ডিসেম্বরে রাজ্য জুড়ে ব্যাপক ডামডোল? শুভেন্দুর 'তারিখ পে তারিখ' আসলে যে ইঙ্গিত দিচ্ছে

Suvendu Adhikari: তাহলে কি ১২ তারিখ লালন শেখের রহস্যমৃত্যুর কথা জানতেন বিরোধী দলনেতা! নাকি 'ডিসেম্বর জমজমাট' করতে আসলে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি!

কখন তোমার আসবে টেলিফোন! অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কিন্তু বাজে আর কই! রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বঙ্গ বিজেপির 'মুখ' শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য-হুঙ্কারের গড়িমসি নিয়ে এবার এমনই বলছেন কেউ কেউ। অনেকেই মশকরা করে বলছেন, আদালতের জমি-মামলার চেয়েও বোধহয় বেশি তারিখ দিচ্ছেন শুভেন্দু!

'তারিখ পে তারিখ'

ছিল ডিসেম্বর। হয়ে গেল জানুয়ারি। ফের নয়া তারিখ দিলেন শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)। এবার আর এক তারিখ নয়, হাতে রাখলেন কয়েকটি! মঙ্গলবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) গড়, কালীঘাটের কাছে একটি পথসভা করেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। ওই সভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, "১২ ডিসেম্বরটা ১৩ জানুয়ারি হবে, কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারি হবে না।" এর সঙ্গেই তাঁর সংযোগ, "আমি তিনটি তারিখ আপনাদের বলেছিলাম, ১২, ১৪ ও ২১ তারিখ। কেন বলেছিলাম? এই তিনটি তারিখ মানে সরকার পরিবর্তন হবে এ কথা বলিনি। ৭০ জন নিয়ে, আমাদের অন্যের বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার তৈরি করতে হবে, এটা আমাদের দল মানে না, আমরা চাইও না। চোরদের নিয়ে আমরা সরকার গড়ব না।" শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, "১৩ জানুয়ারির মধ্যেই ধরা পড়বে ধেড়ে ইঁদুর!" শুভেন্দুর এই মন্তব্যের পরেই শুরু হয় জল্পনা। তাহলে কি ১২ তারিখ লালন শেখের রহস্যমৃত্যুর কথা জানতেন বিরোধী দলনেতা! নাকি 'ডিসেম্বর জমজমাট' করতে আসলে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি!

'ডিসেম্বর ধামাকা'

একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের মানুষ, তৃণমূলের 'থার্ড ইন্ কমান্ড' শুভেন্দু বিজেপি-যোগের পর থেকেই 'ধামাকা' দেখাতে শুরু করেন। বারবার আক্রমণে সরব হন তিনি। রাজনৈতিক-নাট্যমঞ্চে পুরনো সহযোগী নন্দীগ্রামকে করেন হাতিয়ার। বিধানসভা নির্বাচনে হারিয়ে দেন স্বয়ং তৃণমূলনেত্রীকে। মমতার 'মেজবোনে'র মন জিতে নেন কাঁথির শান্তিকুঞ্জের অবিবাহিত বাসিন্দা।

সেই থেকে শুরু। তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়াতে আর ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্যের প্রাক্তন পরিবহনমন্ত্রীকে। শিশির-পুত্রের বাক্যবাণে বারবার বিদ্ধ হয়েছে তৃণমূল। বিশেষত, অধিকারী-বৃত্তের আক্রমণের শিকার হয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনীতি ছেড়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কয়লা থেকে গরু পাচারের দুর্নীতি- ছাড় পাননি অভিষেক। মন্তব্য-অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন 'যুবরাজে'র স্ত্রীও।

আর এই আবহের মধ্যেই পুজোর পর থেকে বারবার ডিসেম্বরের নাম উঠে আসে বিজেপি নেতাদের গলায়। শুভেন্দু থেকে সুকান্ত মজুমদার। ডিসেম্বর মাস নিয়ে রহস্য জিইয়ে রাখতে শুরু করেন বঙ্গের গেরুয়া-নেতারা। শুভেন্দু অধিকারী নভেম্বর মাস পড়তেই 'ডিসেম্বর তত্ত্বে' সরব হন বারবার। আসলে কী হবে এই মাসে! শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শুরু কয়লা, গরু। একাধিক অস্বস্তির মধ্যেই আবারও কি বড় কিছু! এই প্রশ্নেই উত্তাল হয় বঙ্গের রাজনীতি। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, একদা মমতার 'ডান হাত' পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি ছাড়িয়ে গারদবন্দি অনুব্রত মণ্ডল; একাধিক বিড়ম্বনার মধ্যেই কানাঘুষো শুরু হয়, এবার কি তাহলে মাথা! নেংটি ইঁদুর ছাড়িয়ে এবার কি তবে ধেড়ে ইঁদুরের কেউ?

