গান প্রতি ১৫ টাকা! গানের চাবুকে বলিউড শাসন করেছিলেন সামসেদ বেগম
Shamshad Begum: বাবা গোঁড়া মুসলমান। বললেন, সব ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ে গান গাইবে বোরখা পরে। মেয়ের কোনও ছবিও তোলা যাবে না। তাতেই রাজি সে।
ভোরবেলায় চা খেতে খেতে অল ইন্ডিয়া রেডিও, লাহোর চালিয়েছিলেন সুরকার গুলাম হায়দার। আচমকা একটা গলা কানে লাগল। চ্যানেলে ভক্তিগীতি চলছে। কিন্তু চিরাচরিত স্টাইল থেকে একদম আলাদা। একটু নাকে নাকে, কিন্তু এত ফ্রেশ, জীবন্ত গলা আগে শোনেননি তিনি। গান শেষ হবার পর গায়িকার নাম ঘোষণা হল। সঙ্গে সঙ্গে হায়দার যোগাযোগ করলেন রেডিও স্টেশনে। সদ্য আঠেরোতে পা দেওয়া মেয়েটি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি তার গলা সিনেমার জন্য বেছে নেবেন কেউ। হায়দার বলেন “গাও বেটি”। সে গাইল। আর সঙ্গে সঙ্গে ১২ গানের অ্যালবামের অফার দিলেন গুলাম। গান প্রতি পনেরো টাকা। ১৯৩৭ সালের হিসেবে অভাবনীয়। অ্যালবাম শেষে আরও পাঁচশো টাকার নজরানা। বাবা গোঁড়া মুসলমান। বললেন, সব ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ে গান গাইবে বোরখা পরে। মেয়ের কোনও ছবিও তোলা যাবে না। তাতেই রাজি সে। প্রথমে বেশ কিছু পঞ্জাবি ভাষার ছবি। আর তারপরেই ১৯৪১ সালে হিন্দি ছবি খাজাঞ্চি। হলিউডি নোয়া ছবির আদলে বানানো টানটান ডিটেকটিভ সিনেমা। পরিচালক মতি গিদওয়ানি। সুরকার গুলাম হায়দার। সিনেমা সুপারহিট। তার চেয়েও বড় হিট সিনেমার গান। সব ক'টা সামসেদের গাওয়া। 'সাওন কে নজারে হ্যায়' গান মুখে মুখে ফিরতে লাগল। বিশেষ করে তরুণ তরুণীদের মধ্যে। রাস্তাঘাটে শোনা গেল গানের ধরতাই “আহা! আহা!”। বুড়োরা নাক কোঁচকালেন। বোদ্ধারা হেসে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু হিন্দি সিনেমা জগতে নতুন তারকার জন্ম হল। সেই তারকার নাম সামসেদ বেগম।
ধ্রুপদী গানের শিক্ষার ঘরানা তাঁর ছিল না কোনওদিনই। তবু একের পর এক গেয়ে যেতে লাগলেন 'এক কলি নাযোঁ পে পলি” কিংবা 'শাওন কে নজারেঁ হ্যায়”-এর মতো হিট গান। তাঁর সেই নাকি গলার সামনে হার মানলেন সেকালের দুই লেজেন্ড। আমিরবাই কর্নাটকী, জোহরাবাই অম্বালাওয়ালি। তাঁদের গলা নিঃসন্দেহে সামসেদের চেয়ে সুন্দর, শ্রুতিমধুর, ধ্রুপদী গানে ঋদ্ধ। অবাক বিস্ময়ে দু'জনে দেখলেন লাহোরের সেই 'জিন্দাদিল ছোঁড়ি' কীভাবে ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে শক্ত করছে নিজের পায়ের তলার মাটি। চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে একা রাজত্ব করেছেন সামসেদ।
আরও পড়ুন- চারশো টাকা না পেলে হাসপাতাল থেকে ফিরত না স্ত্রী! যেভাবে আমজাদ খান হলেন গব্বর সিং
এর মধ্যেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। জোহরা নিজের জীবনের সেরা গান 'আখিয়াঁ মিলাকে জিয়া ভরমাকে” গাইবার পরেও কোনও কারণ না দেখিয়ে নৌশাদ তাঁকে পাকাপাকিভাবে ত্যাগ করলেন, সামসেদ দেখলেন তাঁর সামনে আর কেউ নেই। প্রায় পাঁচ বছর একা হাতে হিন্দি ছবির গানকে দিশা দেখিয়েছেন তিনি। আর কী অদ্ভুত সে সব গান! 'বাদল আয়া ঝুম কে', 'হাম দর্দ কা আফসানা', 'ধরতি কো আকাশ পুকারে', 'চান্দনি আয়ি বাকেঁ পেয়ার'। রেডিও সিলোনে প্রতি পাঁচটা গানের একটা অবশ্যই সামসেদের গাওয়া। তাঁর সঙ্গে কোরাস করতেন কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলের মতো নতুন গায়ক গায়িকারা। একেবারে মায়ের মতো ভালবাসায় আগলে রাখতেন নতুন প্রজন্মকে। যখন নামী সুরকার ছাড়া অপেক্ষাকৃত মধ্যমানের শিল্পীরাও কাজ করতে চাইতেন না, একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিলেন সামসেদ।
ত্রিপুরা থেকে আসা একেবারে নবীন এক সুরকার, নাম শচীন দেববর্মণ, এসে তাঁর হাতে পায়ে ধরল। সে কিছু গানে সুর দিয়েছে। কিন্তু সে সব গান প্রযোজক তখনই নেবেন, যদি সেই গান সামসেদের গলায় হয়। আসলে প্রযোজক ভেবেছিলেন সামসেদ ভাগিয়ে দেবেন তাঁকে। কিন্তু তিনি এক কথায় রাজি। গাইলেন 'কুছ রঙ বদল রহি হ্যায়'। কে জানত কয়েক বছর পরে এই তরুণের সুরে তাঁর গাওয়া 'সইয়াঁ দিল মে আনা রে” ছমছমিয়ে, বৈজয়ন্তীমালার লাস্য নিয়ে সামসেদের সিগনেচার সং হয়ে উঠবে!
