ট্রাম্প থেকে রাজপুত্র অ্যান্ড্রু! তৃতীয় এপস্টাইন ফাইল আরও ভয়ঙ্কর

Epstein Files Controversy: ২০০৩ সালে এপস্টাইনের জন্মদিন উপলক্ষে ট্রাম্প একটি অদ্ভুত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যেখানে নগ্ন মহিলার একটি স্কেচ ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে আচমকাই কিছু নথি ও ছবি উধাও হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে নতুন করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিতর্কের জন্ম হয়েছে ওয়াশিংটনে। এই নথিগুলির কেন্দ্রে রয়েছে কুখ্যাত যৌন অপরাধী ও আর্থিক লগ্নিকারী জেফরি এপস্টাইন— যার নাম এক দশকের বেশি সময় ধরে আমেরিকার ক্ষমতাবান রাজনীতি, ধনকুবের সমাজ এবং বিচার ব্যবস্থার অস্বস্তিকর অধ্যায় হয়ে উঠেছে। আর সেই পুরনো বিতর্কের মধ্যেই ফের উঠে এসেছে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম।

গত সপ্তাহে মার্কিন বিচার বিভাগ জেফরি এপস্টাইন সংক্রান্ত তদন্তের নথির একটি বড় অংশ প্রকাশ করে। এই প্রকাশিত নথির মধ্যে ১১ হাজারেরও বেশি আলাদা ফাইল রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার পৃষ্ঠার তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, এই নথিগুলিতে রয়েছে বিভিন্ন ছবি, সাক্ষাৎকারের প্রতিলিপি, ইমেইল ও তদন্ত সংক্রান্ত তথ্য। কিন্তু প্রকাশের এক দিনের মধ্যেই দেখা যায়, অন্তত ১৩টি ছবি কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই ছবিগুলির একটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতি ছিল বলে জানা যায়। পরে সমালোচনার মুখে ওই ছবিটি ফের প্রকাশ করা হলেও বাকি ফাইলগুলি দীর্ঘ সময় অনুপস্থিতই থাকে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাউস ওভারসাইট কমিটির ডেমোক্র্যাট সদস্যরা সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের ভূমিকা নিয়ে। তাঁদের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনসমক্ষে আসার আগেই আবার কি কোনো ভাবে সেগুলি চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে? 

আরও পড়ুন

বোমা ফাটালেন মাস্ক! যৌন বিতর্কে জড়িত ট্রাম্প? কী আছে এপস্টাইন ফাইলে?

মার্কিন বিচার বিভাগ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাঁদের বক্তব্য, ভুক্তভোগীদের পরিচয় ও নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থেই কিছু নথি সাময়িকভাবে সরানো হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, বিষয়গুলি আরও একবার খতিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল এবং এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত নয়। বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবিটিও একই কারণে সাময়িকভাবে সরানো হয়েছিল।

এই ব্যাখ্যা অবশ্য পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি বিরোধীদের। কারণ, এপস্টাইন সংক্রান্ত নথি প্রকাশ নিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের অবিশ্বাস কাজ করছে। বহু বছর ধরে অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকার কারণেই এই ফাইলগুলি পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি বা বিলম্বিত হয়েছে।

 

এপস্টেইন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আইনজীবী টড ব্লাঞ্চ অবশ্য এই বিতর্ককে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এনবিসি নিউজে তিনি দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এপস্টাইন সংক্রান্ত কোনো নথি গোপন করার প্রশ্নই ওঠে না। ব্লাঞ্চের যুক্তি, এপস্টাইনের সঙ্গে ট্রাম্পের একাধিক ছবি আগেই প্রকাশ্যে এসেছে এবং সেগুলি বহু বছর ধরেই জনসমক্ষে রয়েছে। তাই শুধুমাত্র একটি ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এই দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করেন তিনি।

আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী, নিউইয়র্কের এক বিচারক আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদি কোনো ভুক্তভোগী বা অধিকার রক্ষা সংগঠন নথি প্রকাশ নিয়ে আপত্তি তোলে, তাহলে তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। সেই নির্দেশ মেনেই কিছু ছবি ও নথি সরানো হয়েছিল বলে দাবি তাঁর।

এনবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার এমন কিছু তথ্য সামনে এসেছে, যা আগেও আলোচিত ছিল, তবে এবার সেগুলি সরকারি নথির মাধ্যমে আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে এসেছে। এই নথিগুলিতে সবচেয়ে বেশি নজর পড়েছে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স অ্যান্ড্রুর নাম ঘিরে। তবে বিচার বিভাগ স্পষ্ট করে জানিয়েছে, নথিতে কারও নাম থাকা মানেই সে অপরাধী— এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই নথিগুলি কেবল সাক্ষ্য, ইমেইল, ফোন রেকর্ড বা ফ্লাইট লগের সংকলন, যেগুলোর সত্যতা আলাদাভাবে প্রমাণিত নয়।

কিছু ফ্লাইট রেকর্ডে ট্রাম্পের নাম রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় তিনি এপস্টেইনের ব্যক্তিগত বিমানে যাতায়াত করেছিলেন। তবে এই তথ্য নতুন নয় এবং এর সঙ্গে কোনো অপরাধের প্রমাণ যুক্ত নেই। ট্রাম্প নিজেও আগেই দাবি করেছিলেন, তিনি বহু বছর আগে এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