শুভেন্দুর সূচনা এবং বিজেপির বাকি নেতাদের 'ডিসেম্বর-তত্ত্ব' এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশলে একাধিক প্রশ্ন উঠতে থাকে ফের। শুরু হয় একাধিক জল্পনা-বিতর্ক। হুমকি আর হুঁশিয়ারির দোলাচল। কী কী সম্ভাবনা উঠে আসে এই ডিসেম্বর তত্ত্বে?

আরও পড়ুন- দলে টানতে চেয়েছেন মমতা! শুভেন্দুর যে বিস্ফোরক দাবি ঘিরে হুলুস্থূল বঙ্গরাজনীতিতে

ভাঙছে সরকার?

একাধিক রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে বিধায়ক ভাঙানো অর্থাৎ ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ ওঠার মধ্যেই ফের বাংলা নিয়েও তৈরি হয় জল্পনা। তাহলে কি এই রাজ্যেও বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার ফেলতে চলেছে বিজেপি! এই প্রশ্নের মধ্যেই উঠে আসে মিঠুন চক্রবর্তীর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য। একাধিক তৃণমূল বিধায়ক তাঁর সঙ্গে সংযোগ রেখেছেন, দাবি করেন এই অভিনেতা। বিজেপি নেতার বক্তব্য ছিল, "সময় আসলেই বুঝতে পারবেন কাদের কথা বলছি!" জল্পনা বাড়ে। সরকার ভাঙার আবহ তৈরি হয় রাজ্যজুড়ে। তৃণমূল সরকারের বিদায় আসন্ন বলেই কি ডিসেম্বর তত্ত্ব সামনে আনলেন শুভেন্দু? প্রশ্ন ওঠে এমনও।

দুর্নীতির বিস্ফোরক অভিযোগ?

এমনিতেই একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ রাজ্য সরকার। শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। গ্রেফতার হয়েছেন স্বয়ং রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অস্বস্তি বেড়েছে মমতার। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি আরও বড় কোনও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে চলেছে? নয়া অভিযোগ নিয়েই কি সামনে আসবেন শুভেন্দু! ফের নয়া আশঙ্কা তৈরি হবে রাজ্য সরকারের জন্য?

দলত্যাগ-ধামাকা?

২০২০ সালের ডিসেম্বর। অকালে ঝড় উঠেছিল রাজ্যে। রাজনৈতিক মঞ্চ তপ্ত করে শীতের দুপুরে শঙ্কা বেড়েছিল তৃণমূলে। মমতার অনুগত সৈনিক যোগ দিয়েছিলেন বিজেপি দলে। মুকুল রায়-পর্বের পর এই ভাঙন ছিল তৃণমূলের জন্য আশঙ্কার। শুভেন্দু-যোগদানের মঞ্চেই স্লোগান উঠেছিল, 'তোলাবাজ ভাইপো হঠাও!' 'ভাইপো' হঠেননি, কিন্তু নিজের ঘরের লোকের বেঘর হয়ে যাওয়ার বিপদ হাড়ে হাড়ে টের পায় তৃণমূল। যার প্রভাব পড়ে নির্বাচনী প্রচারেও। এবার এই ডিসেম্বরেই ফের কোনও বড় নেতার বিজেপি যোগের সম্ভাবনা রয়েছে, এমন ইঙ্গিত ছিল আগেভাগেই। প্রশ্ন উঠেছিল, তাহলে কি এই 'ডিসেম্বর তত্ত্বে'র মধ্যেই লুকিয়ে দলবদলের কোনও ইঙ্গিত!

'বড় মাথা'র গ্রেফতারি?

