রং মাখানোর নামে জবরদস্তির অধিকার কে দিল?
Misogynist Holi Celebration 2024: তরুণ মজুমদারের ‘ঘরোয়া ও মিষ্টি’ ঘরানার ছবিতেও বাধা না মেনে কাঙ্খিতাকে রং মাখানোর উদযাপন আমরা দেখি।
গতবছর, মানে ২০২৩ সালের হোলি উৎসবের প্রাক্কালে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের মেয়েদের জন্য এসেছিল এক একুশে আইন। হোলিতে দিনমান তাদের থাকতে হবে হস্টেলের ঘরে। ঘটনাচক্রে সেবার আবার হোলি সমাপতিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারীদিবসের সঙ্গে। পরিস্থিতি, অতএব, দাঁড়াল এই যে, নারীমুক্তির প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রইবেন অবরূদ্ধ। অবশ্য কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শিয়েছিল ফতোয়ার! এমন ফতোয়া ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হস্টেলেও জারি হয়েছিল। সেখানেও একই কারণ। বলা হয়েছিল, রংয়ের উৎসবের দিনটি যেহেতু উচ্ছৃঙখল উল্লাসেরও দিন, তাই সেদিন মেয়েরা বাইরে নিরাপদ নয়। অর্থাৎ পুলিশ-প্রশাসন বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কেউ সেদিন মেয়েদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। অতএব সেই চিরাচরিত বিধানের শরণাপন্ন হওয়া গেছে। মেয়েদের সুরক্ষার একমাত্র বন্দোবস্ত হতে পারে মেয়েদের ঘরে বেঁধে ফেললে।
এদিকে রঙিন চাপল্যে সেদিন কঠোর নিগড় ভাঙার ডাক৷ হোলি নিয়ম ভাঙার দিন। কিন্তু সে ডাক কার জন্য? নিয়ম ভাঙবে কে? কর্তৃকারক এখানেও মূলত পুরুষ। বাধার বেড়া ভেঙে, শাসনের খুঁট উপড়ে, নীতির দড়ি ছিঁড়ে পুরুষ-পশু সেদিন যে ভূমিতে আচম্বিত চারণ করতে আসতে পারে, সেই জমি হল নারী। যে নিজেই চারণভূমি মাত্র, তার আবার মুক্ত আকাশ বা প্রান্তর চাওয়ার যৌক্তিকতা কী? অতএব, প্রকৃতিতে ও পারিপার্শ্বে, স্থলে-জলে-বনতলে, রঙের যে বিস্ফোরণ, তাতে মেয়েদের না-ই বা থাকল অধিকার!
মেয়েরা অবশ্য অবাধ্য হয়েছিল। গলা ফাটিয়েছিল সেবার। কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল রফায় আসতে। কিন্তু হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনও বিধিবিষেধ না থাকা সত্ত্বেও, বন্ধুরা অনেক ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও, পরী নামের মেয়েটি দোল খেলেনি গবেষণার পাঁচ-পাঁচটা বছর। পরী বোলপুরের মেয়ে। পড়াশোনা আঞ্চলিক স্কুলে৷ তারপর বিশ্বভারতীতে। তারপর তার হায়দরাবাদ আগমন। পরী আকৈশোর জানে, দোল ভয়ের দিন। ঝাঁক ঝাঁক বহিরাগত ভিড় করে শহরে। বেশিরভাগই আসে মহানগর থেকে। তাদের মাথায় ‘শান্তিনিকেতনের মেয়েদের’ রঙ মাখানোর ভূত চেপে থাকে। তাদের আবির-মুঠো ব্লাউজের পিঠ দিয়ে ভিতরে গলে যেতে পারে। পিছন থেকে হঠাৎ কেউ জড়িয়ে ধরতে পারে। খোঁপায় পলাশ ফুল লাগিয়ে নাচতে নাচতে নগর পরিক্রমার সময়ে এসব অসভ্যতা যখন-তখন রবীন্দ্রসংস্কৃতির ফাঁক গলে ঢুকে যেত। কোনও রকমে নাচ শেষ করে সে বাড়ি ফিরত ছুটে। হায়দরাবাদেও সে ভয় তাকে এমন তাড়া করে যে, সে স্বেচ্ছায় থাকে গৃহবন্দি।
আরও পড়ুন- ভারতের চেয়ে বেশি বাঁদুরে রঙ খেলেন বিদেশিরা! বিশ্বের দোল উৎসবে ঠিক কী ঘটে?
