ভালোবাসার পরিণতি ৩৫ টুকরো, লিভ ইন সম্পর্কে যেভাবে খুন হলেন শ্রদ্ধা ওয়ালকর!
Delhi Murder Case: পুলিশের দাবি, আফতাবকে বারবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল শ্রদ্ধা। কিন্তু আফতাব ছিল লিভ ইনের পক্ষে। প্রথম প্রথম সমস্যা না হলেও, এই কারণে ক্রমে দু’জনের মধ্যে বচসা হতে শুরু করে।
“মানুষ বড় সস্তা, কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত”
চার বছরের ভালোবাসা যখন ৩৫ টুকরোতে এসে শেষ হয় তখন এর থেকে মানানসই শীর্ষক আর কীই বা হতে পারে। আমেরিকায় এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন ডেক্সটার মর্গ্যান। সকালবেলা তিনি তুখোড় ফরেনসিক এক্সপার্ট, রাতের বেলায় সিরিয়াল কিলার। একের পর এক খুন করে সেই দেহগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে লোপাট করে দিতেন ডেক্সটার। এবার স্রেফ স্থান-কাল-পাত্র পাল্টে দিন। আমেরিকা হয়ে যাক দক্ষিণ দিল্লি, ‘কাল’ হয়ে যাক ১৮ মে ২০২২, ‘পাত্র’ হয়ে যাক আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। ডেক্সটার কাল্পনিক চরিত্র হলেও এই আফতাব আমিন পুনাওয়ালা হল বাস্তবের ডেক্সটার।
১৪ নভেম্বর ২০২২, গোটা দিল্লি শহর ঘুম থেকে উঠে জানতে পারে শিহরণ ধরানো এক খুনের কাহিনি। সকাল হতেই সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ হয়ে ফুটে ওঠে, আফতাব আমিন পুনাওয়ালা, এক বছর ২৮-এর যুবক তার লিভ ইন পার্টনার শ্রদ্ধা ওয়ালকারকে (২৭) খুন করেছে। খুনের বীভৎসতা এমন যা ভেতর থেকে নড়িয়ে দেবে আপনাকে। মুম্বইয়ের এক বহুজাতিক সংস্থার কল সেন্টারে কাজ করত আফতাব এবং শ্রদ্ধা। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব, প্রেম, লিভ ইন, অতঃপর খুন। শ্রদ্ধা এবং আফতাবের এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি শ্রদ্ধার পরিবার। তাই পরিবারের চাপ এড়াতে এই যুগল মুম্বই ছেড়ে চলে আসেন দিল্লি। সেখানে একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন তাঁরা। পুলিশের কাছে আফতাব জানিয়েছে যে, সে নিজের ‘প্রেমিকা’ শ্রদ্ধাকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে খুন করে এবং তারপর ঠান্ডা মাথায় ওই দেহের ৩৫ টুকরো করে সে। টুকরোগুলির পচন এড়ানোর জন্য নতুন একটি ফ্রিজও কিনে ফেলে আফতাব! সেখানে শ্রদ্ধার দেহাংশগুলিকে ঢুকিয়ে রাখা হয়। প্রতিদিন রাত ২ টোর সময় ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেত আফতাব। সময় সুযোগ বুঝে ১৮ দিন ধরে টুকরোগুলিকে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয় সে।
আরও পড়ুন- এই ভারতীয়র নামে রয়েছে খুনের বিশ্বরেকর্ড, যার কারণে আজও ভুক্তভুগী ৬ কোটি মানুষ
পুলিশি জেরায় আফতাব জানিয়েছে, গত ১৮ মে শ্রদ্ধাকে খুন করে সে। গত সেপ্টেম্বর মাসে শ্রদ্ধার এক বন্ধুর শ্রদ্ধার বাড়িতে জানায়, বিগত সাড়ে তিন মাস ধরে তাঁর বন্ধু কার্যত নিখোঁজ। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও অ্যাক্টিভিটি নেই, মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্দেহ হয় পরিবারের। শ্রদ্ধার বাবা মদন ওয়ালকার অভিযোগ জানান মুম্বই পুলিশে। মুম্বই পুলিশ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় দিল্লি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এরপর দিল্লির মেহরৌলি থানায় শ্রদ্ধার নিখোঁজ হওয়ার এফআইআর দায়ের করেন শ্রদ্ধার বাবা। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তদন্তের ভিত্তিতে গত শনিবার রাতে আফতাবকে নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ। প্রথমে কিছু স্বীকার করতে না চাইলেও, জেরার মুখে পরে বাধ্য হয়ে সব স্বীকার করে সে।
