কে জিতলে ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করব।” ইলন মাস্কও কৌমোকে সমর্থন করেন। তবুও এই সব আক্রমণ সত্ত্বেও মামদানি জিতেছেন ৫০.৪% ভোটে। জয়ের পর দেখা গেল তরুণ ভোটার, অভিবাসী এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রমিকদের মধ্যে উল্লাস। নিউইয়র্কের রাস্তায় তাঁর জয়ের আনন্দ ছিল অসীম। ৮.৫ মিলিয়ন মানুষের শহরের ভবিষ্যৎ আজ সাধারণ মানুষের হাতে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, এটি রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা।
মামদানিকে নিয়ে ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ার নীরবতা চোখে পড়ার মতো। ভারতীয় বংশোদ্ভূত, দক্ষিণ এশীয়, মুসলিম— এই পরিচয়ের জন্য অনেক মূল স্তরের মিডিয়া মামদানিকে এড়িয়ে গিয়েছে। ঋষি সুনক বা প্রীতি প্যাটেলের সাফল্যে উচ্ছ্বাসিত মিডিয়া, কিন্তু মামদানিকে নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখায়নি। বিশেষ করে গাজায় ইজরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ সম্ভবত বড় মিডিয়ার পছন্দ হয়নি। কারণ তাঁর প্রথম থেকে ইজয়ারেলে পক্ষে গলা ফাটিয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদের হাত শক্ত করা মিডিয়া তাঁকে লাইমলাইটে আনতে চায়নি। যদিও সমান্তরাল মাধ্যমগুলিতে ব্যাপক চর্চা হয়েছে তাকে নিয়ে।
ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে নিউইয়র্কের শক্তিশালী দুই লবি, ট্রাম্পপন্থী ও ক্যাপিটালিস্টরা তাঁকে প্রতিটি পদে বাধা দিতে চাইবে। জোহরান মামদানির জনমুখী প্রকল্পগুলো সেনেটে আটকে যেতে পারে। তবে মামদানির জয় প্রমাণ করেছে, সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো নেতা চাইলে মানুষ তাঁকে জিতিয়ে দিতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শহরের মেয়র হিসেবে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম যুবকের নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন,
I’m a democratic socialist।
আবিশ্ব তখন মনে করে জহরলাল নেহরুকে। আর এটাই তাঁকে ২০২৫ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত করেছে। নির্বাচনে তাঁর বিজয় শুধু নিউইয়র্ক নয়, বিশ্বজুড়ে প্রগতিশীল রাজনীতিকে অক্সিজেন যুগিয়েছে।
আরও পড়ুন
কোন মন্ত্রে ট্রাম্পের দুর্গে এত বড় ফাটল ধরালেন মামদানি?
তিনি বড় পোস্টার বা ব্যয়বহুল প্রচারে ভরসা করেননি। কোনো দেখনদারি ছিল না তাঁর প্রচারে। বরং হেঁটেছেন মানুষের দরজায় দরজায়, কথা বলেছেন ভাড়া, বাসস্থান, শিশুযত্ন, শ্রমিকের অধিকার ও স্বাস্থ্য নিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক ভাষা সহজ, প্রাণবন্ত এবং তরুণদের কাছে বোধগম্য। সোশ্যাল মিডিয়ার ছোট ভিডিও, কৌতুক, সাংস্কৃতিক রেফারেন্স— রাজনীতিকে দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত করেছে। ভোটাররা পুরনো অভিজাত প্রার্থীদের সরিয়ে ভোট দিয়েছেন এমন নেতাকে, যিনি মানুষের জীবন বোঝেন। এই জয় শুধু নিউইয়র্কের জন্য নয়, এটি নতুন রাজনৈতিক যুগের পূর্বাভাস। যেখানে অভিবাসী, শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু, মধ্যবিত্ত—রাজনীতির প্রান্তে থাকা মানুষই কেন্দ্রে আসে। তবে এই জয় বড় দায়িত্বও আনে। ভাড়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুবিচার—এসব ক্ষেত্রে বাস্তব কাজ, প্রশাসনিক দক্ষতা ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার প্রয়োজন। মামদানির কার্যক্রম কতটা সফল হবে, তা ভবিষ্যত বলবে।
জোহরান মামদানি ও ট্রাম্পের ওভাল অফিস বৈঠকের কথা না বললে এই ধারাবিববরণী শেষ হবে না। নির্বাচনী উত্তাপ, দ্বন্দ্ব, তির্যক মন্তব্য এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উত্তেজনা পেরিয়ে, বৈঠক শেষে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার বার্তা দেন তাঁরা। এক ঘণ্টার সেই সাক্ষাৎকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে হইহট্টোগোল শুরু হয়। প্রচারে তীব্র ঝাঁঝ থাকলেও মামদানি সাক্ষাতে সৌজন্যের পরিচয়ই দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন, এমন নেতা কি নিউইয়র্কের একার প্রাপ্য!

Whatsapp