কিন্তু প্রতিমাদির গৃহবন্দি থাকার উপায় নেই। প্রাত্যহিক মজুরির আয়া। বেলুন, পিচকিরি, টিটকিরি তো জলভাত। বস্তি দিয়ে শর্টকাট মারতে গিয়ে যেদিন এক মদ্যপ জড়িয়ে ধরে রঙ মাখাতে এল, সেদিন প্রতিমাদির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। পরের বছর থেকে দৈনিক মাইনে বিসর্জন দিয়েও সে ছুটি নেবে, ঘোষণা করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এক জাপানি মেয়ের নিজের পোস্ট করা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল গতবছর (২০২৩)। সে-ও ছিল ভীত ও বিহ্বল। দিল্লির রাস্তায় হোলির দিন বেরিয়ে সে যার-পর-নাই নাকাল৷ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তাকে জবরদস্তি রং মাখাচ্ছে এবং অবশেষে তার মাথায় ডিম ফাটাচ্ছে কিছু উদ্দাম ভারতীয় পুরুষ৷
একই বছর সাংবাদিক আয়েশা রেহমানের এক্স হ্যান্ডেলের পোস্টে দেখা যায়, রিকশায় আরূঢ় এক বোরখা পরিহিতাকে তাঁর নিষেধ উপেক্ষা করে রঙ মাখানো হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীরা সেই ভিডিও ছড়িয়েছে। শেয়ার করার সময় জুড়ে দিয়েছে অশ্লীল ভোজপুরি সংগীত, যেখানে ঘাগরা-চোলি ইত্যাদির বাধা না মেনে রং ঢেলে দেওয়ার ইঙ্গিত।
সেই বছরই দিল্লির পুলিশ কন্ট্রোল রুম হোলির দিন পঁয়ত্রিশ হাজার ফোন পেয়েছিল, যা গড় দৈনিক ফোন সংখ্যার চেয়ে প্রায় এগারো হাজার বেশি। এর মধ্যে ২১১ টি ছিল ‘ছেড়ছাড়’ বা ইভটিজিংয়ের অভিযোগ, যাকে আসলে একপ্রকার যৌন নিগ্রহ বলাই সমীচিন। ছিল ৪০ টি গুলি চালানোর, ১৪২ টি ছুরি মারার, ২১ টি ধর্ষণ আর ১১ টি খুনের কেসও। কলকাতায় পুলিশ সেবার দোলের দিন ৪৯০ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর খবর অনুসারে। এসবই বিগত দোল ও হোলির খবর। গতবছর এবং আরও নানা বছর, আরও কত যে অনথিভুক্ত, অব্যক্ত, নির্যাতনের গল্প লুকিয়ে আছে!