এই নথিতে একটি বিতর্কিত চিঠির কথাও উঠে এসেছে, যেখানে ট্রাম্পের নাম উল্লেখ ছিল। তবে এফবিআই এবং বিচার বিভাগ পরে জানিয়েছে, এই চিঠিটি জাল বা ভুয়ো হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল এবং এটি এপস্টেইনের লেখা নয়। ফলে এই চিঠিকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে না।

অন্যদিকে, প্রিন্স অ্যান্ড্রুর প্রসঙ্গেও কিছু পুরনো ইমেইল এবং যোগাযোগের তথ্য আবার সামনে এসেছে। এপস্টেইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গিসলেইন ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের বিষয়টি আগেই আলোচিত ছিল। নতুন নথিতে সেই সম্পর্ক নিয়ে নতুন কোনো অভিযোগ না উঠলেও, পুরনো বিতর্ক আবার জনসমক্ষে এসেছে।

গিসলেইন ম্যাক্সওয়েল ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এপস্টাইন সংক্রান্ত নথিতে ট্রাম্পের নাম থাকলেই কেন এত বিতর্ক? কেন এই সম্পর্ক এত বছর পরেও মার্কিন রাজনীতিতে এতটা সংবেদনশীল?

জেফরি এপস্টাইন ছিল নিউইয়র্ক ও ফ্লোরিডা-ভিত্তিক এক প্রভাবশালী অর্থলগ্নিকারী। ধনী ও ক্ষমতাবান মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলেছিল সে। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সেলিব্রিটি— সব মহলেই তার অবাধ যাতায়াত ছিল। ২০০৮ সালে প্রথমবার তার বিরুদ্ধে নাবালিকা নির্যাতনের অভিযোগ সামনে আসে। ফ্লোরিডায় এক কিশোরীর বাবা-মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয় তদন্ত। যদিও সেই সময় প্রসিকিউটরদের সঙ্গে একটি বিতর্কিত সমঝোতার মাধ্যমে বড়সড় শাস্তি থেকে রেহাই পায় এপস্টাইন।

এই সমঝোতাই পরবর্তীতে আমেরিকার বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বড় সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অভিযোগ ওঠে, ধন ও প্রভাবের জোরেই এপস্টাইন বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল। যদিও এরপরও তাকে যৌন অপরাধী হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।

এক দশকেরও বেশি সময় পরে, ২০১৯ সালে আবারও এপস্টাইনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এবার অভিযোগ ছিল, এপস্টাইন নাবালিকা মেয়েদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক যৌন পাচার নেটওয়ার্ক পরিচালনা করত। তদন্ত চলাকালীন এপস্টাইন নিউইয়র্কের এক কারাগারে মারা যায়। সরকারি ভাবে তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করা হলেও, সেই নিয়েও নানা প্রশ্ন ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আজও ঘুরপাক খায়।

এই দু'দফা তদন্তে বিপুল পরিমাণ নথি সংগ্রহ করে মার্কিন প্রশাসন। সাক্ষীদের জবানবন্দি, ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, তল্লাশি অভিযানে উদ্ধার হওয়া সামগ্রী— সব মিলিয়ে এই নথিগুলি আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম বিস্ফোরক দলিল হয়ে ওঠে।

এপস্টাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং প্রাক্তন সঙ্গী গিসলাইন ম্যাক্সওয়েলও এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ২০২১ সালে তাকে নাবালিকা পাচারের ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও বিচার চলাকালীন প্রকাশিত তথ্যও এপস্টাইন কাণ্ডকে আরও জটিল করে তোলে।

এই প্রেক্ষাপটেই ট্রাম্প-এপস্টাইন সম্পর্ক নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ছবি, ভিডিও ও সাক্ষাৎকারে দু’জনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছে। ১৯৯০-এর দশক ও ২০০০-এর শুরুর দিকে পাম বিচ ও নিউইয়র্কের অভিজাত মহলে তাঁদের সামাজিক যোগাযোগ ছিল বলেই একাধিক সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে।

আরও পড়ুন

কেন ট্রাম্পের সঙ্গে এপস্টাইনের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক? জেফ্রি এপস্টাইন কে?

ট্রাম্প নিজে অবশ্য বরাবরই বলে এসেছেন, তিনি এপস্টাইনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত ছিলেন না এবং ২০০৮ সালের আগেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। হোয়াইট হাউসও একাধিকবার জানিয়েছে, এপস্টাইনের অপরাধের সঙ্গে ট্রাম্পের কোনো যোগ নেই।

তবে বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর ১৭ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনে। সেখানে দাবি করা হয়, ২০০৩ সালে এপস্টাইনের জন্মদিন উপলক্ষে ট্রাম্প একটি অদ্ভুত শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যেখানে নগ্ন মহিলার একটি স্কেচ ছিল। এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, তা নতুন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্প-এপস্টাইন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা উস্কে দেয়।

অন্যদিকে, এপস্টাইন ফাইল প্রকাশের দাবিকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়েছিলেন টেক ধনকুবের ইলন মাস্কও। নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার সময় তিনি দাবি করেন, এই ফাইলগুলিতে ট্রাম্পের নাম রয়েছে এবং সেগুলি সম্পূর্ণ প্রকাশ করাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।

ফাইল প্রকাশ, ছবি সরানো এবং প্রশাসনিক ব্যাখ্যার এই দড়ি টানাটানি দেখিয়ে দেয়, এপস্টাইন অধ্যায় এখনও শেষ হয়নি। যতদিন না সমস্ত নথি পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে জনসমক্ষে আসে, ততদিন ট্রাম্প-এপস্টাইন সম্পর্ক ঘিরে বিতর্ক মার্কিন রাজনীতির ছায়ায় থেকেই যাবে।

More Articles