সন্দেশখালিতে সরব! কেন যৌনহেনস্থায় অভিযুক্ত রেভান্নার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিজেপি?
Prajwal Revanna ‘sex video’ case: এদিকে, সেই সব অপরাধ লুকিয়ে এতদিন দিব্যি ভোট প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন প্রজ্জ্বল রেভান্না। তাঁর সমর্থনে কর্ণাটকে এসেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কিছুদিন আগেই গ্রামের মেয়ে-বউদের উপরে অত্যাচারের অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সন্দেশখালি। সেই মামলায় তৃণমূল নেতা শেখ শাহাজাহানের দিকে উঠেছিল অভিযোগের আঙুল। সেই ঘটনার বিরোধিতায় সরব হয়ে উঠেছিল বিজেপি। এমনকী নড়েচড়ে বসেছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। যৌনহেনস্থাকারী হোক বা ধর্ষক, তার শাস্তি হওয়াটাই উচিত এবং কাম্য। সন্দেশখালি মামলায় গ্রেফতার হয়েছে শেখ শাহাজাহান। কিন্তু মহিলা রেসলিং ফেডারেশন ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সভাপতি ব্রিজভূষণ থেকে শুরু করে প্রায় প্রায় আড়াই হাজার মহিলার যৌনহেনস্থায় অভিযুক্ত প্রজ্জ্বল রেভান্না, এরা কিন্তু সকলেই বাইরে। শুধু বাইরেই নয়, সসম্মানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মানুষের মধ্যে। কুস্তিগির ব্রিজভূষণ নিজে বিজেপির বাহুবলী নেতা, অন্যদিকে প্রজ্জ্বল রেভান্না কর্ণাটকের জেডিএস নেতা। যে জেডিএস কিনা কর্ণাটকে এবার জোট বেঁধেছিল বিজেপির সঙ্গে। যার ফলে কর্ণাটক থেকে সাংসদও হন এই প্রজ্জ্বল রেভান্না। তবে আরও একটি পরিচয় রয়েছে প্রজ্জ্বলের। তিনি দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার নাতি। চলতি লোকসভা ভোটে কর্ণাটকের হাসান থেকে প্রার্থীও হয়েছেন তিনি।
আর সেই ভোটের মধ্যেই গুরুতর অভিযোগ দেবেগৌড়ার নাতির বিরুদ্ধে। না, শুধু যৌন হেনস্থা নয়। বাড়ির পরিচারিকা থেকে শুরু করে পার্টি কর্মী, প্রায় কেউই বাদ যেতেন না প্রজ্জ্বলের কুদৃষ্টি থেকে। তাঁদের সকলকে যে শুধু যৌন হেনস্থা করতেন এই জেডিএস নেতা, তা-ই নয়। তাদের ভিডিও পর্যন্ত করতেন এই নেতা। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে প্রজ্জলের বেশ কিছু সেক্স ভিডিও। যদিও অভিযুক্তের দাবি, এ সমস্ত ভিডিওই নাকি ভুয়ো। একজন, দু'জন নয়, একাধিক মহিলার সঙ্গে এই জঘন্য অপরাধ চালিয়ে গিয়েছেন প্রজ্জ্বল। তার ভয়ে নাকি কুঁকড়ে থাকতেন সমস্ত পরিচারিকারা। স্ত্রী বাড়িতে না থাকলেই সেই সুযোগটা নিতেন তিনি। সম্প্রতি যে মহিলা প্রজ্জ্বল রেভান্নার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, তিনি মাস চারেক হল কাজে এসছেন জেডিএস নেতার বাড়িতে। মাস চারেক কাজ করার পরেই তাঁর ডাক পড়ে রেভান্নার ঘরে।
আরও পড়ুন: দেশছাড়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নাতি, কোন যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে এই সাংসদ?
এদিকে, সেই সব অপরাধ লুকিয়ে এতদিন দিব্যি ভোট প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন প্রজ্জ্বল রেভান্না। তাঁর সমর্থনে কর্ণাটকে এসেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও ২৬ এপ্রিল ভোট মিটতে না মিটতেই জার্মানিতে পগারপার হয়ে যান জেডিএস নেতা। ব্যাপারটি সামনে আসতেই তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT) গঠন করে কর্ণাটক সরকার। যৌন কেলেঙ্কারি কাণ্ডে প্রাথমিক ভাবে তাকে শোকজ নোটিস ধরায় জেডিএস। পরে তাঁকে সাসপেন্ডও করা হয় দল থেকে। ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে স্বতপ্রণেদিত হয়ে মামলা করেছে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা। এমনকী অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ চেয়ে কর্ণাটকের ডিজিপির কাছে আবেদনও জানিয়েছেন তিনি। চাওয়া হয়েছে ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্টও।
প্রশ্ন উঠেছে, যে সন্দেশখালি মামলা নিয়ে এত উদ্বেল হয়ে উঠেছিল বিজেপি, বারবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সরব হয়েছিল, কোথায় সেই কেন্দ্র সরকার। অবশ্য চাপে পড়তেই গোটা ঘটনার দায় কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকারের উপরেই ঠেলার চেষ্টা করেছে বিজেপি। রেভান্নার সেক্স ভিডিওর বিষয়টি সামনে আসতেই অমিত শাহ জানিয়েছে, "বিজেপির অবস্থান পরিষ্কার। আমরা দেশের মাতৃশক্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে।" কংগ্রেস সরকার কেন এ নিয়ে এখনও ব্যবস্থা করেনি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুললে অবশ্য গোটা বিষয়টাই রাজ্যসরকারের ঘাড়ে ঠেলেছেন শাহ। তাঁর বক্তব্য, 'আমাদের এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে না। কারণ এটা তো রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। রাজ্য সরকারকেই এটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে... আমরা তদন্তের পক্ষে এবং আমাদের জোটসঙ্গী জেডিএস-ও ঘোষণা করেছে যে দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।'
