ভারতের ইউটিউব রাজধানী এই গ্রাম! অবাক করবে ইউটিউবারদের উত্থান কাহিনি

India's YouTube capital: মহামারীর পরে অনেক বেশি মহিলা সফলভাবে সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেল চালাচ্ছেন এবং এটি নতুন এক অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করছে।

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, অপরেশ লাহিড়ী গেয়েছিলেন, "যেখানে যাও লাইন লাগাও"। এই সময়ে গাওয়া হলে নির্ঘাত লিখতে হতো, যেখানে যাও রিলস বানাও! চলতি বাসে, লোকাল ট্রেনে, চারমিনারের সামনে, তাজমহলের পেছনে, নোংরা খালপাড়ের পাশে সর্বত্র রিল তৈরির ধুম! সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে কনটেন্ট ক্রিয়েশন একটি বিকল্প পেশা হয়ে উঠেছে। একটুও অত্যুক্তি হবে না বললে যে, সোশ্যাল মিডিয়া দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে। কনটেন্টের নামে কী ছড়ানো হচ্ছে, এই বিতর্ক অবশ্যই আলোচ্য তবে এই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবকে স্বীকার করতেই হবে। মধ্য ভারতের একটি অখ্যাত গ্রামে তুলসীকে এই বিপ্লবের অন্যতম আঁতুরঘর বলা যায়।

মধ্য ভারতের রায়পুরের একটি গ্রাম তুলসী। বছর ৩২-এর ইউটিউবার জয় ভার্মা। ইউটিউবে নানা ভিডিও তৈরি করেন, তাঁর 'ফলোয়ার'-দের কাছে পৌঁছে দেন। আর তাঁর ভিডিওতে দেখা যায় গ্রামেরই অজস্র মুখ। যেমন ভিডিও করতে গিয়ে গ্রামেরই একদল মহিলাকে হয়তো তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে বলেন জয়৷ শাড়ি সামলে, খিলখিলিয়ে হেসে এই মহিলারা তাঁর ভিডিওতে সামান্য কিছু ভূমিকা পালন করেন। জয় ভার্মা একজন বয়স্ক মহিলাকে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসান, অন্য একজন মহিলকে বয়স্কার পা ছুঁতে বলেন এবং আরেকজন মহিলাকে ওই বৃদ্ধাকে জল দিতে বলেন। গ্রামের উৎসবের একটি খুব চেনা দৃশ্য জয় তৈরি করলেন, যা দেখবেন হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ভিন শহরের বসিন্দারা। গ্রামের জীবন, গ্রামের উৎসব কেমন হয় তারা জানবেন। এই ধরনের কাজ এই মহিলাদের কাছেও অজানা কিছুই না। ফলে গ্রামের মহিলারাও খুশি হয়েই ভিডিওর জন্য কাজটি করে দেন। আরও কয়েক পা এগোলেই দেখা যাবে আরেকদল যুবক ভিডিও তৈরিতে ব্যস্ত। একজন একটি মোবাইল ফোন ধরে আছেন, আর সামনে হিপ-হপ করছেন বছরে ছাব্বিশের রাজেশ দিওয়ার।

তুলসী আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয় গ্রামের মতোই। একতলা বাড়ির গ্রাম, রাস্তা কিছুটা পাকা, কিছুটা পোক্ত নয়। বিশাল জলের ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামের মাঝে৷ বটগাছের গুঁড়ি কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো, বেদির মতো। আড্ডা মারার, গ্রামীণ জমায়েতের জায়গা যেমন হয় আর কী। তবে সাধারণ হয়েও তুলসী 'অনন্য'। কারণ সে এখন ভারতের 'ইউটিউব ভিলেজ'। প্রায় ৪ হাজার লোকের বাস তুলসীতে। এই হাজার চারেকের মধ্যে ১,০০০-এরও বেশি মানুষ ইউটিউবকেই পেশা হিসেবে বেছেছেন। গ্রামের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাঁরা 'কনটেন্ট' খোঁজেন নিজের জীবন থেকেই। আর উপার্জন করেন নিজের গ্রামকে, উৎসবকে, যাপনকে, নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।

ইউটিউব থেকে অর্থ উপার্জন করে স্থানীয় অর্থনীতি যে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে তা স্বীকার করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। শুধু উপার্জন নয় সোশ্যাল মিডিয়া সমতা এবং সামাজিক পরিবর্তনেরও হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন তাঁরা। যে মহিলাদের কাছে জীবনে উন্নতির কোনও পথই ছিল না, ইউটিউব তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছে বিকল্প এক যাপন। তুলসী গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে যারা ইউটিউব চ্যানেল চালু করে সফল হয়েছেন এবং আয়ের নতুন পথ আবিষ্কার করেছেন তাঁদের মধ্যে এমন অনেক মহিলা রয়েছেন যাঁদের এই গ্রামীণ পরিবেশে নতুন স্বপ্ন দেখার তেমন সুযোগই ছিল না।

