২০০৩-২০২৪: যে ভাবে বারবার মুসলিম-ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে

PM Narendra Modi: সম্প্রতি ভোটের প্রচারে মোদি বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে নাকি দেশের সম্পদ ' ঘুসপেটিয়া'- দের বিলিয়ে দেবে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, মুসলমানদের চিহ্নিত করতেই এই শব্দবন্ধের ব্যবহার।

দেশ জুড়ে চলছে লোকসভা ভোট। আগামী ৪ জুন যার ফল প্রকাশ। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি যে এবার ' ৪০০ পার ' করবেই, তা একরকম নিশ্চিত তাঁরা। এতদিন ধরে সেই ঢাক পিটিয়ে গিয়েছেন খোদ মোদি-সহ বিজেপির শীর্ষ নেতানেত্রীরাই। কিন্তু, ওয়াকিবহাল মহল বলছে, আপাতত সেভাবে '৪০০ পার'-এর স্লোগান শোনা যাচ্ছে না বিজেপি নেতাদের মুখে। তবে ভিতরে ভিতরে ৪০০ আসন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি। আর তাতে বিজেপির অন্যতম হাতিয়ার ইসলামোফোবিয়া। যতদিন যাচ্ছে মুসলমানদের নিয়ে আতঙ্ক ও বিদ্বেষকে আরও তীব্র করে তুলছে বিজেপি। ' হিন্দুত্ববাদ ' প্রচার করতে যেন ভুলতেই পারছে না বিজেপি তথা মোদি সরকার। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে উত্তর ভারতের হিন্দি বলয় এবং দক্ষিণ কর্নাটকের সিংহভাগ আসনই জিতে ছিল পদ্মশিবির।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিজেপির আসন বাড়ার সম্ভবনা কম। শোনা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে জেতা ৩০৩ টি মধ্যেও বেশ কিছু আসনে টলমল করছে বিজেপি। ফলত, আরও ১০০ আসন বাড়ানো মোটেই মামুলি কথা নয়। রাজস্থান, কর্ণাটক, বিহার এবং মহারাষ্ট্রে আসন কমতে পারে বলেই জানাচ্ছে ওয়াকিবহাল মহল। এই পরিস্থিতিতে ব্যালট সামলাতে গিয়ে বিজেপি বারবার ণত্ব-ষত্ব হারাচ্ছে। সম্প্রতি ভোটের প্রচারে মোদি বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে নাকি দেশের সম্পদ ' ঘুসপেটিয়া'- দের বিলিয়ে দেবে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, মুসলমানদের চিহ্নিত করতেই এই শব্দবন্ধের ব্যবহার। কংগ্রেসকে বিঁধে তিনি এ-ও বলেন, মা-বোনদের ' মঙ্গলসূত্র ' নাকি ছিনিয়ে নেবে ওরা। মোদি সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে, কংগ্রেসের ইস্তেহারে নাকি 'মুসলিম লিগের' ভাবনা রয়েছে। যার প্রতিটি দাবি ভুয়ো এবং মুসলমান বিদ্বেষী বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।

আরও পড়ুন: কথায় কথায় মুসলিম বিদ্বেষ, মোদির বিরুদ্ধে কমিশনে চিঠি ৯৩ সিভিল সার্ভিস কর্তার

আজ থেকে নয়। সেই ২০০৩ সালের পর থেকেই মোদি যেভাবে বারবার ইসলামোফোবিক কথাবার্তা বলে এসেছেন, সেই বৃত্তই সম্পূর্ণ হল। বলা চলে, ২০০২ সাল থেকে মোদি মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের এক প্রকার ট্রেন্ড শুরু করেছিল। ২২ বছর পর এই কৌশল এতটাই নিচে নেমেছে যে প্রধানমন্ত্রী মোদি মুখ খুললেই এখন মুসলমান বিদ্বেষী কথা বলছেন।