আরও পড়ুন- বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা
সারা জীবন মাথা উঁচু করে থেকেছেন। আপস করেননি অন্যায়ের সঙ্গে। ও পি নাইয়ারের সঙ্গে লতার সেই কুখ্যাত মতবিরোধের পর ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেছিলেন সুরকার। পাশে কেউ নেই। কেউ কাজ দিতে চাইছেন না। বড় শিল্পীরা গাইতে চাইছেন না তাঁর সুরে করা গান। আশা ভোঁসলে নিজে অনুরোধ করলেন সামসেদকে। যদি দয়া করে… এক কথায় রাজি সামসেদ। তাঁর উপরে ব্ল্যাকলিস্টের খাঁড়া নামতে পারে জেনেও সামসেদ গাইলেন। আর কী সব গান গাইলেন! 'কভি আর কভি পার', 'আব তো জি হোনে লাগা কিসি কি সুরত', 'বুঝ মেরা ক্যায়া নাম রে', 'কহিঁ পে নিগাহেঁ কহি পে নিশানা', 'লে কে পহলা পহলা প্যায়ার', আশার সঙ্গে 'রেশমি সালোয়ার কুর্তা জালি কা'- একাহাতে নাইয়ারের নাও পার করালেন সামসেদ বেগম।
তবে বুঝতে পারছিলেন তাঁর সময় ঢলছে। উল্কার বেগে লতা মঙ্গেশকর নামে যে তারকার উত্থান ঘটছে, তাঁর উচ্চাকাঙ্খার সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে সবাই। 'তকদির বনি বনকর বিগড়ি', নৌশাদের সঙ্গে গাওয়া তাঁর শেষ গান। এই সুপারহিট গান যেন সামসেদের বাকি জীবনের কথা বলে চলে। লতায় মুগ্ধ নৌশাদ রাতারাতি সেকেন্ড লিড প্লেব্যাককে লিড সিঙ্গার বানিয়ে দিলেন। ঠিক পরের বছর আবার দুর্ভাগ্যের বাতাস বয়ে এল সামসেদের জীবনে। রাজ কাপুরের ছবির লিড সিঙ্গার তিনিই। কিছুদিন আগেই সবাইকে বুঁদ করেছেন আগ ছবির গান গেয়ে, 'কাহেঁ কোয়েল শোর মচায়ে রে'। সুরকার রাম গাঙ্গুলির সঙ্গে ঝামেলা বাঁধল রাজ কাপুরের। পরের ছবি বরসাত-এর দায়িত্ব পেলেন শঙ্কর- জয়কিষণ। আবার লতা ইন। সামসেদ আউট।
তখনও বাকি ছিল আর এক গানের রেকর্ডিং, 'বদল গয়ে মেরি দুনিয়া বদল গয়ে'। কী অদ্ভুত সমাপতন! সে গান হিট করল না। সবার মুখে মুখে তখন বরসাতের লতার গান। প্রায় দশ বছর বাদে মুঘল-এ-আজমে শেষবারের মতো একসঙ্গে গাইলেন দুই কিন্নরকন্ঠী, 'তেরে মেহফিল মে কিসমত আজমাকর হাম ভি দেখেঙ্গে', সামসেদ সেখানে ঢাকা পড়ে গেছেন লতার ছায়ায়। সেই লতা যিনি এককালে কোরাস গাইতেন তাঁর সঙ্গে। সামসেদ ভাবতেও পারেন নি, শেষ অবধি তাঁর গলা পর্দায় ফুটিয়ে তুলবেন নিগর সুলতানা। সেকেন্ড লিড। মধুবালার গলায় লতা। আর লড়াই চালিয়ে যাবার ক্ষমতা ছিল না সামসেদের।
ষাটের দশক থেকে সামসেদের কাজ কমতে লাগল। যেমনটা এককালে হয়েছিল জোহরা বা আমিরবাইদের। সবাইকে যেতে হয় একদিন। নাইয়ার একেবারে ঝুঁকে পড়লেন আশার দিকে, আর শচীন কত্তা বেছে নিলেন গীতা দত্তকে। সামসেদ শেষবার পর্দায় আগুন জ্বালালেন ১৯৬৮ সালে কিসমত ছবিতে। “কাজরা মোহাব্বতওয়ালা”। নায়ক বিশ্বজিতের কণ্ঠে। ওটাই সামসেদের সোয়ান সং আর তারপরেই তিনি ডুবে গেলেন বিস্মৃতির অতলে।