হোলিতে যে সম্মতির তোয়াক্কা না করে গায়ে হাত দেওয়া বা রং মাখানো বা পিছু নেওয়া যায়, এ সংস্কৃতি বলিউডের অবদান, নাকি বলিউড এ সংস্কৃতির দর্পণমাত্র— তা বলা মুশকিল। সম্ভবত তারা একে অপরের পরিপূরক। ‘আজ না ছোড়েঙ্গে হাম চোলি/ খেলেঙ্গে হাম হোলি’ অথবা ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়’ গানগুলিকে তো এখন ‘কনসেন্ট ভায়োলেশন’ বা সম্মতির তোয়াক্কা না করার ধ্রুপদী উদাহরণ ধরা হয়। কিন্তু উত্তর ভারতের হোলি খেলায় দেহাতি পৌরুষের হুঙ্কার বেশি বলে একথা ভাবা ভুল যে বাঙালির দোল উৎসব মূলত শান্তিনিকেতনি ঘরানার, কোমল ও নিষ্পাপ। বাবু কালচারে দোল খেলার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঈশ্বরগুপ্ত লিখেছেন:
‘ক্রমেতে হোলির খেলা/ নবীনা নাগরী মেলা ছুটেমুটে যায় এক ঠাঁই/ যার ইচ্ছা হয় যারে / আবির কুঙ্কুম মারে ও পিচকারি কেহ দেয় গায়ে।’
‘যার ইচ্ছা হয় যারে’, রং মাখালেই হলো! উল্টোদিকের মানুষটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রসঙ্গ অবান্তর। সেই সময় থেকে শুরু করে, তরুণ মজুমদারের ‘ঘরোয়া ও মিষ্টি’ ঘরানার ছবিতেও বাধা না মেনে কাঙ্খিতাকে রং মাখানোর উদযাপন আমরা দেখি। হেমন্তের কণ্ঠে গানের কথাগুলি ছিল এরকম: ‘কোনো বাধা নাহি মানি রাঙাব বসনখানি/ ভুবনে এসেছে আজ মধু ফাগুয়া।’
বস্তুত, মিখাইল বাখতিন যাকে ‘কার্নিভাল’ বলেন, তার ভারতীয় প্রতিচ্ছবি দেখা যায় হোলি বা দোলে। বাখতিন আগ্রহী ছিলেন মধ্যযুগীয় ইওরোপিয় কার্নিভাল বিষয়ে, যা নিয়মিত কিছু সময় অন্তর সামাজিক সুশৃঙ্খলতায় ক্ষণিকের বিরামচিহ্ন আঁকত। ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সামাজিক বহুধা শিকলে বাঁধা মানুষকে দিত সাময়িক দম ফেলার পরিসর। অনুশাসনে অবদমিত প্রবৃত্তি সেসময় চাগাড় দিয়ে ওঠে। ক্ষণিকের এই ‘যেমন-খুশি-করো’-র বিরতির পর আবার নিয়মে ফিরে যাওয়া। অতএব, কার্নিভাল নামক সেফটি ভালভের ব্যবস্থায় একদিকে জনমানুষের দিলখুশ। তার নিষিদ্ধ, আক্রমণাত্মক আবেগগুলি খেলাচ্ছলে প্রকাশ পেতে পারে। নেতিবাচক আবেগগুলি হেসে প্রকাশ করলে সেসময় কেউ গায়ে মাখে না। অন্যদিকে, তেমনই রাষ্ট্রেরও পোয়াবারো। অবদমিত ক্ষোভের বাষ্প এই অবসরে নিষ্কাশিত হলো যে!
বস্তুত, হোলি বা দোলের ধাতটিও এর সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। বাখতিন এভাবে ভেবেছিলেন বলে মনে করার কারণ নেই যে, বাখতিনের সময় থেকে এই ছকের সূচনা। এ ভাবনা মধ্যযুগীয় ইওরোপেরও আগে এসেছে ঋগবেদে। সেখানে, প্রাচীন বৈদিক সমাজে আমরা দেখি, শৃঙখলা আর বিশৃঙখলার কাল ঘোরে চক্রাকারে। লক্ষ্যণীয়, বিশৃঙখলার বিস্ফোরণের ব্যবস্থা রাখা হতো বর্ষশেষে। কিছু সুক্তে বলা হয়েছে, ইন্দ্রমেরুর পতন ও উত্থানের মধ্যবর্তী কয়েকদিন দানব বা অসুর অবস্থা চলে। এই কয়েক দিন হল কার্নিভালের দিন। অবদমনের চোটে মানুষের ফেটে পড়া আটকাতে সামাজিক সেফটি ভালব। হোলি বা দোল এই চর্চারই প্রতিনিধি।