আফতাবের বয়ান শুনে প্রথমে চমকে যায় পুলিশও। আফতাবের কথা মতো মেহেরৌলির জঙ্গলে শ্রদ্ধার দেহাংশ খোঁজা শুরু করেন তাঁরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলতে শুরু করে দেহের বিভিন্ন টুকরো। পুলিশ সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত কুড়িটি টুকরো উদ্ধার করা গিয়েছে। বাকিগুলির খোঁজ এখনও চলছে। নিজের প্রেমিকা তথা লিভ ইন সঙ্গীকে খুনের পর ঠান্ডা মাথায় প্রমাণ লোপাট করার জন্য এমনটাই প্ল্যান করে আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। পুলিশের দাবি, এই সবটাই আফতাব করেছে অপরাধকেন্দ্রিক ছবি আর সিরিজ দেখে। জেরায় সে জানিয়েছে, জনপ্রিয় আমেরিকান ক্রাইম সিরিজ ‘ডেক্সটার’ দেখে সে খুনের প্রমাণ লোপাটের ছক কষেছিল।
একই কোম্পানিতে চাকরি করলেও ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমেই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হয় আফতাবের। ২০১৮ সালে সম্পর্কে জড়ান তাঁরা। পুলিশ জানিয়েছে, আফতাব আদতে মুম্বইয়ের বাসিন্দা। আর শ্রদ্ধাও মুম্বইয়ের মেয়ে। দু’জনের প্রেম কাহিনি শুরু হয় স্বপ্নের মতো। আগেই বলেছি, এই সম্পর্কে মত ছিল না শ্রদ্ধার পরিবারের। তিন বছর আগে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন আফতাব এবং শ্রদ্ধা। এরপরেই, প্রেমের টানে পরিবার, চাকরি, শহর ছেড়ে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন শ্রদ্ধা ওয়ালকর। স্বপ্ন ছিল সুখে শান্তিতে দিন কাটাবেন দু’জনে। পুলিশের দাবি, আফতাবকে বারবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল শ্রদ্ধা। কিন্তু আফতাব ছিল লিভ ইনের পক্ষে। প্রথম প্রথম সমস্যা না হলেও, এই কারণে ক্রমে দু’জনের মধ্যে বচসা হতে শুরু করে।
গত ১৮ মে এই বচসা পৌঁছয় চরমে। প্রবল আক্রোশে শ্রদ্ধাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় আফতাব। দক্ষিণ দিল্লির অতিরিক্ত ডিসিপি অঙ্কিত চৌহানের কথায়, “১৮ মে দু’জনের ঝামেলা চরমে ওঠে। রাগের বশে শ্রদ্ধার গলা টিপে খুন করে আফতাব। এর পর মেয়েটির দেহ টুকরো টুকরো করে মেহেরৌলির জঙ্গল এলাকায় ফেলে আসে।”
আরও পড়ুন- সূচ ফুটিয়ে খুন, অধরা ভাড়াটে খুনি! কলকাতার সেই হত্যাকাণ্ড সাড়া ফেলেছিল পৃথিবীজুড়ে
শ্রদ্ধার দেহের ৩৫টি টুকরো করে আফতাব। এর পর একটি ফ্রিজ কিনে আনে সে। সেখানেই ভরে রাখে দেহের টুকরো। পরের ১৮ দিন ধরে রাতের অন্ধকারে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আফতাব দেহের টুকরো ফেলে আসতেন বলে অভিযোগ। এমনকী ঘুরে ঘুরে দেহের টুকরোগুলি ফেলার জন্য আফতাব একটি গাড়িও কিনেছিলেন! পুলিশি সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, আফতাব জানিয়েছে যেই ঘরে সে শ্রদ্ধাকে খুন করেছিল প্রতিদিন সেখানেই ঘুমোতো সে। খুন করে টুকরো করার পর প্রতিদিন রাতে ফ্রিজে রাখা শ্রদ্ধার কাটা মাথা দেখত সে।
শ্রদ্ধার বন্ধু লক্ষণ নাদার পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই ঘটনার কয়েক মাস আগেও শ্রদ্ধাকে খুনের হুমকি দিয়েছিল আফতাব। সেবার শ্রদ্ধা হোয়াটসঅ্যাপে লিখে অনুরোধ করে তাঁকে বাঁচানোর। সেই রাতে বন্ধুরা এসে উদ্ধার করলেও পরের বার আর পারেননি। লক্ষণ জানান, শ্রদ্ধার মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে তিনি যান তাঁদের ছাতারপুরের ফ্ল্যাটে। সেবার আফতাবকে তাঁরা কার্যত ওয়ার্নিং দিয়ে এসেছিলেন দ্বিতীয়বার এরকম হলে সোজা পুলিশের দ্বারস্থ হবেন তারা। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলেন কই! তার আগেই আফতাব আমিন পুনাওয়ালার হাতে নৃশংসভাবে খুন হতে হল শ্রদ্ধাকে। এই ঘটনা সামনে আসার পরেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন আফতাবের মানসিক সুস্থতা নিয়ে। জানা যাচ্ছে, আপাতত আফতাবকে পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।