গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া

Khaleda Zia death: খালেদা জিয়ার মধ্যে রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। রূপান্তরমূলক নেতৃত্ব হলো এমন এক ধরনের নেতৃত্বের মডেল, যা সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য একটি সম্মিলিত উৎসাহের উপর নির্ভর করে।

খালেদা জিয়া রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর বিরল ব্যক্তিত্বের কারণেই এই গুণাবলি তাঁর মধ্যে ছিল। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন এক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। স্বৈরাচারের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির প্রতি অবিচল থেকেছেন। কখনোই হাল ছাড়েননি। আর তাই তিনি 'আপসহীন নেত্রী'র উপাধি লাভ করেছেন। এই যে দৃঢ়তা, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা, নমনীয় না হওয়া, এসব বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শুধু বাংলাদেশই বা বলছি কেন। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই এই ধরনের রাজনৈতিক চরিত্র খুব কম দেখা যায়। এখানেই খালেদা জিয়া অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে। অন্যান্য রাজনীতিবিদরা যখন সকাল বিকাল কথার বা মতের পরিবর্তন করছেন, খালেদা জিয়া তখন নিজের জায়গাতেই অনড় হয়ে বসে আছেন। এ কারণে তাঁর দলকে যে ভুগতে হয়নি, তা বলা যাবে না। কিন্তু তিনি তাঁর নীতির সঙ্গে কখনও আপস করেননি।

চাইলে খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে আপস করতে পারতেন। এই ধরনের প্রস্তাব তাঁকে বহু বার দেওয়া হয়েছিল। বিদেশে চিকিৎসা করাতে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি এসব প্রস্তাবে রাজি হননি। দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতেই তাঁর মৃত্যু হলো। দেশের মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৮০ বছর বয়সে অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। আর তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। খালেদা জিয়ার এই মৃত্যুর নেপথ্যে শেখা হাসিনার দায় আছে। মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দিয়ে বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় শেখ হাসিনা। কিন্তু মারা গিয়েও খালেদা জিয়া বেঁচে রইলেন। আর শেখ হাসিনা জীবিত থেকেও আজ মৃত।

খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসার পর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। রূপান্তরমূলক নেতৃত্ব হলো এমন এক ধরনের নেতৃত্বের মডেল, যা সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য একটি সম্মিলিত উৎসাহের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে, নেতা দলের মধ্যে গণ উৎসাহের সৃষ্টি করেন নিজের ভাবমূর্তি ব্যবহার করে। নেতা দলের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধি করে, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ উদ্দেশ্যের সঙ্গে দলের অবস্থানের সামঞ্জস্য করেন।

আরও পড়ুন - বেগম খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের পাঞ্জেরী

খালেদা জিয়া আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীকালে সারা দেশে নতুন এক উৎসাহের সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথমে তিনি জনসাধারণকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহিত করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত করেন। তারপর তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে চলে আসেন এবং চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি দেশের উন্নয়নের কাজে মনযোগ দেন। নতুন নতুন রাষ্ট্রীয় নীতি প্রনয়ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করেন। কোনো শাসকের পক্ষে একা একটি রাষ্ট্রকে রূপান্তর করা সম্ভব নয়, তবে তিনি জনসাধারণকে উৎসাহিত করতে পারেন। যেমন খালেদা জিয়ার আমলে, তিনি অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য একাধিক দরজা খুলে দেন। ফলে বস্ত্রশিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। তিনি আমাদানি ও রপ্তানি নীতি শিথিল করে দেন। ফলে অনেকেই শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। এবং উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। এবং সেই শিক্ষা দান করা হয় বিনামূল্যে। ফলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায়। নারীদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। নারীর ক্ষমতায়নে খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়াও, তিনি পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ও বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করেন। খালেদা জিয়া আন্দোলন, সংগ্রাম ও দেশগঠনে এক ধরনের রূপান্তরের চেষ্টা করে গেছেন। তিনি জনসাধারণকে আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি দেশ গঠনেও উদ্বুদ্ধ করেছেন সমানতালে। এটাই খালেদা জিয়ার ক্যারিশমা। রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্যই হলো নেতৃত্বের ক্যারিশমা। যারা দ্বারা দেশের মানুষ প্রভাবিত ও অনুপ্রানিত হয়। তিনি সারা দেশের মানুষকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন সফলভাবে।

আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে নানা ধরনের হতাশা ও সমালোচনা ছিল। আওয়ামী লীগসহ অনেকেই সমালোচনা করে বলেন, ঈদের পরে বিএনপির আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু সেই ঈদ আর আসেনি। খালেদা জিয়াকে বালুর ট্রাক দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়েছিল বেআইনি ভাবে। বিএনপির নেতা কর্মীরা বালুর ট্রাক সরিয়ে খালেদা জিয়াকে উদ্ধার করতে পারেনি। জেল থেকে তাঁকে বের করে আনতে পারেনি।

এখানে মনে রাখতে হবে, বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। বিএনপি মধ্যবাম ধারার উদার রাজনৈতিক দল। যদিও বিএনপিসহ অনেকেই বিএনপিকে মধ্যডান বা ডানপন্থী দল মনে করেন। কিন্তু গঠনতন্ত্র, দলীয় আদর্শ, কর্মসূচি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাদের কথা বিবেচনা করলে বিএনপি অবশ্যই একটি মধ্যবাম ধারার রাজনৈতিক দল, যারা সুষম বন্টন এবং সকলের অংশগ্রহণ, অধিকারের কথা বলে। এই রকম একটি দলের পক্ষে আওয়ামী লীগের মতো লগি বৈঠার হত্যার রাজনীতি করা সম্ভব নয়। বিএনপি এটা করেওনি। বরং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বরাবরই বাংলাদেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উস্কানি ছিল। বিএনপির নেতা কর্মীরা যদি শেষ পর্যন্ত বালুর ট্রাক সরিয়ে খালেদা জিয়াকে উদ্ধার করতেন বা জেল ভেঙে বের করে আনতেন তবে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের সমূহ আশঙ্কা ছিল। এবং তার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

৫ অগাস্টের বিপ্লবের পর ভারতের শেখ হাসিনা উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া এরকমই ইঙ্গিত দেয়। বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি করে, আওয়ামী লীগকে রক্ষার নামে ভারতের হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা ছিল।

এই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে বিএনপি বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে ছিল। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তিনি নিজে জেলে গিয়েছেন মিথ্যা মামলায় কিন্তু নেতা কর্মীদের সংযত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সবার আগে তিনি নিজের দেশ ও জাতির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেছেন। বিনা চিকিৎসায় ভুগেছেন কিন্তু আপস করেননি, দেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেননি।

আরও পড়ুন- বেগম খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের ঐক্যের শেষ প্রতীক

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপসহীন লড়াই-সংগ্রাম জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির রাজনীতিতে একটি শক্ত ভিত্তির উপর সেই সংগ্রামকে দাঁড় করিয়েছেন খালেদা জিয়া। এবং এটিই বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ তার নিজের ভোট নিজে দেবে। জনগণ এই ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের সরকার গঠন করবে। এমনকি বাংলাদেশে বিপ্লব, সমাজ পরিবর্তন, গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার রাজনীতির ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারিয়ে যাবে না। বরং বাংলাদেশে বিপ্লব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের সকল শ্রেণির, পেশার মানুষ তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারবে এবং অধিকারের জন্য লড়াই করবে। জনগণ শ্রেণি সচেতন হবে যার অনিবার্য পরিণতি বিএনপি। সেই বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে।

পুঁজিবাদ এখন মুমূর্ষু, পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে। তাই সমাজ বিপ্লবীরা বলছেন বস্তুবাদী দর্শকেরা হবেন সমাজতান্ত্রিক ঘাতক। সেই সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশে স্পৃহা ও সংগ্রামের যথাযথ পরিবেশ দরকার। একমাত্র গণতন্ত্রই পারে সেই শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের পরিবেশ নিশ্চিত করতে। তাই এই কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও খালেদা জিয়া ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করবে।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More Articles