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউটিউব ২০ বছরে পা দিল৷ আনুমানিক ২.৫ বিলিয়ন মানুষ প্রতি মাসে এই সামাজিক মাধ্যমটি ব্যবহার করেন এবং ভারত এখনও পর্যন্ত ইউটিউবের বৃহত্তম বাজারগুলির মধ্যে একটি। কয়েক দশক ধরে, ইউটিউব ওয়েব সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষের সামাজিক সংস্কৃতিও বদলে দিচ্ছে। তুলসী গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, ইউটিউবে ডুবে থেকে অন্তত বাচ্চারা অন্য কোনও খারাপ অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ছে না। অপরাধ থেকে দূরে থাকছে।

তুলসী গ্রামের এমন ভোল বদলের শুরুটা বলা যেতে পারে ২০১৮ সাল থেকে। জয় ভার্মা এবং তাঁর বন্ধু জ্ঞানেন্দ্র শুক্লা বিয়িং ছত্তিসগড়িয়া নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালু করেছিলেন৷ কেন হঠাৎ গ্রামে বসে এমন ভাবনা? জয় স্পষ্ট জানিয়েছেন, নিজেদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁরা। এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন যা দতে 'ক্রিয়েটিভ'! জয় আর জ্ঞানেন্দ্রের তৃতীয় ভিডিওটি ভাইরাল হয়। দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বজরং দলের সদস্যরা ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে প্রেমিক-প্রেমিকাদের হেনস্থা করা নিয়ে ছিল ভিডিওটি। মজার ছলে সামাজিক বার্তা দেওয়াই ছিল ওই ভিডিওর লক্ষ্য।

কয়েক মাসের মধ্যে কয়েক হাজার 'ফলোয়ার' তৈরি হয় জয় আর জ্ঞানেন্দ্রর। তখন থেকে শুরু করে এখনও অবধি ১,২৫,০০০-এরও বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে এই জুটির এবং ২৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাঁদের ভিডিও দেখেন। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে এত সময় 'নষ্ট' করা নিয়ে পরিবারও শুরুর দিকে কথা শুনিয়েছিল ঠিকই, তবে টাকা উপার্জন শুরু হতেই সমস্ত গুঞ্জন থেমে যায়৷ মাসে ৩০,০০০ টাকা (প্রায় ২৭৮ ডলার) উপার্জন করতেন তাঁরা। ধীরে ধীরে নিজেদের একটি দল তৈরি করেন তাঁরা। কিছুকাল পরে ইউটিউবে সমস্ত সময়, সমস্ত মনোযোগ দিতে চাকরিই ছেড়ে দেন এই জুটি।

জয় আর জ্ঞানেন্দ্রের সাফল্য দেখে তুলসীর বাসিন্দারা অনুপ্রাণিরত হন। তাঁদের দল ভিডিও অভিনেতাদের পারিশ্রমিকও দিয়েছে, অন্যদের এডিটিং এবং স্ক্রিপ্ট লেখার প্রশিক্ষণও দিয়েছে। অন্য আরও অনেকেই নিজস্ব চ্যানেল তৈরিতে উদবুদ্ধ হন। ইউটিউবের এই বাড়বাড়ন্ত শিগগিরই স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও নজরে আসে। এই ভিডিওগুলির বিষয়বস্তু, ভিডিও নির্মাতাদের সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে, রাজ্য সরকার ২০২৩ সালে গ্রামে একটি অত্যাধুনিক স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করে। পেশায় প্রাক্তন কালেক্টর সর্বেশ্বর ভূরে বলছেন, গ্রামের ইউটিউব অধ্যায়টিকে ডিজিটাল বৈষম্য মোকাবিলার সুযোগ হিসাবে দেখেছেন তিনি৷ এই স্টুডিওটি তাঁরই কীর্তি। সর্বেশ্বর বলছেন, গ্রামীণ এবং শহুরে জীবনের মধ্যে ব্যবধান কমাতে চেয়েছিলেন তিনি। যাতে গ্রামের ইউটিউবারদের ভিডিওগুলোও সুন্দর হয়, প্রভাবশালী হয়, শক্তিশালী থিম থাকে, লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছয়, সেই লক্ষ্যেই স্টুডিও তৈরি করে গ্রামবাসীদের অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন তিনি।

তুলসী থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা তারকা হয়ে উঠেছেন, তাঁদের মধ্যে সবার আগে নাম নিতে হয় ২৭ বছরের পিঙ্কি সাহুর। কৃষক পরিবারে, প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা পিঙ্কি অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে যা হয় এমন গ্রামে, এমন পরিবারে — স্বপ্নের সামাজিক সমর্থন মেলে না। তবে পরিবার, স্বজনের নানা সমালোচনা সত্ত্বেও পিঙ্কি ইনস্টাগ্রাম রিল এবং ইউটিউব শর্টসে নাচের ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করেন। ভিডিও চোখে পড়ে Being Chhattisgarhia-র প্রতিষ্ঠাতাদের। পিঙ্কির ভিডিও দেখে নিজস্ব প্রযোজনার জন্য তাঁকে নিয়োগ করেন জয়, জ্ঞানেন্দ্ররা।

আঞ্চলিক সিনেমা নির্মাতারাও পিঙ্কির কাজ দেখেন। প্রথম একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ ঘটে পিঙ্কির। তারপর থেকে সাতটি ছবিতে অভিনয় করেছেন পিঙ্কি। বিলাসপুর শহরের প্রযোজক ও পরিচালক আনন্দ মানিকপুরী তো পিঙ্কির ইউটিউব ভিডিও দেখে মুগ্ধ! সিনেমায় নতুন মুখ খুঁজছিলেন তিনি। পিঙ্কিকে পছন্দ হয় তাঁর।

তুলসীর আরেক বাসিন্দা আদিত্য ভাগেল তখনও কলেজ পড়ুয়া। জয় ভার্মা এবং জ্ঞানেন্দ্র শুক্লার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজের ইউটিউব চ্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। এক বছরের মধ্যে ২০,০০০ ফলোয়ার হয় এবং ইউটিউব থেকে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। পরে জয় ভার্মা তাঁকে বিয়িং ছত্তিসগড়িয়া দলে লেখা ও পরিচালনার জন্য নিয়োগ করেন। কিছুকাল পরেই নিকটবর্তী শহর রায়পুরের প্রোডাকশন হাউসে একটি কাজ শুরু হয়, যেখানে তাঁর ইউটিউবের কাজের উপর ভিত্তি করেই নিয়োগ করা হয় আদিত্যকে। আদিত্য এখন বড় বাজেটের চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং সহকারী পরিচালকের কাজ করেন। স্বপ্ন দেখেন মুম্বইয়ে কাজ করার।

ইউটিউব থেকে সিনেমায় এসেছেন ৩৮ বছরের মনোজ যাদবও। জীবনে প্রথম রামায়ণে শিশু রামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। কখনও কল্পনাও করেননি যে একদিন ছত্তিশগড় জুড়ে সিনেমা হলগুলিতে তাঁর অভিনীত সিনেমা দেখানো হবে। ইউটিউবের কাজের কয়েক বছর পরই মনোজ যাদব একটি আঞ্চলিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনয় ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

তুলসী গ্রামের প্রাক্তন সরপঞ্চ দ্রৌপদী বৈষ্ণুর মতে, ভারতে পক্ষপাতদুষ্টতাকে চ্যালেঞ্জ করার এবং সামাজিক নিয়ম পরিবর্তনে ইউটিউব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গার্হস্থ্য হিংসা, নারী নির্যাতন যেখানে প্রকট, সেই সমাজে ইউটিউব ভিডিও চিরাচরিত প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, মত বদলাতে পারে। সম্প্রতি ৬১ বছর বয়সি দ্রৌপদী এই বিষয়েই তৈরি একটি ভিডিওতে অভিনয় করেছেন। দ্রৌপদী বলছেন, "আমি এই ভূমিকায় অভিনয় করতে পেরে আনন্দিত কারণ এখানে মহিলাদের সম্মান এবং সমতার মতো বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে, মেয়েদের সঙ্গে সমানা আচরণের গুরুত্বকে সামনে আনা হয়েছে।" বছরে আঠাশের রাহুল ভার্মা ওয়েডিং ফটোগ্রাফার। তিনি বলছেন, "প্রথমে, আমাদের মা ও বোনেরা শুধু সাহায্য করতেন। এখন, তাঁরা নিজস্ব চ্যানেল চালাচ্ছে। এটা আগে কল্পনাও করা যেত না।”

কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন ভারতে গ্রামীণ কনটেন্ট ক্রিয়েটারদের ব্যাপক প্রচার ঘটে, বিশেষ করে ২০২০ সালে টিকটক অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার আগে। সেই প্রাথমিক প্রচারের মূলে ছিলেন মূলত পুরুষ কনটেন্ট ক্রিয়েটাররাই। দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ডিজিটাল নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক শ্রীরাম ভেঙ্কটরামন বলছেন, মহামারীর পরে অনেক বেশি মহিলা সফলভাবে সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেল চালাচ্ছেন এবং এটি নতুন এক অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করছে। অনেকেই ইউটিউব থেকে অন্যান্য ব্যবসাও শুরু করছেন। এমনকী গ্রাহক টানতে, বা পণ্যের প্রচারে ইউটিউবকে ব্যবহার করছেন। যেমন বাড়িতে তৈরি চুলের তেল এবং মশলা, বা অন্যান্য জিনিস ইউটিউবের মাধ্যমে প্রচার করছেন গ্রামীণ বিক্রেতারা। কেউ কেউ আবার পিঙ্কির মতোই নিজের স্বপ্নকে বাস্তব হতে দেখছেন। গ্রামীণ ভাষায় হিপ-হপ করছেন ইউটিউবার রাজেশ দিওয়ার! বিশ্বাস করেন, তাঁর নিজস্ব মাতৃভাষায় র‍্যাপ বিশ্ব একদিন চিনবে। একদিন সংস্কৃতির এই 'অভিজাতকরণ' ঘুচে যাবে সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরেই।

 

তথ্য- বিবিসি

More Articles