  • ২০০২ সালে গুজরাটে ভোটপ্রচারে গিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
  • ২০০২ সালে,গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মুসলমানদের সন্তানসংখ্যা নিয়ে হাসতে হাসতে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, 'হাম পাঁচ, হামারে পঁচ্চিস।
  • ২০০২ সালের গুজরাত হিংসার পর মুসলমানরা যে ত্রানশিবিরে থাকতেন, তাকে ' সন্তান উৎপাদনের কারখানা ' বলে আখ্যা দিয়েছিল বিজেপি।
  • গুজরাত দাঙ্গায় মুসলমানদের মৃত্যু বিষয়ে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, 'কুকুরের বাচ্চা ' গাড়িতে চাপা পড়লেও তার কষ্ট হয়। এই তুলনা টেনে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা একজন শিশুও আন্দাজ করতে পারবে।
  • গোধরা পরবর্তী সময়ে সর্দারপুরা গ্রামে ৩৩ জন মুসলিমকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এই দাঙ্গায় গুজরাত যখন জ্বলছে, একই সময় মেহসানার বিজাপুর তহসিলের সর্দারপুরা গ্রামে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর হামলা চালায় আরএসএসের একটি শাখা-দল। ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। তার মধ্যে থেকে ১৪ জনকে বেকসুর খালাস করেছিল গুজরাট হাইকোর্ট।
  • ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মুসলমানদের ' বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ' বলে তকমা দেওয়া হয়।
  • ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা নির্বাচনে, হিন্দু মহল্লাগুলিতে প্রচারিত জনপ্রিয় একটি ছড়া ছিল - "তদাদ বঢ়ানে কে লিয়ে চাল চালাই / মুসলিম বানানে কে লিয়ে স্কিম বানাই/ ইক্কোঁ কো গলি গাঁও মেঁ লেকার ঘুমতে হেঁ/ পর্দে কো ডাল মুসলিম অউরাত বিঠাতে হেঁ।" ( জনসংখ্যা বাড়াতে, ভিন্ন ধর্মের লোকদের মুসলমান বানাতে ওরা স্কিম বানাচ্ছে। অলিগলিতে ওদের লোক ঘুরছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে মুসলমান বানাচ্ছে )।

  • ২০১৪ সালে ২০ সেপ্টেম্বর, মুজফফরনগর হিংসা কিংবা মেরঠ গণধর্ষণ মামলার সময়, উত্তরপ্রদেশ সরকার স্থানীয় হিন্দুদের বুঝিয়ে ছিল, দু'টিই নাকি আসলে 'লাভ জেহাদে'র ফল। ' জেহাদ ' ঠেকাতে সপ্তাহব্যাপী চলে রাখি বন্ধন উৎসব। আয়োজন করেছিল আরএসএসের একটি শাখা দল। ১০ লক্ষ রাখি বিলিয়ে 'বোনেদের রক্ষা' করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল বিজেপি।
  • ২০১৫ সালে বিহারের বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, বিরোধী দল জনজাতি - দলিতদের সংরক্ষণের সুযোগ - সুবিধেগুলি মুসলিমদের পাইয়ে দিতে চাইছে।
  • ২০১৭ সালে, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটের প্রচারে মোদি বলেছিলেন, গ্রামে 'কবরস্থান ' তৈরি হলে পাল্লা দিয়ে শ্মশানও তৈরি করতে হবে। কোন রকম সমস্যা ছাড়াই যদি রমজানের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়, তবে দীপাবলির সময়ও বিদুৎ যোগাতে হবে
  • ২০১৯ সালে, লোকসভা নির্বাচনের পর হাওয়া অন্যদিকে ঘোরে। সংখ্যালঘুদের সন্তুষ্ট করতে মোদি তখন বলেছিলেন, ' সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস' । কিন্তু এই মন্ত্র বেশি দিন টেকেনি। কিছুদিন পরই সিএএ - র বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদের 'পোশাক' দেখেই নাকি চেনা যাচ্ছে।
  • লালকেল্লায় মোদির স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ ভরা থাকে মুসলমান বিদ্বেষেই। নিজেদের সাফল্য , অন্যদের ব্যর্থতার প্রচার করতে গিয়ে - কাশ্মীর, তিন তালাক, পরিবারতন্ত্র, স্বজনপোষণ, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, ৩৭০ ধারা-সহ নানা বিষয় মোদি আক্রমণ করেন বিরোধীদের।
  • ২০২০ সালে, কারোনার আতঙ্কের মধ্যেই যখন লকডাউনে বিধ্বস্ত দেশ, তখন দেউড়িয়ার বিজেপি বিধায়ক একটি ভিডিও করে বলেন , ' মিয়াসদের (মুসলমান) থেকে সবজি কেনার কোনও দরকার নেই। '
  • ২০২০ সালে, উত্তরপ্রদেশের কাঠৌলির বিজেপি বিধায়ক বিক্রম সাইন দাবি করেছিলেন, মেহেন্দির আছিলায় ' লাভ জিহাদ ' করতে চান মুসলিম যুবকরা।
  • ২০২১ সালে, করোনা পরিস্থিতিতে গুজরাতে স্বেচ্ছায় দেহ সৎকারের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন বহু মুসলিম যুবক। তা নিয়েও আপত্তি তুলেছিল গুজরাত আরএসএস - এর ভডোদরা শাখা।
  • ২০২৪ সালে, লোকসভা ভোটের প্রচারে INDIA জোটকে কটাক্ষ করে বলেছেন," INDIA জোট বারবার জেনে বুঝে হিন্দু ধর্মকে অপমান করছে।" আরও বলেছেন, এই জোট কখনও নাকি অন্য ধর্মকে আক্রমণ করে না।

দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই সংখ্য়ালঘুরাই। সম্প্রতি 'The New York Times' - এ দাবি করা হয়েছে সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের বিষয় প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে যে ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন তাতে বিশ্বের দরবারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটা বিপরীত ভাবমূর্তি প্রকাশ পাচ্ছে। 'Time' সংবাদমাধ্যমকে, সিএআইআর ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ - এর ডিরেক্টর নিহাদ আওয়াদ বলেছেন - "হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যে ঘৃণামূলক বক্তব্যে রাখছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কিন্তু এটা মেনে নেওয়াও যায় না। যেই দেশের ধর্মে এত বৈচিত্র্য আছে, সেই দেশের প্রধানের থেকে এমন বক্তব্য খুবই দুঃখজনক বলে মনে করছে অনেকেই। লোকসভা নির্বাচনের জন্য দেশ জুড়ে চালু হয়ে গেছে নির্বাচনী আচরণবিধি। তার মধ্যেই মোদির এই মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ায় ইলেকশন কমিশনের কাছে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও তা নিয়ে এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি কমিশন।

আরও পড়ুন: মুসলিমদের অকথ্য অপমান মোদির! প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কেন ব্যবস্থা নেবে না?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ইতিহাসে কোনও প্রধানমন্ত্রী এর আগে প্রকাশ্যে এইভাবে মুসলমান বিদ্বেষী বক্তব্য রাখেননি। প্রশ্ন উঠছে, নিজের দেশের নাগরিককে কীভাবে এমন কথা বলতে পারেন একজন প্রধানমন্ত্রী? দেশের মানবধিকার গোষ্ঠীগুলি দাবি করেছে, মোদির শাসনকালে ভারতের মুসলমানরা নিজেদের দেশেই ' দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে' র মতো জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সমস্ত ধর্ম সমান প্রাধান্য পাবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত। প্রশ্ন এসেই যায়, মোদি কি তবে শুধুই হিন্দুদের রক্ষাকর্তা? অনেকেই মনে করছেন, যার দায়িত্ব দেশকে ঠিক পথে পরিচালিত করা, সেই দেশকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই মোদির 'হিন্দুত্ববাদী' প্রচার ছড়িয়ে পড়েছিল। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মোদি সরকার নিজের সুবিধাদার্থে, নিজের দেশকেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এর শেষ যে কোথায়, তা জানে না কেউ!

More Articles