শুভেন্দুর বিজেপি দলে পাকাপাকি যোগদানের পর থেকেই একের পর এক মন্তব্য-অস্ত্রে ব্যতিব্যস্ত হয়েছে তৃণমূল। বঙ্গের রাজনৈতিক উত্তাপ উত্তাল হয়েছে অভিষেক-শুভেন্দুর ব্যক্তিগত যুদ্ধে। বারবার বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন, 'জেলে যাবেন দুর্নীতির মাথা!' - এই ইঙ্গিত কাকে ঘিরে! অভিষেক না মমতা? এই প্রশ্নও উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলের অন্দরে। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আচমকা হাজির হয় এই 'ডিসেম্বর তত্ত্ব'।

মানিক ভট্টাচার্য থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, একাধিক 'রাঘববোয়ালে'র গ্রেফতারির মধ্যেই দুইয়ে-দুইয়ে চার হয় সবটা। জল্পনা-কল্পনা ওঠে তুঙ্গে। তাহলে কি এবার পালা আসল মাথার? গ্রেফতার হবেন নতুন কোনও বড় নেতা? রহস্য জিইয়ে রাখেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। "সময় সব উত্তর দেবে", এই মর্মেই ডিসেম্বর-উপলব্ধি নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যান শুভেন্দু। প্রশ্ন ওঠে, এরপর কে? রাজ্যে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হবেন নতুন কেউ?

আরও পড়ুন- কুকথাই অস্ত্র! পঞ্চায়েত ভোটের আগে শুভেন্দুকে এভাবেই বিপাকে ফেলবে তৃণমূলের হোয়াটস্যাপ?

কিন্তু কোথায় কী! যদিও ১২ ডিসেম্বর, রামপুরহাটের সিবিআইয়ের অস্থায়ী শিবিরে বগটুই-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত, লালন শেখের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের পরই 'ডিসেম্বর তত্ত্বে' খোঁচা দিয়েছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র কুণালের দাবি, এই ঘটনা বিজেপির বলা ডিসেম্বর-ধামাকার ফল হতে পারে!

তাহলে আর হল না! ডিসেম্বরে ধামাকা দেখতে পেলেন না জনতা। যদিও হাতে এখনও দু'সপ্তাহ, এই ভেবে অপেক্ষাও করছেন কেউ কেউ।

আর সেই অপেক্ষার মধ্যেই এবার রাজ্যবাসীর সামনে রাজনৈতিক যাত্রাপালার নয়া তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন শুভেন্দু নিজেই! বলে দিয়েছেন, ডিসেম্বর না হলে জানুয়ারি! কিন্তু ফেব্রুয়ারি নৈব নৈব চ!

অনেকেই বলছেন, এখানে তারিখ আসলে রূপক। 'পাঁচতলা মল পুরোটাই গল্প!' তাতিয়ে রাখার কৌশল। কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের নির্দেশে তদন্ত করছে সিবিআই। সেই তদন্তে অগ্রগতি হতেই উঠে আসছে একের পর তথ্য। যার ভিত্তিতে গ্রেফতারের সংখ্যাও বাড়তে পারে আগামী দিনে, যা স্বাভাবিক। আবার দলত্যাগী বিধায়ক, এই তত্ত্বের সত্যতাও রাজ্য-রাজনীতির আবহে এই মুহূর্তে নেই। থাকলেও থাকতে পারে দলবদল!

একাধিক জল্পনার মধ্যে ডিসেম্বর তত্ত্বে জায়গা পেতে পারে শুধুমাত্র দলবদল। সেই সমস্ত দিক বিচার করে আলটপকা গরম-গরম ইস্যু পরিবেশন করার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নয় এই ডিসেম্বর তত্ত্ব, এমন বলাও শুরু করেছেন অনেকে। দাবি, ডিসেম্বর তো দূরের কথা এই মন্তব্য-গরমে জানুয়ারিও কেটে যাবে, কিন্তু ধামাকা আদৌ হবে কি? নাকি রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে একাধিক ধারণার ওপর নির্ভর করে কিছু ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল রপ্ত হবে শুধু, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। যদিও সম্ভাবনা থাকছে বড় কিছুরও। কারণ এখনও শেষ হয়নি ডিসেম্বর মাস। আর এই সম্ভাবনার আশাতেই এবার শুভেন্দুর বলা জানুয়ারির দিকেও তাকিয়ে রাজনৈতিক কারবারিরা।

 

More Articles