আরও পড়ুন- উৎসবের নামে কতদিন চলবে নিগ্রহ — রংখেলার সিনেমা ও বাস্তব
মথুরায় হোলির সময় এক অদ্ভুত প্রথা দেখা যায়। যারা অন্য সময় লাজুক, সন্ত্রস্ত, সেই মেয়েদের হাতে লাঠি। পুরুষেরা সেই লাঠির বাড়ি খায় বিনা প্রতিরোধে। অর্থাৎ, সারাবছর যে নিগ্রহকারী ও যে নিগৃহীতা, তাদের মধ্যে খেলাচ্ছলে ‘রোল রিভার্সাল’ হচ্ছে। এতে নিগৃহীতা হয়ত ক্ষণিকের শান্তি পাবে। আবার বারাণসীর ঘাটে, যেখানে চিরন্তন চিতা জ্বলে, সেখানে সেই চিতার ছাই ওই একটি মাত্র দিনে বামুন থেকে শূদ্র সকলের কপাল রাঙায়। আদতে কিন্তু বারাণসীতে বর্ণভেদ প্রবল। অর্থাৎ একদিনের এই সাম্যের ভান, এই ‘ছাড়’ যেন দলিতের ক্ষোভকে প্রশমিত করে! কথিত আছে, ভারতীয় সুন্নি মুসলমানদেরও নিজস্ব প্রশমন উৎসব ছিল। তা ছিল মহরম। শিয়াদের সুন্নি-ঘৃণার অন্যতম কারণ নাকি মহরমের মতো শোকোৎসবে লঘু আমোদ-প্রমোদ।
হোলিতে উত্তর ভারতের গোবলয়ে আরেক প্রথা আছে। আবালবৃদ্ধবনিতা জড়ো হয়ে, সে জমায়েতে মেয়েদের মুখের উপরেই ধর্ষকাম-নিহিত গালি দেয় পুরুষদল, আর তা হাসি-মজার হাওয়ার উড়ে যায়। হোলি বাদে অন্য কোনও দিন কিন্তু মেয়েদের সামনে এভাবে যৌনগন্ধী গাল পাড়া (প্রায়শই মা তুলে) সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। এও একরকম একদিনের ইচ্ছাপূরণ। কিন্তু এখানে ক্ষমতাহীনের নয়, ক্ষমতাবানেরই আরও গর্হিত, আরও ভয়ানক ইচ্ছেগুলি পূর্ণ হচ্ছে।
একইভাবে ভারতীয় পুরুষের কাছে হোলি বা দোল ছিল এবং দিন দিন আরও গভীরভাবে হয়ে উঠছে, যৌন অবদমন থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন। ভারতে চোরাগোপ্তা যানবাহনে যৌন নিগ্রহ চলে, কিন্তু যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি সুস্থ আলোচনা গর্হিত। এমতাবস্থায় হোলির দিনে যেন ছাড়পত্র দেওয়া হয়— যা কিছু সুপ্ত বাসনা, গুপ্ত না থেকে সে একদিনের তরে নির্ভয়ে আসতে পারে প্রকাশ্যে। সে বাসনা ততদিনে অন্ধকারে গলে-পচে বীভৎস আকার নিয়েছে।
নারীর কি বাসনা নেই? রং খেলার ইচ্ছের মতো, নারীর কি গোপন যৌন বাসনাও নেই? আছে। তবে তা প্রকাশের কোনও দিন বুঝি নেই। ওই যে প্রথমেই বলা হলো, পুরুষ সেদিন ‘রশিছেঁড়া ষণ্ড’, নারী চারণভূমি মাত্র, অন্তত পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিতে।
আর সে দৃষ্টিভঙ্গি যদি মানতে নারাজ হই? তবে গুলালে বিদ্রোহের লাল মেশে। বারাণসীর বিধবার গাল তখন রাঙা হয়। কুমায়ুনের ‘মহিলা বৈঠকি হোলি’-তে বেজে ওঠে ‘রঙ সারি গুলাবি’। নীল দিগন্তে ফুলের আগুন ছড়ায়। তার সৌরভের শিখায় হাত সেঁকে হোলি ‘রিক্লেম’ করে কারা যেন!