পহেলগাঁও হামলা কতটা ক্ষতি করবে ভবিষ্যতের উমরান, সামাদ, শীতল দেবীদের?
Kashmir Sports: কাশ্মীর উপত্যকা থেকেই ২০২৪ প্যারালিম্পিক্সে ভারতকে ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছেন বাহুবিহীন তিরন্দাজ শীতল দেবী।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা এবং ১৯৪৮ সালে ভারতে অন্তর্ভুক্তির পর থেকেই কাশ্মীর ভারত পাকিস্তান দ্বন্দ্বের প্রধান উপকেন্দ্র হয়ে থেকেছে। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আজ অবধি, ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘকালীন সামরিক এবং রাজনৈতিক চাপান-উতরের সাক্ষী থেকেছে কাশ্মীর। সেনাবাহিনীর টহলদারি, নিরন্তর গোলাবর্ষণ, রক্তপাত, মৃত্যু — এই সবই এক প্রকার কাশ্মীরের রোজনামচা ছিল। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে কাশ্মীর কিছুটা হলেও অগ্রগতি করতে শুরু করেছিল, অন্তত ভারত সরকার তেমনই দাবি করেছিল। ৩৭০ ধারা তুলে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার অবলুপ্তির মাধ্যমে ভারত সরকার কাশ্মীরের বিতর্কিত ভূখণ্ডে কিছুটা আশার আলোর সঞ্চারের দাবি করেছিল।
বহু বছরের অস্থিরতা কাটিয়ে উঠে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল কাশ্মীর। সাধারণ কাশ্মীরিরা শান্তির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। উপত্যকাকে আবারও 'ভূস্বর্গ' ভাবতে শুরু করেছিলেন পর্যটকরা। ভিড় বাড়ছিল, ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছিল অর্থনীতি, আর সবচেয়ে আশাব্যঞ্জকভাবে, ক্রীড়াক্ষেত্রে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছিল। কাশ্মীর হয়ে উঠছিল ভারতের ক্রীড়া মানচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গুলমার্গের সফল 'খেলো ইন্ডিয়া উইন্টার গেমস' কিংবা শ্রীনগরের ডাল লেকের মনোরম পটভূমিতে আয়োজিত ফর্মুলা ওয়ান রেসিং— সব মিলেই এক নতুন কাশ্মীরের গল্প লেখা হচ্ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন —কাশ্মীর একদিন শুধু ভারতে নয়, বিশ্ব ক্রীড়া মানচিত্রের এক উজ্জ্বল কেন্দ্র হবে।
এই স্বপ্নের ভিত গড়ে তুলেছিল কাশ্মীরের নিজস্ব ক্রীড়া ঐতিহ্যও। বিশ্বখ্যাত কাশ্মীরি উইলো ব্যাট থেকে শুরু করে আব্দুল সামাদ, উমরান মালিকের মতো ক্রিকেটার কিংবা বাহুবিহীন তীরন্দাজ শীতল দেবীর অনন্য কীর্তি—সব মিলিয়ে উপত্যকা এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

শীতল দেবী
কিন্তু, ২২ এপ্রিলের সেই রক্তঝরা দুপুরে, কাশ্মীরের আকাশ আবার মলিন হয়ে উঠেছে। বন্দুকধারীদের নির্মম পরিকল্পনায়, ২৬জন নিরীহ ভারতীয় পর্যটক প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন দুই বিদেশি এবং পর্যটকদের রক্ষা করতে গিয়ে জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তরতাজা এক কাশ্মীরি যুবক। আহত হয়েছেন অনেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স যখন দিল্লির মাটি স্পর্শ করছেন, তখনই এই মারণ আঘাত কাশ্মীর উপত্যকার হৃদয়ে ছুরির মতো বিঁধে গিয়েছে। শুধু জীবন হারানোর বেদনা নয়, এই হামলা কাশ্মীরের পুনর্জাগরণ, বিশেষত ক্রীড়াক্ষেত্রে তার এগিয়ে চলা প্রচেষ্টাকে গভীর সংকটে ঠেলে দিল।
আরও পড়ুন-আমরা কাশ্মীরের ‘আপনা আদমি’ হতে পারি না?
ক্রীড়াক্ষেত্রে বিপুল ধাক্কার মুখে কাশ্মীর
ভারতের স্বাধীনতার আগে থেকেই কাশ্মীরের ক্রীড়াক্ষেত্রের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে, বিশেষ করে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে। সারা বিশ্বে সমাদৃত কাশ্মীরি উইলো ব্যাট শুধুমাত্র তৈরি হয় এখানেই। এই ব্যাট কিন্তু কোনও সাধারণ উইলো ক্রিকেট ব্যাট নয়। এই ধরনের ব্যাট ব্যবহার করেছেন বহু কিংবদন্তি ক্রিকেটাররাও। শুধু এই ব্যাট তৈরির কেন্দ্র হিসেবেই নয়, বহু প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরও জন্ম দিয়েছে কাশ্মীর। ভারতের হয়ে খেলা প্রথম কাশ্মীরি স্পিনার পারভেজ রাসুল এই অঞ্চলের গর্ব। সাম্প্রতিক সময়ের ভারতীয় পেসস্টার উমরান মালিক এই কাশ্মীরেরই সন্তান। এর পাশাপাশিও রয়েছেন আব্দুল সামাদ, যিনি হায়দরাবাদের ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে আইপিএলে নিজের নজরকাড়া পারফরমেন্স দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।

পারভেজ রাসুল
এই প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের পাশাপাশি, কাশ্মীর উপত্যকা থেকেই ২০২৪ প্যারালিম্পিক্সে ভারতকে ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছেন বাহুবিহীন তিরন্দাজ শীতল দেবী। তাঁর অদম্য সাহস ও ব্যতিক্রমী প্রতিভা দিয়ে শুধু জম্মু ও কাশ্মীর নয়, গোটা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। তাঁর কৃতিত্ব এই অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনে এক নতুন আলো এনেছে এবং বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে, এই উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সংখ্যা এই অঞ্চলে এখনও হাতে গোনা, যার প্রধান কারণ উন্নত সুবিধা ও পরিকাঠামোর অভাব। এই কারণেই ভারত সরকার বিশেষভাবে কাশ্মীরে ক্রীড়া পুনরুজ্জীবনের জন্য বাজেট বৃদ্ধি করেছিল। 'খেলো ইন্ডিয়া' প্রকল্পের অধীনে ক্রীড়া পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ ক্রীড়া প্যাকেজে কাশ্মীরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেখানে প্রাথমিকভাবে ২.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরবর্তীতে ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পৃথক বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল।
এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ সম্প্রতি গুলমার্গে সফল 'খেলো ইন্ডিয়া উইন্টার গেমস' আয়োজিত হতে দেখেছে দেশ। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি কাশ্মীরে প্রবেশ করেছে রোমাঞ্চকর রেসিং স্পোর্টসও; শ্রীনগরে ডাল লেকের পটভূমিতে ফর্মুলা ওয়ান রেসিংয়ের প্রদর্শনী ছিল নয়ন জুড়ানো।
কাশ্মীরের এই অগ্রগতি রাতারাতি আসেনি। কাশ্মীরকে বড় আকারের ক্রীড়া টুর্নামেন্ট আয়োজনের যোগ্যতা প্রমাণ করতে বছরের পর বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। ২০১৯ সালের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর ভারত সরকার কাশ্মীরকে নিয়ে কিছুটা আলাদাভাবে ভাবতেও শুরু করেছিল। কিন্তু ২২ এপ্রিলের এই সন্ত্রাসী হামলার পর কাশ্মীর আবারও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে। ভারত সরকার হয়তো ক্রীড়াঙ্গন হিসেবে কাশ্মীরের উত্থানকে কোনওভাবেই ব্যাহত করতে চাইবে না, তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কাশ্মীর কি আর আগের মতো থাকবে? উমরান, সামাদ বা শীতল দেবীকে দেখে যাঁরা ক্রীড়াক্ষেত্রে আসার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁরা কি নিজেদের মনোবল ধরে রাখতে পারবেন? কারণ বুলেট শুধু মানুষকেই আতঙ্কিত করেনি, কাশ্মীর বহু দশকের কষ্টের পর যে উচ্চাকাঙ্খা ও স্বপ্ন তৈরি করার চেষ্টা করছিল, তাও অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সবটা জানেন? যে অভিযোগ তুলছেন পাক ক্রিকেটার দানিশ কানেরিয়া

