স্কাইওয়াকটি এসপি মুখার্জি রোড ও কালী মন্দির রোড মোড় থেকে শুরু হয়ে কালীঘাট মন্দিরের প্রধান গেটের সামনে এসে শেষ হয়েছে।
হকার উচ্ছেদ করে স্কাইওয়াক? কালীঘাটের নতুন আকর্ষণ আদৌ উন্নয়ন?
Kalighat Skywalk: হকারদের একাংশের অভিযোগ, এই স্কাইওয়াকের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। ব্যবসা পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন আর সেভাবে এখন আসেন না।
চৈত্রের শেষ সন্ধ্যায় কালীঘাটের স্কাইওয়াক উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পয়লা বৈশাখে নবরূপে সজ্জিত কালীঘাট মন্দির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা শাসকদলের দাবি, এই স্কাইওয়াকের ফলে মন্দিরের প্রবেশপথ যানজটমুক্ত হবে এবং দর্শনার্থীদের ভিড় আগের থেকে বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর ফলে মন্দিরের আয় যেমন বাড়বে, হকারদেরও শ্রীবৃদ্ধি হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? স্কাইওয়াক কি সকলের শ্রীবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারছে?
বেশ কয়েকজন হকারের অভিযোগ, স্কাইওয়াক তৈরির জন্য তাঁদের দোকান তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, স্কাইওয়াক তৈরির পর তাঁদের দোকান করার জন্য জায়গা দেওয়া হবে কিন্তু এখন সেই প্রতিশ্রুতি রাখছেন না স্থানীয় কাউন্সিলর। হকারদের একাংশের এই অভিযোগ নিয়ে ইনস্ক্রিপ্ট যোগাযোগ করেছিল ৮৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন,
“সব মানুষের কিছু না কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে। তাঁদের প্রতি আমার সহানুভূতি নিশ্চয় রয়েছে। আগে কালী মন্দিরে লোক কম আসত, এবার বেশি লোক আসবে। সবটা তো সম্ভব না। যতটা পারছি, করছি।”
যদিও হকারদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বলছেন, মন্দিরের সামনে থেকে কিছুজনকে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি সবাই দোকান দিতে পারছেন, শুধু জায়গাটা কম পেয়েছেন। আগে একটা দোকান যে জায়গা জুড়ে ছিল, সেখানে এখন চারটে দোকান।
আরও পড়ুন- পুকুর থেকে পাওয়া গিয়েছিল দেবীর চরণ, শক্তিপীঠ কালীঘাট আজও ভক্তদের বিস্ময়
স্কাইওয়াকের কারণে উচ্ছেদ হওয়া হকার সুরেশ রায় (সুরক্ষার প্রশ্নে তাঁর নাম পরিবর্তন করা হলো) বলেন, স্কাইওয়াক তৈরির সময় থেকে তিনি বেকার। বাবার একটা কিডনি নেই। বউ-বাচ্চা আছে বাড়িতে। সবাই তাঁর উপর নির্ভরশীল। দোকান হারিয়ে কুল কিনারা পাচ্ছেন না তিনি। স্কাইওয়াকের প্রথম পিলার বসেছে এই হকারের দোকান উচ্ছেদ করে।
আর এক হকার ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেছেন,
"এই স্কাইওয়াকের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। ব্যবসা পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন আর সেভাবে এখন আসেন না। দুই বছর পর দোকান খুললাম স্কাইওয়াক তৈরি হতে। আগেও তো মানুষ আসত। স্কাইওয়াক করে শুধু শুধু হকারদের পেটে লাথি মারা হলো।"
একসময় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী মামলাও করেছিলেন, তাঁরা মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন কিন্তু ব্যবসা করতে পারছেন না। কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি কৌশিক চন্দর বেঞ্চে ওঠে এই মামলা।
প্রসঙ্গত, ৪৩৫ মিটার দীর্ঘ এই স্কাইওয়াকটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে ১৮ মাসের সময়সীমা নির্ধারণ করে কাজ শুরু হলেও প্রকল্পটি একাধিক কারণে বিলম্বিত হয়। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপুজো, কালীপুজো ও গঙ্গাসাগর মেলার সময় ভক্তদের উপচে পড়া ভিড়ের চাপে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। এছাড়া কেএমসি-র ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, স্কাইওয়াক নির্মাণের পথে বহু কারিগরি বাধা আসে। ইটের বক্স ড্রেন, হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন, তিনটি জল সরবরাহের লাইন এবং একটি পুরনো গ্যাস লাইন সরানো হয়।
আরও পড়ুন- প্রাচীন কলকাতায় এসেছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক!
সদ্য উদ্বোধন হওয়া এই স্কাইওয়াকটি এসপি মুখার্জি রোড ও কালী মন্দির রোড মোড় থেকে শুরু হয়ে কালীঘাট মন্দিরের প্রধান গেটের সামনে এসে শেষ হয়েছে। এছাড়া স্কাইওয়াকের একটি ৩০ মিটার দীর্ঘ শাখা কালীঘাট ফায়ার ব্রিগেড মোড় থেকে শুরু হয়ে প্রধান ট্রাঙ্কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে কালীঘাট থানার কাছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে এত বছর, এত অপেক্ষা, এসবের পর যে সুযোগ তৈরি হলো তাকে উন্নয়ন বলা চলে, না কি তা 'স্পেকটেকল অফ ইকোনমি'? গাই ডেবোর্ড ‘দ্য সোসাইটি অফ দ্য স্পেকটেকল’ বইয়ে এই শব্দবন্ধ সামনে আনেন। এখানে ব্যক্তিকে কার্যত দৃশ্যের দ্বারা পরিচালিত ভোক্তা হিসেবে দেখানো হয়। দৃশ্যায়ন তাকে অনবরত মুগ্ধ করে চলে, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু এই আকর্ষণ সত্যিই উন্নয়ন কি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন শাসকদলের হাতের মুঠোয় দুই 'ম'। মহিলা ভোট আর মুসলিম ভোট। এবার হিন্দুত্বের পথে হেঁটে প্রধান বিরোধীদলের ক্রমবিকাশ ঠেকাতেই সরকারি তৎপরতা। তবে কারণ যাই হোক, বিশ্লেষকরা বলছেন এই মহাযজ্ঞ আরও সর্বাত্মক অংশগ্রহণমূলক হলেই আখেরে মঙ্গল হতো।