বাবা ধর্ষক, মা ধর্ষণে সাহায্যকারী! ভারতে কত পরিবারে ঘটছে এমন, আঁতকে উঠতে হবে যে তথ্যে
Child Abuse in India: ভারতে কয়েক হাজার শিশু প্রতিবছর ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন করছেন শিশুটির খুব পরিচিত মানুষরাই।
ঘটনা ১
কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরুর ঘটনা। মায়ের প্রশ্রয়ে দিনের পর দিন যৌন লালসার শিকার হয়েছে নাবালিকা কন্যা। ২০১৬ সালে টানা এক বছর ধরে এক নাবালিকাকে যৌন হেনস্থা করে ৪৯ বছরের এক ব্যক্তি। সম্প্রতি আদালত পকসো আইনে মূল অপরাধী এবং মাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু এই ঘটনা রেখে যায় অনেক প্রশ্ন। যার উত্তর খুঁজতে লজ্জায় মাথা নত করে সুস্থ বিবেক বোধ।
ঘটনা ২
খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। এই বছরের নভেম্বর। কেরলের ঘটনা। বিশেষভাবে সক্ষম নাবালিকাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে বাবা। ১০৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। একই সঙ্গে চার হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। পকসো কোর্ট ৪৫ বছর ব্যক্তি বিরুদ্ধে এই সাজা ঘোষণা করেছে। দোষী সাব্যস্ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজের ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে দিনের পর দিন ধর্ষণ। ২০২০ সালে এই ঘটনা সামনে আসে।
অল্প সময়ের ব্যবধানে এই দুই ঘটনা সামনে এসেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, সন্তানকে সুন্দর ভবিষ্যত দেওয়া তো দূর অস্ত, সে যদি তার বাবা-মার কাছেই সুরক্ষিত না হয়, তাহলে যাবে কোথায়? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অরুণিমা ঘোষ বলছেন, "এমন দুই ঘটনার কথা এল, যা মা-বাবার তরফে হয়েছে। এমন ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন নয়। পরিচিত লোকের দ্বারা বাড়ির ভেতর চেনা লোকজনই এমন করছে। কখনও ভিকটিমকে ভয় দেখিয়ে, কখনও লোভ দেখিয়ে যেমন, কাউকে বোলো না তোমাকে চকলেট দেব- এভাবে তাকে যৌন হেনস্থা করা হচ্ছে। এই দুই ঘটনা হয়তো এক্সট্রিম। দেখতে হবে যে, পার্সোনালিটি প্রবলেম আছে কিনা। তবে পরিবারের ভেতর এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বাবা-মা অনেক সময় বাচ্চার কথা বিশ্বাস করতে চান না। যেমন, ভিকটিম যদি জেঠু-কাকুর সম্পর্কে বলে, বাবা-মা বলেন, এটা হতে পারে না। এতে সে দমে যায়। ঘটনা এক্ষেত্রে সামনে আসে না। বিচার তো অনেক পরে।"
আরও পড়ুন- পৃথিবীজুড়ে হু হু করে বাড়ছে শিশু নির্যাতন! যে বাস্তব জানলে শিউরে উঠতেই হবে
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কথার সপক্ষে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে। শিশুদের যৌন নিপীড়নের লজ্জাজনক রেকর্ড রয়েছে ভারতে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ নিপীড়নের ঘটনাগুলো ঘটে শিশুকন্যার পরিচিত লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা কোনও নিকটজনের মাধ্যমে। সর্বশেষ যে বছরের তথ্য পাওয়া যায়, সেই ২০১৭ সালে ভারতে ১০,২২১টি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউমান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতে কয়েক হাজার শিশু প্রতিবছর ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন করছেন শিশুটির খুব পরিচিত মানুষরাই। যৌন নিপীড়নের পরে পুলিশের কাছে কিংবা বিচারব্যবস্থার সামনে অভিযোগ জানাতে গিয়ে তৃতীয়বারের মতো মানসিকভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে ওই শিশুদের। হিউমান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা প্রাদেশিক সরকারগুলি শিশুদের ওপরে যৌন নিপীড়ন রুখতে খুব সচেষ্ট নয়।
হিউমান রাইটস ওয়াচ এও বলেছে, প্রথমত তো শিশুরা যৌন নিগ্রহের ব্যাপারটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। যদি বা বাবা-মাকে তারা ঘটনাটা বলতেও পারে, বাচ্চাদের কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। কারণ অনেক ক্ষেত্রে খুব চেনা লোকজনরাই অত্যাচার করছেন। আর মায়েরা যখন ওই চেনা মানুষজনকে চেপে ধরছেন, তখন মায়েদের উপরেও অত্যাচার চলছে– এরকম ঘটনাও সামনে এসেছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারির সেই ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল বিশ্ব। এক ঝটকায় নাড়িয়ে দিয়েছিল দেশের সুস্থ বিবেক বোধ। জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া জেলার রাসানা গ্রামে আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন এক মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক ও দুই স্পেশাল পুলিশ কর্মকর্তা। তারা শিশু আসিফাকে এক সপ্তাহ ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। পরে তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার আগে আবারও ধর্ষণ করা হয়। পরের বছর কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বহুল আলোচিত আট বছরের শিশু আসিফা বানু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আট আসামির মধ্যে ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত। ‘তথ্যপ্রমাণ’ না থাকায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এক কিশোর আসামিকে। অপরজনের ‘বয়স নিয়ে বিতর্ক’ থাকায় বিচার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
আরও পড়ুন- হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
এখন দেশে জোরালো আইন আছে। পকসো আছে। ২০১২ সালের আগে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের জন্য কোনেও বিশেষ আইন ছিল না৷ শুধু তাই নয়, যৌন নির্যাতনের বেশ কিছু ধরন, যা শিশু নির্যাতনের সমান, তার কোনও অন্তর্ভুক্তি তৎকালীন আইনে না থাকায় এ বিষয়ে পুলিশের তৎপরতাও ছিল কম৷ আইন হওয়ার পর যে তৎপরতা বেড়েছে একথা কি জোর গলায় বলা যায়? সোশ্যাল ট্যাবু, সামাজিক অশিক্ষা, পরিবারেই শিশু নিরাপত্তাহীন হওয়ায় শৈশব ছেয়ে আছে অন্ধকারে।
শিশুদের উপরে যৌন নিগ্রহ রোখার জন্য খুব কড়া আইন থাকলেও বেশিরভাগ রাজ্যই সেইসব আইন প্রয়োগ করছে না বলে অভিযোগ। অভিযুক্তরা খালাস পাচ্ছে, বিচার ঝুলে থাকছে, আর কাশ্মীরের আসিফা, ম্যাঙ্গালুরু, কেরলের নাবালিকার মতো কত কত শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে সমাজের ব্যাধির আঁস্তাকুড়ে। যে ব্যাধি সমাজ লালন করছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎস অরুণিমা ঘোষের কথায়, "পকসো আইন করে এইসব ঘটনা বন্ধ করা যায় না। জনমানসে সচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে। আগে ঘটনাগুলো রিপোর্টেড হতে হবে। তারপর তদন্ত এবং বিচার। তখন প্রমাণ হবে আইনের হাত কতটা লম্বা।"