উমরান মালিক
পর্যটন শিল্পের বিপর্যয় ও ক্রীড়া অর্থনীতির পতন
কাশ্মীরের অর্থনীতিতে পর্যটনের ভূমিকা অপরিসীম এবং উইন্টার গেমস, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, রেসিংয়ের মতো ক্রীড়া পর্যটন এই শিল্পের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠছিল। এই আয়োজনগুলি পর্যটকদের আকর্ষণ করে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যটকেরা আবারও পিছু হটবেন, যা সরাসরি ক্রীড়া আয়োজনের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করবে। বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে দ্বিধা বোধ করবেন যা সরাসরি কাশ্মীরের ক্রীড়া পরিকাঠামো উন্নয়নকে প্রত্যক্ষভাবে ব্যাহত করবে।
আকাঙ্খা ও স্বপ্নের অসমাপ্ত গান
উমরান মালিকের গতির ঝড়, আব্দুল সামাদের সাহসী ব্যাটিং কিংবা শীতল দেবীর অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প— সবই কাশ্মীরি তরুণদের মনে এক নতুন সম্ভাবনার সুর বেঁধেছিল কিন্তু হিংসার ধাক্কায় সেই সুর যেন থমকে গেল। তরুণরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হবে, তাদের ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা দমে যাবে। স্বপ্ন দেখার সাহসই যদি কমে যায়, তবে প্রতিভার বিকাশও থমকে যাবে। ফলে, কাশ্মীরে ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা চলছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কাও প্রবল।
নিরাপত্তার বেড়াজাল
স্বাভাবিকভাবেই এখন থেকে যেকোনও বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের সময় নিরাপত্তার প্রশ্ন প্রধান হয়ে উঠবে। বাড়তি নিরাপত্তা মানে বাড়তি খরচ, বাড়তি জটিলতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদরা কাশ্মীরে আসতে দ্বিধা করবেন। গুলমার্গের উইন্টার গেমস কিংবা ডাল লেকের রেসিংয়ে যে প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল, ভবিষ্যতে তা ধরে রাখা কঠিন হবে বলেই আশঙ্কা ক্রীড়া মহলের। ফলে, এই আয়োজনগুলির মান এবং পরিসর দু'টিই ভালোমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আব্দুল সামাদ
ভাবমূর্তির ক্ষয় ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
কাশ্মীর দীর্ঘদিন ধরে একটি শান্তিপূর্ণ ক্রীড়া কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছিল। আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়ানুষ্ঠান আয়োজন করে, শীতল দেবীর মতো প্রতিভাকে সামনে এনে এক ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছিল বিশ্বমঞ্চে কিন্তু পহেলগাঁওয়ের হামলা সেই ভাবমূর্তিতে গভীর আঘাত হেনেছে। বিশ্বের ক্রীড়াবিদদের কাছে কাশ্মীর আবারও 'অনিরাপদ অঞ্চল' হিসেবে প্রতিভাত হবে, যা ভবিষ্যতের সমস্ত পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের উপরেই খারাপ প্রভাব ফেলবে।
কাশ্মীরের ক্রীড়াঙ্গনের এই ক্ষত রাতারাতি সারবে না। পহেলগাঁওয়ের এই হামলায় শুধু নিরীহ প্রাণের মৃত্যু হয়নি; বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা স্বপ্ন, আকাঙ্খা এবং সম্ভাবনার নিষ্ঠুর অপমৃত্যুও ঘটেছে। ভারতের ক্রীড়া জগত এখন এক অদৃশ্য শোকের ভার বইছে। কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্ম, যারা জীবনকে নতুন করে গড়ার, খেলাধুলোয় দেশকে গর্বিত করার স্বপ্ন দেখছিল, তাদের চোখের তারায় এখন নতুন এক আশঙ্কার ছায়া। কোনও স্বপ্ন কোনওদিনই পুরোপুরি মরে না— তবু কখনও কখনও স্বপ্ন দেখতে ভয় হয়। আজকের কাশ্মীর সেই ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।