তবে এ কোনও ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। এর আগে বিজেপি সাংসদ এবং মহিলা রেসলিং ফেডারেশন ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সভাপতি ব্রিজভূষণের বেলাতেও বিজেপি হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছে। মণিপুরে নগ্নিকাদের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনাতেও চুপ থেকেছে বিজেপি। অথচ পড়শি অবিজেপি রাজ্যের ক্ষেত্রেই বিজেপির বিবেক জাগ্রত হয়েছে। তখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুবিচারের আশায়। তবে কি এ সবই বিজেপির ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে খেলা একেকটা চাল। যা নিজেদের দিকে আঙুল উঠলে বেমালুম ভুলে যায় বিজেপি? উঠেছে প্রশ্ন।
ইতিমধ্যেই প্রজ্জ্বল রেভান্নাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলে সরব হয়েছেন দলের বিধায়কেরা। প্রজ্জ্বলের কাকা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী বলেছেন, আমরা তদন্তের জন্য অপেক্ষা করব। যদি কেউ অন্যায় করে থাকে, তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে না। কর্নাটকের এক বিজেপি নেতা অভিযোগ করেছেন, তিনি নাকি দলের রাজ্য সভাপতিকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাঁর কাছে একটি পেন ড্রাইভে প্রায় ৩ হাজার মহিলার ভিডিও আসে। যার মধ্যে সরকারি চাকুরেও রয়েছেন। জনতা দল সেকুলারের সাংসদ প্রজ্জ্বল রেভান্না সেই সব ছবি দেখিয়ে মহিলাদের ব্ল্যাকমেল করে যৌন সম্পর্ক তৈরি করতেন বলেও অভিযোগ। এমনকী হাসানের সাংসদ রেভান্নার বাড়ির পুরুষ কাজের লোকরাও পরিচারিকাদের সাবধান করে দিতেন কাজের আগে।
শাহের দেখানো পথেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার যথেষ্ট চেষ্টা করে গিয়েছে বিজেপি। দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বাসবরাজ বোম্মাই বলেন, গোটা বিষয়টাই পূর্ব পরিকল্পিত। লোকসভা ভোটের মুখে দলকে কালিমালিপ্ত করতেই এই সব ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে বিজেপির এক ধাপ লাফিয়ে অভিযোগ, রাজ্যের মহিলারা কংগ্রেস জমানায় নিরাপদ বোধ করছেন না। বোম্মাই জানান, এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভিডিও ভুয়ো। একই ধরনের কয়েকটি ভিডিও ছড়ানো চলছে। যদিও অভিযোগকারিণী পরিচারিকা পুলিশকে বলেছেন, শুধু প্রজ্জ্বল একা নন, তাঁর বাবা দেবগৌড়া-পুত্র এইচডি রেভান্নাও বাড়ির মহিলা কর্মীদের যৌন সম্পর্ক গড়তে বাধ্য করতেন। ওই মহিলা পুলিশকে দেওয়া বয়ানে বলেছেন, তাঁর মেয়ের সঙ্গেও অসদাচারণ করেছেন তিনি। একাধিক মহিলা রেভান্না ও তাঁর বাবার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছেন তিনি। রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্যাতিতা মহিলা দাবি করেন, তাঁকে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বহুবার যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। তাঁর অভিযোগ, প্রজ্জ্বলের বাবা এইচডি রেভান্নার স্ত্রী যখনই বাড়িতে থাকতেন না, তখনই পরিচারিকাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাত জেডিএস বিধায়ক। কর্নাটকের মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন নাগলক্ষ্মী চৌধুরি এই ঘটনাকে রাজ্যের বৃহত্তম যৌন কেলেঙ্কারি বলে বর্ণনা করেছেন।
আরও পড়ুন: কুস্তি থেকে হঠাৎই সরে দাঁড়ালেন সাক্ষী মালিক! নেপথ্যে কি ব্রিজভূষণের কলকাঠি?
সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতা শেখ শাহাজাহান গ্রামের মেয়ে-বউদের সঙ্গে যে ব্যবহার করতেন, যে ভাবে নিয়মিত ভাবে তাঁদের উপর নির্যাতন চালানো হত, তা চমকে যাওয়ার মতোই। তার বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল গ্রামের মহিলারা। সেই প্রতিবাদকারিনীদের মধ্যে পরিচিত মুখকেই লোকসভা ভোটে বসিরহাট কেন্দ্রে পার্থী করেছে বিজেপি। বারবার বার্তা দিয়েছে, এই লড়াইয়ে মহিলাদের পাশে রয়েছে বিজেপি। অথচ বিজেপি ঘনিষ্ঠ প্রজ্জ্বল রেভান্নার ক্ষেত্রে কেন বিজেপি তেমন কোনও অবস্থান নিল না। মুখে শাহ যতই বলুক না কেন মাতৃশক্তির সঙ্গে থাকার কথা, ইতিহাসেও কি দল-ঘনিষ্ঠ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বিজেপি? যেমনটা দাঁড়াল না জার্মানিতে গিয়ে গা ঢাকা দেওয়া বিজেপি-শরিক রেভান্নার বেলায়? সত্য়িই কি দেশের নারীসুরক্ষা নিয়ে আদৌ চিন্তিত বিজেপি? একাধিক মহল থেকে উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন।