Film Review: গৃহহিংসার চাপা অন্ধকারে আলো ফেলল আলিয়া ভাটের 'ডার্লিংস'
কেমন হলো আলিয়া ভাট অভিনীত 'ডার্লিংস'?
মেয়েরা একা সিনেমা বা রেস্টুরেন্টে যেতে পারে না, পারে না কোনও বিল ভরতে, তার জন্য লাগে ছেলেদের, লাগে স্বামী বা প্রেমিককে। রোজ বরের হাতে নিগৃহীত হওয়া কোনও মেয়ে চাইলেও তার স্বামীকে ফেলে একা থাকতে পারবে না, কারণ সে একা কোনও কাজ করতে পারবে না। এই ধারণা আমাদের সকলেরই, কিন্তু সহ্যের চরম সীমায় পৌঁছলে তখন কী উপায়? তারই উত্তর দেবে 'ডার্লিংস'।
৫ আগস্ট নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ডার্লিংস। প্রযোজক হিসাবে আলিয়া ভাটের প্রথম কাজ এটি। আলিয়ার প্রোডাকশন ইটারনাল সানশাইনের মাধ্যমে প্রযোজকের আসনে বসলেন তিনি। সহ-প্রযোজক হিসেবে পাশে পেয়েছেন শাহরুখ খানের প্রডাকশন হাউস রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্টকে। পরিচালক জসমিত কে রিনের দ্বিতীয় ছবি 'ডার্লিংস' ডার্ক-হিউমার জঁরের, 'গুস্তাখিয়া' (২০১৮) ছিল তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি।
ভারত পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ঘেরাটোপে বন্দি। বিয়ের পর স্বামীর অত্যাচারকে আমাদের সমাজ মা-বাবার শাসন হিসেবেই দেখে। নারীদের ডানা না মেলতে দেওয়ার এক গভীর প্রচেষ্টা গ্রাস করে রয়েছে আমাদের মানসিকতাকে। স্বামী পুরুষসিংহ, বউয়ের গায়ে হাত তুলতেই পারে, কে কী বলবে তাতে? মদ খেয়ে অত্যাচারও করতে পারে, তাতে কী? ভালো তো বাসে! এই ভেবেই প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে অত্যাচার সহ্য করে যায় প্রতিবাদ না করতে পেরে, আবার কেউ এই বিশ্বাস নিয়ে বাঁচে যে, তার স্বামী হয়তো ঠিক একদিন শুধরে যাবে। কিন্তু দিন বদলায় না, আর চুপ থাকাও যে এই গার্হস্থ্য হিংসা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায় না, সেটাই দেখিয়েছে এই ছবি।
বদরু আর হামজার গল্প তুলে ধরেছে সেই লাখ লাখ মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার চিত্রকে। 'ডার্লিং' মানে ভালবাসার মানুষ, প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে ডেকে থাকে এই সম্বোধনে। বিয়ের আগে করা হাজার প্রতিশ্রুতি প্রেমিকাকে দেওয়া হাজার স্বপ্ন স্বামীর পিতৃতান্ত্রিক শাসনের চক্করে কোথায় যেন পালিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: Film Review: সিনেমায় কবিতা পড়ার অনুভূতি, তীব্র ভালবাসার ছবি ‘অনন্ত’
ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলিয়া ভাট, চরিত্রের নাম বদরুন্নিসা ওরফে বদরু, হামজা শেখের চরিত্রে অভিনয় করেছে বিজয় ভার্মা, বদরুর মা সামশুন্নিসার চরিত্রে শেফালি শাহ ও জুলফির চরিত্রে রোশন ম্যাথিউ। বদরু গৃহিণী। তার বর হামজা রেলের সিনিয়র টিসি। হামজার ভালবাসায় অন্ধ বদরু, রাতে মদ খেয়ে বউয়ের সঙ্গে ভয়াবহ, দানবীয় ব্যবহার করা হামজা সকাল হলেই অন্য মানুষ, রাতে করা নৃশংস অত্যাচারের জন্য ক্ষমা চেয়ে আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বউয়ের হাতে বানানো পাউ আর অমলেট খেয়ে কাজে চলে যায় সে। আর হামজার মিষ্টি কথায় প্রতিবার ভুলে যায় বদরু, আশা করে নতুনভাবে সব শুরু হবে আবার। কিন্তু সে গুড়ে বালি, রাত হতেই মদ খেয়ে আসা হামজা পরিণত হয় অমানুষে। পান থেকে চুন খসলেই বদরুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হামজা। আর প্রতিবেশীরা রোজকারের ঘটনা বলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। একের পর এক উপায় ভাবতে থাকে বদরু আর বদরুর মা সামশু মিলে, ভাবে কীভাবে পথে আনবে হামজাকে, কিন্তু সব মাটি! সামশু একের পর এক সাবধানবাণী দিতে থাকে মেয়েকে, উপদেশ দেয় হামজাকে ছেড়ে দেওয়ার, কিন্তু নতুন আশায় ঘর বাঁধতে চাওয়া বদরুর এইসব কানে লাগে না। অত্যাচারও কমে না, বরং বাড়তে থাকে। ইলেকট্রিক্যাল জিনিসপত্র বেচতে আসা জুলফি বদরুর গায়ে কালশিটের দাগ দেখে আর থাকতে পারে না। পুলিশ স্টেশনে গিয়ে দৌড় লাগায় অভিযোগ দায়ের করতে, ডাক পড়ে মা-মেয়ের, পুলিশ ধরে নিয়ে আসে হামজাকে। এরপরই গল্পও মোড় নেয় অন্যদিকে, বদরু কি শুধরোতে পারে হামজাকে শেষ পর্যন্ত? না কি একই লয়ে চলতে থাকে বদরুর জীবন? এই উত্তর গোপন থাক।
কাঁকড়াবিছের স্বভাব যেমন কাটা, তেমনই মানুষও অত সহজে শুধরানোর নয়- শামসুর বলা একটি গল্পের মূল কথা ছিল এমনটাই। প্রবাদ আছে, ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, আর তা কতটা সত্যি বা কতটা মিথ্যে, তা এই সিনেমাটা দেখলেই বোঝা যাবে। পুরুষরা রাক্ষুসে আচরণ করে, কারণ মেয়েরা তা মেনে নেয়। কিন্তু এই অত্যাচার আর কতদিন? একজন মেয়ের সম্মান কি কখনও তার প্রেমিক বা স্বামীর হাতে থাকতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর খুব সুন্দর উত্তর ফুটে উঠেছে ডার্লিংসে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে একজন মেয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, তাই দেখায় এই সিনেমা।
ডার্ক-হিউমারের উপাদানে নির্মিত এই সিনেমা। কিন্তু জোর করে কমেডি না ঢোকালেও হতো। গল্পে আহামরি কোনও ট্যুইস্ট নেই, একই বৃত্তে গল্প ঘুরে চলেছে। কিছু কিছু জায়গা অহেতুক বাড়ানোর দরকার ছিল না। জুলফির চরিত্রে রোশন ম্যাথিউকে আরও ভালোভাবে ব্যাবহার করা যেতেই পারত, পার্শ্ব চরিত্র কাশিম ভাইয়ের চরিত্রটি থেকেও না থাকার মতোই, রাজেশ শর্মার মতো একজন অভিনেতার সঠিক ব্যবহারই হলো না। আলিয়া আর শেফালি শাহের অভিনয় এই ছবির সম্পদ। হামজার চরিত্রে বিজয় ভার্মাকেও ভালো লাগে।
ছবির ট্রেলার মুক্তি পেতেই দর্শকদের ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু গোল বেঁধেছে এখানেও, অনেকেই আলিয়া ভাটের এই সিনেমা বয়কটের ডাক দিয়েছে। এখন দেখা যাক, কতজন দর্শক এই সিনেমাকে গ্রহণ করে। আলিয়া ভাটকে যতই স্টারকিড হিসেবে ব্যাঙ্গ করা হোক না কেন, তার অভিনয় আজ অবধি কাউকে মুখ খোলার সুযোগ দেয়নি। বদরুর চরিত্রে আলিয়ার অভিনয় আরামসে দুই ঘণ্টা দর্শকদের টেনে রাখবে। সামশুর চরিত্রটি গল্পের ভিত মজবুত করেছে। ভয় পেয়ে মেয়ের ওপর অত্যাচার দেখেও চুপ করে যাওয়া মা না, বরং সরাসরি মেয়েকে মাঠে নেমে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগানোর এক বিরল দিক তুলে ধরেছেন পরিচালক। শেফালির অভিনয় সামশুর ব্যক্তিত্বকে পর্দায় খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। নিজের সম্মান ফিরে পাওয়া আর অমানুষ স্বামীকে কী করে বাগে আনতে হয়, তা জানতে হলে দেখাই যায় 'ডার্লিংস'। আত্মসন্মানবোধ, উপলব্ধি ও নিজের প্রতি ঘটা অবিচারের প্রতিশোধ নেওয়ার শক্তি জোগায় পরিচালক জাসমিত কে রিনের এই ছবি।
ছবি: ডার্লিংস
পরিচালক: জাসমিত কে রিন
অভিনয়: আলিয়া ভাট, বিজয় ভার্মা, শেফালি শাহ, রোশন ম্যাথিউ